বাবার আত্মজা

বাবা, এই ডাকের  মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অসীম ভরসা ও বিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। বড় সন্তান নাকি বাবার বৈশিষ্ট্য বেশি পায়। মায়ের মতে, আমি বাবার ডুপ্লিকেট কপি। আমার বাবা বিজন কুমার রায়, একটি বেসরকারি কলেজের রসায়নের শিক্ষক।

নিজে শিক্ষক হওয়ার পরও বাবা কখনো আমার পড়ালেখা নিয়ে জোর করেন। নিজের ভালো লাগার জন্যই পড়া উচিত, এটাই ছিল বাবার মত। বাবার শুধু একটাই কথা, ‘তুই পারবি। নিজের পায়ে তোকে দাঁড়াতেই হবে।’ পড়ালেখা মোটামুটি ভালোই চলছিল।

ক্লাস সেভেনে অঙ্ক পরীক্ষায় হলে হঠাৎ আমার জীবনে এল নতুন এক অসুখ। যার নাম টেনশন। মনে হলো সব ভুলে গেছি। ফলাফল, পরীক্ষার খাতায় বমি। বাড়ি ফিরলে বাবা বলল, ‘ফেল কর পরীক্ষায়, কিন্তু বমি করিস না।’ কোনো বাবা মেয়েকে এত সহজে পরীক্ষায় ফেল করতে বলতে পারে, তা আমার জানা ছিল না।

তারপর থেকে সব পরীক্ষার আগে বাবার মুখে শুধু একটাই কথা, ‘কোনো চিন্তা নেই, সব ভালো হবে।’ বাবার কাছ থেকে এই মনের জোর পেয়েই এসএসসিতে এ প্লাস পাই। কিন্তু এইচএসসিতে পাই ৪.৮০। আমার মা সেই দুঃখে কেঁদে ছোটখাটো একটা পুকুর বানিয়ে ফেললেও বাবা বলেছিল, ৪.৮০ পাওয়া আর ৫.০০ পাওয়া একই কথা। হয়তো তাই আমার চোখে এক ফোঁটা জলও আসেনি।

তারপর প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে আমি পরাজিত হই। তবু বাবার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বিতীয়বার আমি অবশ্যই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাব এবং আমি বাবার স্বপ্নপূরণে সফল হই। বাবা সব সময় আমাকে নিজের জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখিয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে ভর্তি হব, সেই সিদ্ধান্তও বাবা আমাকে নিতে বলে।

অনার্স শেষ করার পর বাবা বলে, ‘বিসিএস পরীক্ষা দিবি?’ আমি ভাবলাম, ওরে বাবা, বিসিএস! একি আমার দ্বারা হবে? কিন্তু বাবার সেই এক কথা, ‘চেষ্টা করলে তুই অবশ্যই পারবি।’ মূলত বাবার আশা পূরণের জন্যই বিসিএসের পড়ালেখা শুরু করলাম এবং ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে পাস করে লিখিত পরীক্ষা দিলাম। বিসিএসের পাশাপাশি ব্যাংকেও পরীক্ষা দিতাম।

>

জীবনে চাকরি করব এই ভরসা নিজের ওপর ছিল, কিন্তু বাবা অবসরে যাওয়ার আগে চাকরি পাব, তা কখনো ভাবিনি। সন্তানের সঙ্গে চাকরি করার যে আনন্দ, তা বাবা–মাকে দিতে পেরেছি, এতেই আমার জীবন সার্থক। যদি বিসিএসে পাস করে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক হতে পারি, তাহলে বাবা এত খুশি হবে যে তা কল্পনা করতেও পারি না।

বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এখনো বের হয়নি। আমি এখন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একজন অফিসার। অঙ্কে ভয় পাওয়া মেয়েটা আজ ব্যাংকের অফিসার হতে পেরেছে শুধু বাবার দেওয়া মনের জোরে। বাবার চাকরি সামনের বছর শেষ।

জীবনে চাকরি করব এই ভরসা নিজের ওপর ছিল, কিন্তু বাবা অবসরে যাওয়ার আগে চাকরি পাব, তা কখনো ভাবিনি। সন্তানের সঙ্গে চাকরি করার যে আনন্দ, তা বাবা–মাকে দিতে পেরেছি, এতেই আমার জীবন সার্থক।

যদি বিসিএসে পাস করে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক হতে পারি, তাহলে বাবা এত খুশি হবে যে তা কল্পনা করতেও পারি না।(বাবা রসায়নের শিক্ষক, মেয়ে পদার্থবিজ্ঞানের—এটাই বাবার ইচ্ছা)। আমিও আমার সুপারহিরোর আমাকে নিয়ে এই শেষ স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই।

ভেবেছিলাম প্রথম চাকরির টাকায় বাবাকে বাবা দিবসে উপহার দেব কিছু, কিন্তু করোনার জন্য মার্কেট বন্ধ। লেখাটা যদি মনোনীত হয়, তাহলে এটাই বাবাকে দেওয়া অন্যতম সেরা উপহার হবে। কারণ, বাবাকে কখনো বলা হয়ে ওঠেনি যে বাবা, তুমি মনে সাহস না দিলে তোমার ভিতু মেয়েটা আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি কখনো পেত না।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]