দেখা না-দেখা

অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসা, শিগগিরই আবার ফিরে যেতে হবে আমাকে। এয়ারপোর্টে নেমে তাই আর দেরি করিনি। সময় কোথায় সময় নষ্ট করার? এদিক–ওদিক না ঘুরে সোজা বাসায়, আব্বার বিছানার পাশে। নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছেন আব্বা, নিশ্বাসের মৃদু ওঠানামা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ নেই জীবনের। একটা হাত অসহায় পড়ে আছে বালিশের ওপর। আমি হাত বাড়িয়ে আব্বার হাতটা ধরি। ছেলেদের হাত হিসেবে ঈর্ষণীয় সুন্দর আব্বার হাত, এখনো। তার পাশে আমার গোলগাল হাতটা নিখুঁত শিল্পের পাশে আনাড়ির হাতের কাজের মতো লাগে। আব্বার কানের কাছে মুখ নিয়ে আমি খুব সাবধানে বলি, ‘আব্বা, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।’ আব্বা নির্বিকার শুয়ে থাকেন, উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ঘরের ভেতর বেশ কিছু পরিচিত–অপরিচিত মুখ, আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প’ এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ছুটে এসেছি আমি। হয়তো কোন নাটকীয় প্রতিক্রিয়া আশা করে আমার কাছে। আমি সবাইকে বোধ হয় হতাশ করেই বলি, ‘গরম পানি হবে, আমি গোসল করব?’ গোসল, খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে বিকেল গড়িয়ে যায়। আব্বার মাথার কাছে এসে বসি। বিকেলের ঘন রোদ পর্দার ফাঁক দিয়ে বাঁকা হয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে, গাঢ় মধুর মতো রং। মনে হয় ছুঁয়ে দিলে আঠা লেগে যাবে হাতে। আমি হাত বাড়িয়ে আব্বার কপালে হাত রাখি। ফিসফিস করে ডাকতে থাকি, ‘আব্বা…আব্বা…আব্বা…’

আব্বার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে। মনে হয় যেন চোখ মেলার প্রাণপণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু আমি হাল ছাড়ি না, ডাকতেই থাকি। একসময় বুঝি, আমার ডাকগুলো শেষ পর্যন্ত কোথাও পৌঁছায় না, ঘরের ভেতর শূন্যে ঘুরপাক খেতে থাকে অনবরত।

ডাক্তার আসেন আব্বাকে দেখতে। পাশে বসে আমি জেট ল্যাগে ঢুলতে থাকি। ডাক্তার নিচু স্বরে একটানা বলে যেতে থাকেন, এই যে উনার ক্রিয়েটিনিন এত হাই, শেষ স্টেজের গ্লুকোমা, ডিমেনশিয়া, হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে…আবার জ্বর কেন এল…বোঝা যাচ্ছে না…আমার বিরক্ত লাগতে থাকে এই একঘেয়ে বিশদ বর্ণনায়।

বের হওয়ার মুখে ডাক্তার ‘কাহানি মে টুইস্ট’-এর মতো বলে যান, আমার মনে হয়, ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে।

আব্বাকে আমরা নিয়ে যাই হাসপাতালে।

আমার ফিরে আসার সময় হু হু করে এগিয়ে আসে। আমি কাউকে ফোন দিই না, কারও সঙ্গে দেখা করি না। আব্বা আমাকে দেখতে চেয়েছেন, আমি শুধু আব্বার কাছে এসেছি। হাসপাতালে বসে থাকি আব্বার পাশে। আব্বাকে জানাতে পারি না, আমি এসেছি তাঁর কাছে। মনে হতে থাকে, একটা বন্ধ দরজায় প্রাণপণে কড়া নেড়ে যাচ্ছি অর্থহীন।

আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসপাতালের বিছানায় একদিন উঠে বসেন আব্বা। আমি ভিজিটিং আওয়ারে গিয়ে দেখি বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সিস্টার হাসিমুখে জানালেন, আব্বা নিজের হাতে নাশতা করেছেন সকালে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করি, আব্বা, তুমি চিনতে পারছ আমাকে? আব্বা তাঁর ঘষা কাচের মতো চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় বলেন, তোমার আম্মাকে বলো আমার চশমাটা দিতে।

গ্লুকোমায় প্রায়ান্ধ আব্বা চশমা ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন বছর পাঁচেক হলো, আর চশমা খুঁজে দেওয়ার মতো তুচ্ছ পার্থিব দায়দায়িত্ব ছেড়ে আম্মা চলে গেছেন আরও ১৩ বছর আগে। চশমাও নেই, আম্মাও নেই। আমি তাই বাকিটা সময় চুপচাপ বসে থাকি। আব্বার শরীর আবারো খারাপ হয়। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এমআরআই…চলতেই থাকে…ডাক্তাররা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। আব্বা জ্বর, ঘুম আর ওষুধের ঘোরে আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকেন হাসপাতালের বিছানায়; আর আমি আমার বাক্স–প্যাটরা নিয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

>আব্বার মাথার কাছে এসে বসি। বিকেলের ঘন রোদ পর্দার ফাঁক দিয়ে বাঁকা হয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে, গাঢ় মধুর মতো রং। মনে হয় ছুঁয়ে দিলে আঠা লেগে যাবে হাতে। আমি হাত বাড়িয়ে আব্বার কপালে হাত রাখি। ফিসফিস করে ডাকতে থাকি, ‘আব্বা…আব্বা…আব্বা…’

আব্বা, আমি চলে যাচ্ছি। সেই নিরুত্তর আব্বা, সেই বিছানায় পড়ে থাকা তাঁর নিরুত্তাপ হাত। আমি দুই হাতের মুঠোয় আব্বার হাতটা তুলে ঠোঁট ছোঁয়াই। মাটির মতো ঠান্ডা আব্বার হাত, কেমন রোদ না লাগা শেওলার মতো গন্ধ! বুকভরে নিশ্বাস নিই আমি, এই গন্ধটুকু কি থাকবে আমার স্মৃতিতে? আমার বোন এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে পেছন থেকে, দোয়া পড়ে ফুঁ দিতে দিতে উপসংহার টানার মতো বিষণ্ন গলায় বলে, আমি ফোন করব তোমাকে। মনে হয়, এ যাত্রায় এটাই বুঝি শেষ কথা, আর কোনো কিছু জানার নেই আমার। একটা ফোনের জন্য বুকভরা অপেক্ষা আর ভয় নিয়ে ফিরে আসি আমি।

অটোয়ায় পা রেখে মনে হয় একটা অভিশপ্ত শহরে ফিরে এসেছি! প্যাঁচপেঁচে বৃষ্টি, কাদা পানিতে ময়লা হয়ে যাওয়া জমে থাকা বরফের স্তূপ, ন্যাড়া মাথা গাছপালা আর শহরজুড়ে শুধু ঘন হয়ে জমে থাকা কুয়াশা। ধূসর বর্ণহীন হিমশীতল শহরে বসে বারবার শেষ বিকেলের গাঢ় রোদের কথা মনে পড়ে। অফিসের মিটিংয়ে মাথা নিচু করে আঁকিবুঁকি করি খাতার পাতাজুড়ে। আর আমার মনে হয়, এই কুয়াশার কিছুটা ঢুকে গেছে আমার মাথার ভেতরে।

মনোযোগ দিতে পারি না কোনকিছুতে। মাঝেমধ্যে মনে হতে থাকে মাথার ভেতর একটা বিষণ্ন এলাকায় জমাট বেঁধে আছে অলৌকিক কুয়াশা এবং তার ভেতর ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করছে শুধু একটা ফোন আসার অপেক্ষা।

আমিই ফোন করি প্রতিদিন। কোনো ভালো খবর পাই না। আমার জেট ল্যাগ কাটে না। বালিশের পাশে ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি চুপচাপ। জানি, একটা ফোন আসবে শিগগিরই। আর তারপর আমার জীবন বদলে যাবে আজীবনের জন্য।

আমি ধড়মড় করে উঠে বসি ফোনের শব্দে। রাত দুটো তিপান্ন। জানতাম ফোনটা এ রকম অসময়েই আসবে, অথবা জানি না এই ফোন আসার কোনো সঠিক সময় আছে কি না! দ্রুত হাতে ফোন ধরি আমি। ওপাশ থেকে বোনের পরিষ্কার গলা ভেসে আসে, কথা বল।

ফোনটা ধরেই আব্বা হাহাকার করে ওঠেন, আম্মা, আমার ছোট আম্মা! তোমাকে কত দিন দেখি না, কবে আসবা, আম্মা?

আমি টের পাই কুয়াশা সরে যাচ্ছে মাথার ভেতর থেকে, রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে আমার ওপর, ঘুমে চোখ ভেঙে আসে। আমি বলতে পারি না, আমি গিয়েছিলাম তোমাকে দেখতে, দেখা হয়নি। শুধু হাসতে হাসতে বলি, আমি আসব আব্বা, শিগগিরই আসব, দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

অটোয়া, কানাডা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]