প্রিয় বাবা

লেখিকা
লেখিকা

ডায়েরিতে প্রথম বাবাকে লেখা চিঠি। দুঃখের বোধনে আমার প্রথম দীর্ঘশ্বাস।

প্রিয় বাবা,
কেমন আছ তুমি? কোথায় আছ জানতে পারলে সুবিধা হয়, তাহলে এই চিঠিটা পোস্ট করা যেত। আমি বিশেষ ভালো নেই। আজ চার দিন হলো তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে। আমি তোমার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলতে পারিনি। আমাদের আনুষ্ঠানিক ‘শেষ কথা’ বলে কোনো কথা রইল না।

আমি আজকে সকালে হোস্টেলে চলে এসেছি। পরশু আমার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। তুমি নিশ্চয়ই চাইতে না, আমি পরীক্ষা না দিয়ে বাসায় থাকি। আমার কেমন একলা একলা লাগছে। মাকে বাসায় রেখে এলাম। বাসায় অনেক মানুষজনে ঘর বোঝাই। আমি হোস্টেলে এসে যেন নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা পেলাম। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।

আমাকে জানানো হয়নি প্রথমে। আমাকে বলা হয়েছিল, তুমি আরও অসুস্থ হয়েছ, তাই ঢাকা নিয়ে আসবে। তোমায় যেন একবার গিয়ে দেখে আসি। আমি খবরটা শুনে স্কুল ড্রেস পরেই ওই অবস্থায় চলে আসি। বাসার সামনে মানুষের ভিড় দেখে আমি সমস্তই বুঝতে পেরেছিলাম। এরপর আর কিছু ঠিকঠাক মনে করতে পারি না।

বিকেলে আমি চুপচাপ বারান্দার এক কোনায় বসে। তখনো সবুজ জামা আর সাদা ওড়না জড়ানো স্কুলড্রেস পরা। দেখছিলাম, দূরে আকাশে কালো কালো ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নারকেল গাছের পাতাগুলো ভয়াবহ আগুনের তাতে পুড়ে যাচ্ছে। ওই ধোঁয়ায় করে তুমি ভেসে যাচ্ছিলে, কোথায় কে জানে! হঠাৎ করেই আর সবাই যেন আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হামলে পড়ল। কেউ কী জানে না, যে দুঃখটা চিরস্থায়ী তা কোনোভাবে, পৃথিবীর আর কোনো কিছুতেই ভোলানো যায় না। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না এই শোকের গভীরতা কতখানি।

সকালে আমি হোস্টেলে ফিরেছি শুনে কিছুক্ষণের মধ্য আমার রুমে মেয়েরা সব ছুটে চলে এসেছে। আমাকে দেখতে চলে এসেছে। যারা কোনো দিন আমার সঙ্গে কথা বলেনি বা প্রয়োজন হয়নি কথা বলবার, চোখের দেখায় পরিচিত এই মুখগুলো আজ আমার চারপাশে ভিড় করে আছে। আচ্ছা বলতো, বাবা মারা গেলে কী মেয়েকে এমন করে দেখতে আসতে হয়? আমি যে প্রচণ্ড অসহায় হয়ে গেছি তোমাকে ছাড়া, সেটাই যেন আরও একবার আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো হঠাৎ আদরের আয়োজনে!

সত্যি করে, আমার একটু লুকোবার জায়গা প্রয়োজন ছিল। আমার একার একটু সময় প্রয়োজন ছিল সবকিছু বুঝে উঠতে। আমার এমন একটা খবরে সবাই যে ছুটে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা যে মেনে নিতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে সেটা কে বুঝবে! যে মেয়েটা আমাকে একদম পছন্দ করে না, সেও আজ আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে। কী জানি, আজ আমার দুঃখটা হয়তো সবকিছুর থেকে সবচেয়ে গভীর।

আমি বুঝতে পারছি না এখনো আমার কতটা হারিয়েছে, কতটা এর গভীরতা, আমি বুঝতেই পারছি না। তোমার শেষবারের মতো লেখা কলমটার কালি রয়ে গেছে, আর হাতঘড়িটাও টিক টিক করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘড়িটার যাকে ঠিকঠাক সময় দেখাবার কথা সে যে সময়ের অতলে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে...এই ঘড়ি, এই কলম, লেখার খাতায় আর তার যে কোনো প্রয়োজন নেই সেটা হুট করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। ভেব না, বইগুলো যেমন ভাঁজ করে রেখেছিলে, এখনো তেমনই রাখা আছে। ধুলো জমছে ধীরে ধীরে বইগুলোতে। আচ্ছা বাবা, একদিন কী আমাদের স্মৃতির ওপরও কী ধুলো জমে যাবে? পিতা-কন্যার যে জীবনটা এক সাথে যাপন করা হলো না, সেটা আর কোনো অনুরণন জাগাবে না স্মৃতিতে? সত্যি...?

তোমার আদরের

বাবু।