আমি 'হাত' পেতে রই...

করোনাকালে নিরন্ন মানুষের অসহায় চোখ অনেক কথা বলে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
করোনাকালে নিরন্ন মানুষের অসহায় চোখ অনেক কথা বলে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

কবিগুরু আমায় ক্ষমা করবেন; আপনার গানে শব্দ বিয়োগ-যোগের জন্য। কিন্তু সময় আজ ‘কান’ কেড়ে নিয়েছে। সেখানে ‘হাত’ বসিয়ে দিয়েছে। কান পেতে কষ্ট যে আর কেউ শোনে না! তাই অভাজনদের এখন আশা, চোখে কি দেখে? দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষায় তাই হাত নেমেছে।

সবে রাস্তায় নেমেছিলাম। না, না, এই রাস্তায় নামাকে জীবনসংগ্রাম বোঝায় না। কিছুটা শৌখিন, কিছুটা জীবিকা মেটানোর দায়। একেবারে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামা এটি নয়। তাই চারপাশে চোখ যায়। চোখ বোলাতে বোলাতে রাস্তায় হাঁটা হয়। অবশ্য বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামা মানুষদের সঙ্গে চোখাচোখিও হয়। অনেক চোখে প্রশ্নের দেখা মেলে। উত্তর দিতে আমার চোখ ব্যগ্র থাকে না। কখনো কখনো উত্তর থাকেও না।

হাঁটার সময় চতুর্দিক থেকে ভেসে আসে নানা অনুনয়। বেশি দূর এগোনো যায় না। সবাই সাহায্যপ্রার্থী। কেউ কিছু টাকা চায়, কারও আবার দুমুঠো ভাত কিনে দেওয়ার অনুরোধ থাকে। কখনো দুই কান শোনে, তখন কিছু টাকা দেওয়া হয়। আবার কখনো আমরা বধির হয়ে যাই, ইচ্ছে করেই। সব সময় কি আর ট্যাঁকে শুধু টাকা থাকে? আবার মাঝেমধ্যে তাতে থাকে ভয়, আশঙ্কা থাকে। সেই সর্বগ্রাসী ভয়ে আমরা কখনো অন্ধ হই, কখনো বোবা, কখনো কালা। আর তাতেই হয়তো কেউ না খেয়ে থাকে, কারও হয়তো রাস্তায় ধুঁকে ধুঁকে হাঁটার কাল দীর্ঘ হয়।

>হাঁটার সময় চতুর্দিক থেকে ভেসে আসে নানা অনুনয়। বেশি দূর এগোনো যায় না। সবাই সাহায্যপ্রার্থী। কেউ কিছু টাকা চায়, কারও আবার দুমুঠো ভাত কিনে দেওয়ার অনুরোধ থাকে। কখনো দুই কান শোনে, তখন কিছু টাকা দেওয়া হয়। আবার কখনো আমরা বধির হয়ে যাই, ইচ্ছে করেই। সব সময় কি আর ট্যাঁকে শুধু টাকা থাকে? আবার মাঝেমধ্যে তাতে থাকে ভয়, আশঙ্কা থাকে। সেই সর্বগ্রাসী ভয়ে আমরা কখনো অন্ধ হই, কখনো বোবা, কখনো কালা।

এমনই এক দিনে রাস্তায় একজন শার্ট-প্যান্ট পরা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শার্ট-প্যান্ট থাকলেও, তা ছিল ময়লা ও ধূসর। সেই ধূসরতা শুধু মলিনতাকে নির্দেশ করে। শার্ট-প্যান্ট ছিল খুবই ঢোলা। বুঝতে পারছিলাম, আমার মতো দরজির দোকানে শরীরের মাপ দিয়ে তা বানানো হয়নি। কেনা হয়েছে সস্তার দোকান থেকে, সেকেন্ড হ্যান্ড। হয়তো কখনো শখ হয়েছিল, কিনেছিলেন জমানো সঞ্চয় দিয়ে, অন্যের মাপে তৈরি পোশাক। হয়তো অনেক ছেঁড়া-ফাটা ছিল, হয়তো কেউ রিফু করে দিয়েছে। তিনি কিছু টাকা চাইছিলেন ভাত খাওয়ার জন্য। কেউ দিচ্ছিল না। তাই দেখে আমিও এড়িয়ে গেলাম। একে তো মাসের শেষ, তার ওপর মানিব্যাগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজারে থাকা ভয়-শঙ্কা। একেবারে কুঁকড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাই শেষমেশ এড়িয়েই গিয়েছিলাম।

কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরও ফিরে আসতে হলো। এক অনুচ্চার কিন্তু গগনবিদারী কান্না ততক্ষণে সুর তুলেছে যে। সেই সুরের পরতে পরতে বিষাদ, আছে খিদের জ্বালা। ওই জ্বালা অনুভব করতে পারি কিছুটা দূর থেকেও। খিদে যে আমারও লাগে।

বেশি দেওয়া হয় না। তবে তাতে এক বেলার ভাত হয় পেটপুরে। তাতেই কান্না বন্ধ হয়। তিনি আর থাকেননি সেই রাস্তায়, দ্রুত লয়ে, হয়তো খিদের তাড়ায় চলে যান ভাতের খোঁজে। চেয়ে রই আমি। ভাবি, ওই হাত যদি একদিন আমার হয়? মানিব্যাগে জমা হয়ে থাকা সব ভয় উপচে পড়ে নিজের মাথায়। শঙ্কা আর হাঁটতে দেয় না। থমকে দাঁড়িয়ে দেখি তাঁর চলে যাওয়া, আর ভাবি, তবে কি একদিন এই রাস্তায় আমিও...! নাহ, আর ভাবা হয় না। মাথাটা কেমন চক্কর দেয়। রোদে নাকি বৃষ্টিতে—বোঝা যায় না।

এমন অবস্থার জন্য শুধু কি সময়ই দায়ী? নাহ। সাদা কঙ্কাল ঠাওর হচ্ছিল, সময় শুধু চামড়া-মাংস সরিয়ে নিয়েছে। ‘হাত’ পেতে থাকা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমার শুধু হাড়-হাড্ডিই ছিল, গোশত সব কসাইরা নিয়ে গেছে।

দিন দিন বাড়ছে অভাবী মানুষের সারি। ঢাকার জাহাঙ্গীর গেটের সামনে এক অভাবী মা আর শিশুর খাবার গ্রহণ। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
দিন দিন বাড়ছে অভাবী মানুষের সারি। ঢাকার জাহাঙ্গীর গেটের সামনে এক অভাবী মা আর শিশুর খাবার গ্রহণ। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এসব ভাবতে ভাবতে ভুলে যাই, কেন রাস্তায় নেমেছিলাম। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক। সেই মুখোশের নিচে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া আমার শঙ্কিত মুখাবয়ব কারও চোখ বুঝতে পারে না। আয়নায় না দেখেও শুধু আমিই বুঝি, কপালের এই যে ভাঁজ তা শুধু রোদের কারণে নয়।

হাঁটতে থাকি। কিছুদূর এগোতেই এগিয়ে আসে আরও হাত, পেতে রাখে আমার সামনে। আমি এড়িয়ে যাই। যেভাবে মানুষ খানাখন্দ এড়ায়, ঠিক সেভাবে। বুঝে যাই, এখন বোবা-কালা ও অন্ধ হওয়ায় সময়। কারণ ট্যাঁকে আর কড়ি তো নেই তেমন। যেটুকু আছে, তা যে লাগবে আমারই।

স্বার্থপর হতে তাই বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। দ্রুতই চোখ থেকে হারিয়ে যায় ক্লিষ্ট চেহারাগুলো। পেতে থাকা হাতের মালিকেরা বুঝে ফেলে আমার অন্ধত্ব। আর আমি তখন হাত পেতে কিছু পাওয়ার আশায় রওনা দিই নির্দিষ্ট গন্তব্যে, যেখানে গতর খাটালেই মিলবে কিছু।

গন্তব্যে পৌঁছে আমিও ‘হাত’ পেতে রই...

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]