সমিরুল, আমরা কার কাছে যাব?

সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন প্রায়, সেই বার্তাটিই যেন দিতে চেয়েছিলেন এই ছবিতে। ছবি: সংগৃহীত
সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন প্রায়, সেই বার্তাটিই যেন দিতে চেয়েছিলেন এই ছবিতে। ছবি: সংগৃহীত
গতকাল করোনা সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ অর্থোপেডিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সমিরুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যু কাঁদিয়েছে অনেককে। বর্তমানে চট্টগ্রামের আরও কয়েকজন চিকিৎসক করোনাক্রান্ত। এই প্রেক্ষাপটে এই লেখাটি লিখেছেন কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।

দুই কাঁধে আর বাহুসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম তাঁর চেম্বারে। একটা কাগজে নাম লিখে পাঠিয়েছিলাম। ডাক এল। একবার সেই কাগজের দিকে, আর একবার আমার ব্যথাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, কী সমস্যা? জানালাম আমার সমস্যার কথা। বললেন, লেখকদের এ সমস্যাটা প্রায়ই হয়, এর নাম ফ্রোজেন শোল্ডার। আমি যে একটু-আধটু লেখালেখি করি, এই প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষটা তার খোঁজও রাখেন দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। সেদিন চেম্বারের ব্যস্ততার মধ্যেও দেশের রাজনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছিল। ফি নিলেন না, হেসে বললেন, বিনা মূল্যে সংবাদপত্রে আপনার লেখা প্রায়ই পড়ি, কিছুটা মূল্য না হয় এভাবে পরিশোধ হলো।

সেই প্রথম আলাপ ডা. সমিরুল ইসলামের সঙ্গে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ অর্থোপেডিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এক দিনের আলাপে মানুষ এমন আত্মীয়ের মতো হয়ে যান জানতাম না। সব মিলিয়ে দেখা হয়েছে দু-তিনবার, কিন্তু নানা সময়ে পরিচিত লোকজন তাঁর চেম্বার ঘুরে এসে জানিয়েছেন, আমার কুশল জানতে চেয়েছেন তিনি, সর্বশেষ আমার কোন লেখাটা পড়েছেন তা-ও জানিয়েছেন। ভেবেছিলাম এই বিরল বিনয় শুধু আমার ক্ষেত্রেই, কিন্তু না, গতকাল যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কত মানুষ যে সমিরুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের কথা লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। চট্টগ্রামের মানুষের শোকার্ত উচ্চারণে এই চিকিৎসকের প্রকৃত চেহারাটা যেন নতুন করে দেখা হলো। মানুষের জীবনে মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে! সেটা পেয়েছেন সমিরুল। বড় আক্ষেপ, চলে যাওয়ার জন্য ৫০ থেকে ৫২ বছর বয়সটা এমন সম্ভাবনাময় একটা মানুষের জন্য নেহাত অল্প সময়। বন্ধু, সহকর্মী, রোগী, ছাত্রছাত্রী—সবাই তাই অঝোরে কেঁদেছেন এ মানুষটির জন্য।

করোনাকালে যে সম্মুখসারির যোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে নিজের কর্মক্ষেত্র সরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, সমিরুল তাঁদেরই একজন। নিজের চেম্বার বন্ধ বলে তাঁর নিয়মিত রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখাশোনা করেছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন বিনা মূল্যে। এমন লোকটিই শেষ পর্যন্ত শিকার হলেন করোনার! চিকিৎসক বন্ধু-সহকর্মীরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। চট্টগ্রামে প্রথম প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সুস্থ বোধ করেছিলেন বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু গতকাল হঠাৎ করেই তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা যায়। এরপর সব রকম চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায়নি তাঁকে। সমিরুলের চিকিৎসক স্ত্রী ও তাঁদের দুই সন্তানের যে বিয়োগব্যথা, তার সঙ্গে হয়তো তুলনীয় নয় কিছুই, কিন্তু আমরাও কি ভুলতে পারব আমাদের একজন সমিরুল ছিলেন!

সমিরুলের মৃত্যু বড় স্বার্থপরের মতো যে প্রশ্নটির সামনে এনে দাঁড় করাল আমাদের, তা হচ্ছে রোগে-শোকে তাহলে কার কাছে যাব আমরা? চিকিৎসাসেবাকে যারা শুধু অর্থোপার্জনের উপায় হিসেবে দেখেননি, এই অতিমারির দিনে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে, তাঁরাই যদি সুরক্ষা না পান, তাহলে আমরা কোথায় পাব আশা ও আশ্রয়?

সমিরুলের মৃত্যু বড় স্বার্থপরের মতো যে প্রশ্নটির সামনে এনে দাঁড় করাল আমাদের, তা হচ্ছে রোগে-শোকে তাহলে কার কাছে যাব আমরা? চিকিৎসাসেবাকে যাঁরা শুধু অর্থোপার্জনের উপায় হিসেবে দেখেননি, এই অতিমারির দিনে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে, তাঁরাই যদি সুরক্ষা না পান, তাহলে আমরা কোথায় পাব আশা ও আশ্রয়?

প্রশ্নটি উঠল, কারণ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখনো কাতরাচ্ছেন নীলকান্ত ভট্টাচার্য, সন্দীপন দাশ, অনীক চন্দের মতো চিকিৎসকেরা। অসুস্থ হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে আছেন ডা. তাহমিনা বানু।

প্রিয় কর্মস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আঙিনায় বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে (বাঁ থেকে তৃতীয়) সমিরুল। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় কর্মস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আঙিনায় বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে (বাঁ থেকে তৃতীয়) সমিরুল। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম শহরের শিল্পী-লেখক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য সন্দীপনের দুয়ার ছিল সর্বদা উন্মুক্ত। চিকিৎসক পরিচয়ের বাইরেও তাঁর একটি পরিচয় আছে। বেহালা বাজান তিনি, নগরে একক বেহালাবাদন অনুষ্ঠানও হয়েছে তাঁর। এই শিল্পীসত্তার কারণেই সেবাপরায়ণতা যতটা, অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়টি নিয়ে ততটা মনোযোগী হননি কোনো দিন। এত মানুষের উদ্বেগ তাঁকে ঘিরে, অথচ চিকিৎসক স্ত্রী ছাড়া এখন তাঁর কাছে যে কেউ যাবেন, তার উপায়ও তো নেই। এতটাই অসহায় আজ আমরা।

তাহমিনা বানু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগটিকে এমনই মাতৃস্নেহে সাজিয়েছিলেন যে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। পেশার প্রতি সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকতে গিয়ে কেউ কেউ এভাবে জড়িয়ে পড়েন অন্য রকম বন্ধনে। সবার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে না, এখানেই তাহমিনা বানু আলাদা একজন।

প্রবীণ নীলকান্ত ভট্টাচার্য আর নবীন অনীক চন্দ এই দুর্দিনে রোগীদের পাশে ছিলেন বলেই আক্রান্ত হয়েছেন। মানুষের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও মমতার প্রতিদান আজ শুভকামনা হয়ে তাঁদের ঘিরে থাকুক। সমিরুলকে হারিয়েছি, হারিয়েছি আরও অনেক প্রিয় চিকিৎসককে। আর কোনো দুঃসংবাদ শুনতে চাই না। আমাদের প্রিয়জনেরা সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক আমাদের আশাও আশ্বাস হয়ে—এটাই আজ শত-সহস্র মানুষের প্রার্থনা।


অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]