আব্বার নরটন সাইকেল

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের একটা করে সাইকেল থাকে, আর অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবারা ‘আব্বা’ হয়ে থাকে। আমার আব্বারও একটা সাইকেল ছিল, নরটন ব্র্যান্ডের সাইকেল। নরটন ব্র্যান্ডের সাইকেল এখন হয়তো আর নেই, এখন তো আব্বা তাঁর ৬৫ বছর বয়সে আর সাইকেলও চালান না।

তৎকালীন ৪০ ঊর্ধ্ব আব্বা অফিস করতেন নিয়মিত সাইকেলে চড়ে। সাইকেলের সামনের শিকলে দুপুরের খাবার নিয়ে তিনি রওনা হতেন গ্রাম পেরিয়ে মফস্বলের অফিসের দিকে। অফিস থেকে তিনি আর তাঁর সাইকেল যে শুধু ফিরত তা না, অফিস থেকে তিনি ফিরতেন মজার সব খাবার নিয়ে, আমের সময় রাজশাহীর বড় ফজলি আম আনতেন, আমরা সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম। কখনো ফিরতেন কোনো সারপ্রাইজ গিফট নিয়ে।

যে আব্বা সারা দিন বকা দিতেন কেন ক্রিকেট খেলি তা নিয়ে, সেই আব্বাই কোনো দিন হয়তো সুন্দর কোনো ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে হাজির হতেন, যে আব্বা বকা দিতেন উল্টাপাল্টা জুতা–প্যান্ট কেন পরতে হবে, সে আব্বাই ওয়েনব্রেনারের উঁচু সোলের জুতা নিয়ে হাজির হতেন। আব্বার ভালোবাসার অঙ্ক মেলানো যেত না। আব্বা নতুন ব্যাট এনেছেন আবার বলছেন খেলা যাবে না, এটার মানে কী? আসলে মানেটা আব্বা বলবেন না। কারণ আব্বা কখনো ছেলেকে বলতে পারবেন না যে যাও খেলে আসো, কিন্তু তিনি জানেন, ছেলের একটা সুন্দর ব্যাট লাগবে।

প্রায়ই নানা জায়গায় যেতাম আব্বার সঙ্গে, তাঁর সাইকেলে চেপে। এই ঘুরতে যাওয়ার খুশি আর অন্য কিছুতে পেতাম না। জীবনের শুরুর দিকে আব্বার সাইকেলের সামনে বসতাম। আব্বা একটা তোয়ালে রাখতেন তাঁর ছোট বাচ্চার জন্য, তোয়ালেতে পন্ডস পাউডারের মিষ্টি একটা গন্ধ থাকত। সেই তোয়ালের ওপরে বসে আব্বার বেইল বাজানো দেখতাম, দেখতাম সামনের মাটির রাস্তা, ভয় পেলে আব্বা ধরতেন আমাকে। এখন আম্মা মাঝে মাঝে বলেন, আব্বা যখন কোথাও যেতে চাইত কোনো কাজে, আমি সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন তো যুক্তি দিয়ে কিছু বলতে পারতাম না, কান্না করতাম আর বলতাম, নিয়ে যেতে হবেই, এখানে আর কোনো আলোচনার অবকাশ নেই।

যখন একটু বড় হলাম, সে সময় আব্বা তাঁর সাইকেলের পেছনের সিটে জায়গা দিলেন। তখন সেই পেছনের সিটটাকে মনে হতো স্কুলের একটা চেয়ার আর আব্বা হলেন টিচার। সেই সিটে বসার পরেই আব্বার লেকচার শুরু হতো। ওই অঙ্কের সূত্রটা বলো তো, টেন্স কয় প্রকার বলো। এসব আলোচনা ভালো লাগত না। ইচ্ছা হতো সেই সামনের শিকলই তো ভালো ছিল, আব্বা তখন এত লেকচার দিতেন না। কেন আচমকা বড় হলাম!

>মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের একটা করে সাইকেল থাকে, আর অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবারা ‘আব্বা’ হয়ে থাকে। আমার আব্বারও একটা সাইকেল ছিল, নরটন ব্র্যান্ডের সাইকেল। নরটন ব্র্যান্ডের সাইকেল এখন হয়তো আর নেই।

বড় হওয়ার পরেও আব্বা প্রায় সময়ই নিজের পছন্দেই কাপড়চোপড় কিনতেন আমাদের জন্য। তিনি সব সময় রঙিন কাপড় কিনতেন। তাঁকে যতই বলতাম, আমি কত আর লাল রঙের শার্ট পরব, ততবারই তাঁর একই জবাব, সাদামাটা কাপড় পরতে হবে না।

বড় হতে হতে একেবারে সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেলাম। তখন আর চাইলেও আব্বার সাইকেলে তাঁর সঙ্গে ওঠা যায় না, না সামনের শিকলে, না পেছনের সিটে। আব্বা আর তাঁর সাইকেল যেন আমাকে একদম দূরেই ঠেলে দিল। এ সময়েই আমি স্কুল হোস্টেলে চলে যাই, বাসা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের স্কুলে আব্বা প্রতিদিন বিকেলে খাবার নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এমন বাবা কোথাও কি পাওয়া যাবে, যিনি ছেলেকে হোস্টেলে দিয়েও প্রতিদিন নিজেই দেখতে আসেন?

হোস্টেলে পড়ার দিনগুলোতে আব্বা অফিস শেষ করে প্রতিদিন বিকেলে আমাকে আম্মার রান্না করা ভাত–মাংস খাওয়াতেন। আমি তখন চার বেলা খেতাম। আব্বা এসে পাশে বসতেন, ঘেমে যেতেন, তাঁর শরীরের চেনা গন্ধ বের হতো। যদিও মুখ ফুটে কখনো বলতাম না যে আব্বা কি অনেক ক্লান্ত? এসব কথা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা বলা যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের ‘ভালোবাসি’ কথাটাও হয়তো বলা যায় না। বলা যায় না অনেক কিছু।

আদতে বলা যে যায় না তা নয়, বলতে হয় না। কেন বলব? কেন বলতে হবে? যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড উৎসর্গ করেছেন সন্তানদের জন্য, তাঁকে ভালোবাসি কীভাবে বলতে হয়, আমার আদৌ জানা নেই।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]