বাবাকে না-বলা কথা

বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হতো, আর বাবা প্রচণ্ড খুশিমনে মাকে বলতেন, ‘আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে। কারণ, ছেলে এবার বহুদিন আমার কাছে থাকবে।’ অসুস্থ শরীর নিয়েও গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতেন, যেন ছেলে তাঁর রাজশাহী না, রাশিয়া থেকে ফিরছে। রাজশাহী থাকলে প্রায়ই দুপুরে মাকে বলতেন, ‘আমার ছেলেকে একটু এনে দাও। একসঙ্গে ভাত খাই।’ বাসায় থাকলে সকালে উঠে আমার রুমে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। তাঁর এমন শিশুসুলভ আচরণে আমি অবাক হয়ে যেতাম। একদিন তাঁকে বলেছিলাম, ‘তুমি এমন করো কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তুই যখন বাপ হবি, তখন বুঝবি।’...এ রকম নানা স্মৃতি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল বাবার ফিস্টুলা অপারেশন করানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে বাগেরহাট থেকে খুলনা যাওয়ার সময়। করোনাকালের নানা ভীতির চেয়েও বেশি ভয় ছিল বাবার কিডনির রিপোর্ট নিয়ে। দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাওয়ার রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকে যেন অনেকটাই নীরব হয়ে গেছেন।

এখন আর আগের মতো আবেগের প্রকাশ নেই, কিন্তু আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন প্রতিদিনই বাড়ছে। ফিস্টুলা করানো শেষে কিডনি বিশেষজ্ঞর সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফেরার পথে তিনি আমাকে একটা কথা বলতে গিয়ে বেশ কেঁদেছিলেন। বললেন, অপারেশন চলাকালে তাঁর একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে বেশ কান্না এসেছিল। তিনি ভেবেছিলেন করোনাকালের এই দুর্দিনে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে তাঁর ছেলেটাকে না জানি কত ভোগান্তিতে পড়তে হবে। কারণ, আমি ছাড়া যে তাঁর পাশে আর কেউ নেই।

>

তিনি ভেবেছিলেন করোনাকালের এই দুর্দিনে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে তাঁর ছেলেটাকে না জানি কত ভোগান্তিতে পড়তে হবে। কারণ, আমি ছাড়া যে তাঁর পাশে আর কেউ নেই। লকডাউনের এমন পরিস্থিতিতে আত্মীয়স্বজনও তো আসতে পারবেন না। তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি একজন বাবার নতুন এক পরিচয় পেলাম।

লকডাউনের এমন পরিস্থিতিতে আত্মীয়স্বজনও তো আসতে পারবেন না। তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি একজন বাবার নতুন এক পরিচয় পেলাম। হ্যাঁ, একজন বাবা শুধু তাঁর সন্তানের স্বপ্নের নায়ক নন, বটবৃক্ষ নন, ভালোবাসার আকাশ নন, ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল নন, তিনি এমনই একজন, যিনি অপারেশন থিয়েটারে শুয়েও এটা ভেবে কাঁদেন যে অপারেশনকালে তাঁর মৃত্যু হলে না জানি তাঁর সন্তানকে কত ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

সেদিন তাঁর অশ্রু দেখে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। বলতে পারিনি, হয়তো কখনো পারবও না। বাবা, যেদিন জানলাম তোমার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে, সেদিন থেকে আমি মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছি। তোমাকে কখনো হারাতে পারি, এটা চিন্তা করলেও মনের ভেতর ভীষণ কষ্ট বাসা বাঁধে, পরিণত হয় এক মানসিক ক্যানসারে।

প্রভাষক, ইংরেজি
নারায়ণকুল ড্রিম মডেল কলেজ, গাজীপুর।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]