বাবা, তোমাকে ভালোবাসি

আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। বাবার সঙ্গে কখনো বাইরে গেলে পুলক বোধ করতাম, অবাক হতাম। কতশত লোক তাঁকে চেনে, সম্মান করে। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম আর বুঝতে পারলাম কেনই–বা সবাই বাবাকে এত সম্মান আর শ্রদ্ধা করে।

আশির দশকে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা একজন মানুষ, যিনি বড় বড় চাকরির হাতছানি এড়িয়ে সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে একটা অখ্যাত গ্রামে থেকে যেতে পারেন, তাঁর এমন সম্মান প্রাপ্যই। বাবা তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন সমাজে আলো ছড়াতে। বাবার হাত ধরেই, তাঁর দেখানো পথেই তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রীই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সফল ব্যক্তিত্ব।

বাবাকে কখনো রাগতে দেখিনি, কখনো কাউকে বকতে দেখিনি। বাবা ছিলেন শান্ত এবং নরম মনের মানুষ। বাবার কাছে কাউকে কোনো প্রয়োজনে এসে খালি হাতে বিদায় হতে দেখিনি। গ্রামের মানুষের বিপদে বাবা ছিলেন তাদের জন্য ত্রাণকর্তা। আমাদের পরিবারে আর্থিক অভাব ছিল, কিন্তু সুখের অভাব ছিল না। মায়ের নানান অভিযোগ বাবা অবলীলায় সহ্য করতেন, হাসিমুখে এড়িয়ে যেতেন, ঠান্ডা মাথায় বোঝাতেন।

>

বাবাকে নিয়ে কখনো তেমন আলাদা করে ভাবিইনি। কিন্তু বাবার একটা বড় ধরনের অপারেশনের সময়েই তাঁর গুরুত্বটা টের পেয়েছি। বাবাকে যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, তখন মনে হলো মাথার ওপরে ছায়া দেওয়া বটগাছটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

বাবাকে নিয়ে কখনো তেমন আলাদা করে ভাবিইনি। কিন্তু বাবার একটা বড় ধরনের অপারেশনের সময়েই তাঁর গুরুত্বটা টের পেয়েছি। বাবাকে যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, তখন মনে হলো মাথার ওপরে ছায়া দেওয়া বটগাছটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। পরম করুণাময়ের কাছে কখনো তেমন কিছু চাইনি, কিন্তু সেইবার বেশ করেই চাইলাম, হে সৃষ্টিকর্তা, আমার বাবাকে ভালো করে দিয়ো। আমাদের মাথার ওপর থেকে বটগাছটা কেড়ে নিয়ো না। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা শুনেছিলেন, বাবা সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন, তারপর থেকেই বাবাকে আর চোখের আড়াল হতে দিইনি।

বাবাকে আবেগহীন মানুষ বলেই ভাবতাম। পরিবারের অনেক কঠিন সময়েও তাঁকে নিরুত্তাপ দেখতাম। কিন্তু এ রকম শক্ত মানুষের ভেতরটা যে এতটাই নরম হতে পারে, তা কখনো ভেবে দেখিনি। এই তো কয়েক দিন আগেই চাকরিক্ষেত্রে যোগদানের জন্য ঢাকায় চলে আসতে হলো। করোনা সমস্যায় ঢাকা এখন মৃত্যুফাঁদ, ঢাকায় চলে যাওয়ার কথা বলতেই বাবার অস্থিরতা টের পাচ্ছিলাম। বাবা জায়নামাজে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে লাগলেন, যতটা সম্ভব তিনি আমার সামনে কম আসতেন। বাসে ওঠার আগপর্যন্তও বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। বাসে উঠেই বাবাকে হাত নেড়ে বিদায় বলতে গিয়েই চোখে চোখ পড়ল, তাঁর চোখভর্তি পানি। গাল বেয়ে চোখের একেকটা ফোঁটা পানি পড়ছে। ঠিক সেদিনই স্থির করলাম, যদি বেঁচে থাকি, যদি আবার করোনা–পরবর্তী সময়ে বাবার কাছে যেতে পারি, তবে ৩০টা বসন্ত যেটা পারিনি, সেটা করব। আর লজ্জা করব না, বাড়ি ফিরেই কোনো সংকোচ ছাড়াই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলব, ‘বাবা তোমাকে ভালোবাসি।’

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]