বাবাকে লেখা আমার তৃতীয় চিঠি

প্রিয় বাবা,

কেমন আছো? তুমি আমাকে চিঠি লিখেছিলে চারটি, আর আমি মাত্র দুটি। তা–ও সেটা ২০০২ সালের কথা, যখন হলুদ খামে করে চিঠি পাঠাতে হতো। তখন আমি কলেজের হোস্টেলে দুই মাস হলো উঠেছি। আমার চিঠি লিখতে লজ্জা করত, কারণ সবাই মোবাইলে বাসায় কথা বলত। তার কদিন পর তুমিও একটা মোবাইল কিনে ফেললে, আমার জীবনে চিঠি লেখার ইতি ঘটে গেল।

এখনকার প্রজন্ম বোধ হয় হলুদ খাম চেনে না। ধন্যবাদ ‘প্রথম আলো’কে আবার চিঠি লেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তোমার পাঠানো আম খাচ্ছি আমরা, কিন্তু মন খারাপ হচ্ছে, যেহেতু করোনার জন্য এবার বাড়ি যাওয়া হলো না। কবে হবে, তা–ও জানি না। কী এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে আমাদের সবাইকে। আমি জানি, গ্রামের অনেকে কথা শোনায়, তাই তোমার মন খারাপ থাকে। তারা বলে, কী হলো মেয়েদের এত লেখাপড়া শিখিয়ে…। কোনো সরকারি চাকরি পেল না। চেষ্টা করেছি, পাইনি। হয়তো বিধাতা এটাই আমার জন্য রেখেছেন। বেসরকারি চাকরি করি, অনেক অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু তবুও তো ভালো আছি। আর সবাই তো সবকিছু পায় না। যতটুকু আছে তাই নিয়েই আমরা কত ভালো আছি দেখো।তা ছাড়া মানুষের কাজই শুধু কথা বলা। ভালো থাকলেও বলবে, মন্দ থাকলেও বলবে, সামনে বলবে, পেছনে বলবে। করোনাকালে তোমার জন্য চিন্তা হয়। জানি আমি সব কাজ ঘরের মধ্যে বসে করা যায় না, মাঠ থেকে ফসল তোলা যায় না, গাছ থেকে ফল পেড়ে আনা যায় না, পকুর থেকে মাছ তোলা যায় না। এ জন্যই তুমি বলো, এত সব কাজ তদারকি করার জন্য যখন আমাকে বেরোতেই হয়, তখন আর নামাজ কেন ঘরে পড়ব, মসজিদেই পড়ি। কিন্তু তবু আমি বলি, যত কম পারা যায়, তত কম বাইরে যাও। এ বছরটাই এমন!

>তুমি আমাকে চিঠি লিখেছিলে চারটি, আর আমি মাত্র দুটি। তা–ও সেটা ২০০২ সালের কথা, যখন হলুদ খামে করে চিঠি পাঠাতে হতো। তখন আমি কলেজের হোস্টেলে দুই মাস হলো উঠেছি। আমার চিঠি লিখতে লজ্জা করত, কারণ সবাই মোবাইলে বাসায় কথা বলত। তার কদিন পর তুমিও একটা মোবাইল কিনে ফেললে, আমার জীবনে চিঠি লেখার ইতি ঘটে গেল।

আমার বন্ধুদের দেখেছি, কোন বিপদ হলে, মাকে ফোন করে বলতে। কিন্তু আমি যখনই কোনো বিপদে পড়েছি, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি তোমায়, তুমি অভয় দিয়েছ, চিন্তা করিস না। খুব কম বাবাই আছে, যাদের সঙ্গে মনের দুঃখ-সুখে গল্প করা যায়। তুমি তাদের একজন। ধন্যবাদ তোমায়, আমাদের বাবা হওয়ার জন্য।

যখন ২০০২ সালে নর্থবেঙ্গল পেপার মিলস লিমিটেড বন্ধ হয়ে যায়, তখন কত পরিচিতজনের খারাপ খবর আমরা শুনেছি, কারও বাবা মারা গেছেন, কেউ পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি, কেউ কেউ বিপথে চলে গেছে। এর মাঝেও তোমার দুই মেয়েকে তুমি শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য সহায়তা দিয়ে গেছ, এটা আমাদের অনেক বড় পাওয়া, বাবা; অন্য কেউ হলে মাঝপথেই বিয়ে দিয়ে দিত। ২০০২ থেকে ২০২০ সাল, ১৮ বছর, অনেকটা সময়।

ভালো থেকো তুমি, ভালো থেকো তোমরা।

ইতি
তৃষ্ণামণি

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]