কত কথা জমিয়ে রেখেছিলাম তোমাকে বলব বলে...

আমার প্রবাসী বাবা, তুমি যখন আমার বয়সী একজন তরুণ, জীবিকার তাগিদে চলে গেলে সেই মরুর দেশে। সেই থেকে শুরু হলো তোমার সংগ্রাম। রক্ত পানি করা শ্রমের আয় দিয়ে আমাদের জীবন স্বয়ংসম্পূর্ণ করে রেখেছ সব সময়। মেয়ে হয়ে জন্মানো নিয়ে আফসোস হত দাওনি কখনো। ছোটবেলায় তুমি যখন দেশে ফিরতে বা আমরা তোমার কাছে যেতাম, সেই সময়গুলোতে সুযোগ পেয়েছি তোমার ভালোবাসা আর যত্ন পাওয়ার।

হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম যখন কেমন একটা দূরত্ব চলে এল তোমার সঙ্গে। আগের মতো আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ হয় না আর। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শুরু করার পর তো তোমার সঙ্গে দেখা হয় তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময় আর হয়তো দু–এক দিন বাড়িতে থাকলে, তখন। গত বছরের শেষ দিকে দেশে এলে, এক দিনই দেখা হলো কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় আর দেখা হলো না। যাওয়ার আগের দিন ফোন করে জিজ্ঞেস করলে, ‘অদিতি, তুমি কি কালকে বাসায় আসবা?’ আমি বললাম,‘না তো, ক্লাস আছে। কেন আব্বু, কিছু লাগবে তোমার?’ তুমি বললা, ‘না, মা। এমনি।’ পরদিন ফোন করে জানতে পারলাম, কিছুক্ষণ পর তোমার ফ্লাইট। কেন যেন অপরাধবোধ হচ্ছিল খুব। তোমাকে ফোন করে সরি বলছিলাম বারবার। কতবার তোমাকে বললাম, কেন বললে না যে কাল তোমার ফ্লাইট, সব কাজ ছেড়ে আমি চলে যেতাম। তুমি কেঁদে ফেলে বললে, ‘মা, আমি শুধু চাই তুমি পড়াশোনা করো ঠিকমতো।’ তুমি তো কখনো যাওয়ার সময় এভাবে কাঁদো না। ফোন রেখে খুব কাঁদলাম, ওই দিন ঠিক করলাম, পরেরবার যখন তুমি দেশে আসবে, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গেই থাকব। রান্না করে খাওয়াব। কখনো তো চা বানিয়ে খাওয়ানোর আবদারটাও করোনি। তাই এবার ফিরলে তুমি যা খেতে চাও সব রান্না করে খাওয়াব, কারণ তোমার ছোট মেয়ে শুধু এই কাজটাই ভালো শিখেছে। আমি হব তোমার ফুল টাইম বাবুর্চি। বেতন দেওয়া লাগবে না।

>আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম, বড় আপুর পেছনে কয়েকজন লোক তোমার সাদা কফিনটাকে ধরে নিয়ে আসছে। কী আশ্চর্য! আমি দুপায়ে শক্তি পাচ্ছি না! আমি তো নিজেকে সারা রাস্তা বোঝাচ্ছিলাম, খুব শক্ত থাকতে হবে এখন। এত অবুঝ হয়ে গেলাম কেন হঠাৎ আমি! বাসায় ফিরছি তোমাকে নিয়ে। আমাদের সামনের গাড়িটাই তোমার, পেছনে লেখা ‘লাশবাহী গাড়ি’।

৩১ মে, ২০২০। ভোর রাতে তোমার ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। বড় আপু, আমি, ফুফাতো ভাই আর একটা মামা বের হলাম মাঝরাতে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। রাস্তা যেন শেষই হয় না। দাঁড়িয়ে আছি তোমার অপেক্ষায়। অবশেষে তুমি বের হলে। গতবার তো বের হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলে।

এবার আর ধরলে না। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম, বড় আপুর পেছনে কয়েকজন লোক তোমার সাদা কফিনটাকে ধরে নিয়ে আসছে। কী আশ্চর্য! আমি দুপায়ে শক্তি পাচ্ছি না! আমি তো নিজেকে সারা রাস্তা বোঝাচ্ছিলাম, খুব শক্ত থাকতে হবে এখন। এত অবুঝ হয়ে গেলাম কেন হঠাৎ আমি! বাসায় ফিরছি তোমাকে নিয়ে। আমাদের সামনের গাড়িটাই তোমার, পেছনে লেখা ‘লাশবাহী গাড়ি’, অসহ্য বিকট আওয়াজ করে ছুটে যাচ্ছে তোমাকে নিয়ে সেই চেনা রাস্তা দিয়ে। গতবারের মতো আমার বকবক শুনতে শুনতে যেতে হচ্ছে না তোমাকে। আমার হাতে তোমার ডেথ সার্টিফিকেট। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। পুরো রোজার মাসটা তুমি যুদ্ধ করেছ আইসিইউতে। করোনা সন্দেহে তোমার চিকিৎসা চলছিল। ঈদের দিন খবর পেলাম, তুমি আর নেই। শেষ রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ ছিল। তুমি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে এবার অবসর নিয়ে একেবারে দেশে ফিরে আসবে। বিশ্রাম নেবে মনভরে। কিন্তু জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সংগ্রাম করেই গেলে। ভেন্টিলেশন শুরু হওয়ার আগে শেষবার আমাকে বললে, ‘সাবধানে থাকবা’। কিন্তু আব্বু, আমার তো আর বলাই হলো না, কত কথা যে জমিয়ে রেখেছিলাম তোমাকে বলব বলে...

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]