একটি দুর্ঘটনা ও আব্বু

১৮ জানুয়ারি ২০১৭, অনার্স ২য় বর্ষ পরীক্ষা চলছে।

ভোর থেকে পড়তে পড়তে সকাল সাড়ে নয়টায় পরীক্ষা দিতে গেলাম।
প্রশ্ন পেয়ে সব পরিচিত লাগল। কিন্তু কেন জানি পরীক্ষার খাতায় কিছুই লিখতে পারলাম না। বারবার চেষ্টা করছিলাম লেখার, হয়ে উঠল না।
৪ ঘণ্টার পরীক্ষায় ২ ঘণ্টায় খাতা জমা দিয়ে বাসায় চলে এলাম। আর অজানা একটা ভয় কাজ করছিল। বাসায় এসেই প্রথমে নিজের মোবাইল ফোন চেক করলাম। দেখলাম যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, তা-ই ঘটেছে, ৫০টি মিসড কল!

সবার আগে খুঁজে দেখলাম আমার আব্বুর কল কই। নেই, আব্বুর কল নেই। বিষয়টা তখনই পরিষ্কার। হাত এমনভাবে কাঁপছিল যে আমি আম্মুকে কল দিতে পারছিলাম না।

আম্মুকে কল দিতেই বললাম, আম্মু, আপনি কই, আব্বু কই। আম্মু তখন বাসে সিলেটে আসছেন। আমাকে বললেন, ওসমানী মেডিকেল কলেজে একবার যাও, তোমার আব্বু ছোট্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন, পরিচিতরা সিলেট নিয়ে গেছেন। আমি আসছি। আমার তখন মাথায় যেন বাজ পড়ল, টাকার ব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ে গেলাম।

গিয়ে দেখলাম, আব্বু রক্তাক্ত। তাঁর আঙুল একটি নেই, মাথায় রক্ত।

এটা দেখার পর হয়তো পৃথিবীর কোনো সন্তান স্থির থাকতে পারে না। আমিও পারিনি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক তর্কবিতর্কের পর ওয়ার্ডে একটি সিট পাওয়া গেল। দুর্ঘটনার রোগী নাকি প্রাইভেট হাসপাতালে নেওয়া হয় না পুলিশ কেসের জন্য। তাই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। সেদিন আমি কেমন পাগল হয়ে আব্বুর জন্য ওয়ার্ডে একটি সিটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছি, তা আমিই জানি। তবু সিট পাওয়া যাচ্ছিল না।

আর আমার বাবা সেই রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, আমি কেন মেয়ে হলাম, কেন ছেলে হলাম না।

তারপর প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর সিট পেলেও টাকা গুনতে হয়েছিল বেশ। সিট তো পাওয়া গেল, এখন চিকিৎসা?

ডাক্তার কখন রাউন্ড দেবেন, কখন আসবেন কে জানে। আব্বু ডায়াবেটিস রোগী। তাঁকে কী খেতে দেব, না দেব, তাও বুঝিনি। আম্মু এলেন। আব্বুকে ধরে নিয়ে কাপড় বদলিয়ে খেতে দিলেন। সেদিন পুরো হাসপাতালে আমার আত্মীয় বলতে কেউ নেই। আমি, আব্বু, আম্মু।

>আব্বুর মুখে সেদিন যা শুনেছি তা মনে একেবারে গেঁথে নিয়েছি। আব্বু তাঁদের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েই ১০০ ছেলের সমান। আর আমি মেয়ে জন্ম দিইনি, শুধু মানুষ জন্ম দিয়েছি।

ডাক্তারের কোনো দেখা নেই। বুঝতে পারছিলাম আব্বুর যন্ত্রণা। নিজের অসহায় সময়ে খুব কম মানুষকে পাশে পাওয়া যায়। আমিও পাইনি। হঠাৎ ওসমানী মেডিকেলে দুই বন্ধুর কথা মনে পড়ল। তাদের বলতেই তারা চলে এল। তাদের স্যারের কাছে নিয়ে গেল। শিক্ষার্থীর কথার জন্য স্যার সেদিনই রাতে আব্বুর অপারেশন করলেন। অপারেশন শুরু হওয়ার আগে ডাক্তার আমাদের সঙ্গে পুরুষ কে আছেন খুঁজলেন। আমি এগিয়ে গেলাম এবং বললাম পুরুষ নেই, তবে আমি আছি। বলুন আমাকে। স্যার কিছুটা অবাক হলেন। তারপর বুঝিয়ে দিলেন, কী কী করতে হবে, কী কী আনতে হবে। সব করলাম। দুই ঘণ্টার অপারেশনে আব্বুর সেই কেটে পড়ে যাওয়া আঙুল একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। অপারেশন শেষ হওয়ার পর ওয়ার্ডে এলেন।

এই মুহূর্তগুলো আমার কাছে জীবনের সব থেকে কঠিন সময় ছিল। পাশে কেউ ছিল না। তবে কঠিন সময় যাওয়ার পর অনেকেই এলেন। দেখা করলেন, সমবেদনা জানালেন। মনে মনে কিছুটা হাসিও পাচ্ছিল অবশ্য।

আব্বুকে বাসায় নিয়ে আসা হলো ডাক্তারের পরামর্শমতো। জানেন, তখন কিছু আত্মীয়স্বজনের মুখে শোনা গিয়েছিল, ‘ইশসসস, তোমার যদি একটা ছেলে থাকত। তাহলে কি আর তোমাকে এখনো এত দূর গিয়ে চাকরি করতে হয়। ছেলেটাই সব সামলে নিত। মেয়ে তো বিয়ে দিয়েই শেষ।’

আব্বুর মুখে সেদিন যা শুনেছি তা মনে একেবারে গেঁথে নিয়েছি। আব্বু তাঁদের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েই ১০০ ছেলের সমান। আর আমি মেয়ে জন্ম দিইনি, শুধু মানুষ জন্ম দিয়েছি।’

আব্বুর ওই কথার পর চোখের পানি লুকিয়ে আমি কেবল তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

কখনো সম্ভব হয়নি আব্বুকে খুব জোরে ধরে বলা, আব্বু, তোমাকে ভালোবাসি। এসব কখনোই পারব না। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ফেসবুকিং শিখিয়ে দিই, সকাল-বিকেলের ওষুধ, ইনসুলিন এগিয়ে দিই, একটু পরপর চা বানিয়ে দিই, গোসলের পর কাপড়টা ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে দিই, প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রিয় নাশতা বানিয়ে খাওয়াই, আব্বুর সঙ্গে বাজারে যাই, বাজারের ব্যাগটা নিজেই বহন করি, বাইরে থেকে এলে দৌড়ে গিয়ে আব্বুর গায়ের ঘামের গন্ধ নিই, নিজের অর্জিত প্রথম টাকা আব্বুর হাতে তুলে দিই।

আমার কাছে এসবই আব্বুর জন্য আমার ভালোবাসা। আব্বুও যেমন বলতে পারেন না ভালোবাসেন কতটুকু, আমিও পারি না।

আসলে ভালোবাসার এই প্রকাশটুকু অপ্রকাশিত থাকাই যে সব থেকে আনন্দের।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]