আমাদের গ্রামের ছেলে নিমাই ভট্টাচার্য

নিমাই ভট্টাচার্য
নিমাই ভট্টাচার্য
গতকাল প্রয়াত হয়েছেন ‘মেমসাহেব’ খ্যাত কলকাতার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য। তাঁর বাস্তুভিটা ছিল পূর্ব বাংলায়, বর্তমান মাগুরা জেলার শরুশুনা গ্রামে। যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে নবম শ্রেণি অব্দি পড়েছিলেন তিনি। তাঁর গ্রাম, পড়াশোনা এবং এসব সূত্রে নিমাই ভট্টাচার্যের অনালোচিত ও অজানা অধ্যায়গুলো নতুন করে আলো পেয়েছে এই লেখায়।

বইটার নাম ‘জার্নালিস্টের জার্নাল’। ফুফাতো ভাই আহসানউল্লাহ এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে তিনি বললেন, ‘জানিস, নিমাই ভট্টাচার্য তোদের গ্রামের মানুষ!’

‘আমাদের গ্রামের মানুষ! নিমাই ভট্টাচার্য! আহসান ভাই বলেন কী!’

‘হ্যাঁ, তাঁর ভিটে তো এখনো আছে। কেউ থাকে না। কিন্তু ভিটে আছে।’

নিমাই যে আমাদের গ্রামের মানুষ, সে কথা সেই শৈশব–কৈশোরের সন্ধিক্ষণে, সত্তরের দশকের শেষ ভাগে জেনে যাই। আর সেটার পেছনেও থাকে একটা ছোট গল্প।

দুই.

সত্তর দশকের শেষ ভাগ!

নিমাই ভট্টাচার্যের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মেমসাহেব’
নিমাই ভট্টাচার্যের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মেমসাহেব’

কিছুদি ধরে আমরা ফুটপাতে একটা বই কেনার দোকান পেয়েছি মগবাজারে। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, জরাসন্ধ, নীহাররঞ্জন গুপ্ত নেশাটা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। একদিকে গোয়েন্দা, অন্যদিকে নর–নারীর ‘মেলোড্রামাটিক’ জীবনের প্রতি আকর্ষণ আমাদের শিশুমনকে অজানা আনন্দের দিকে ধাবিত করছে। বাংলামোটরের কাছে নিউ ইস্কাটনে থাকি। সেখান থেকেই হেঁটে বা রিকশায় করে মৌচাক মার্কেটের কাছে সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে যাই। স্কুলের পাশেই ছিল একই ক্লাসে পড়া বন্ধু রানার বাড়ি। এর আগে রানাদের পরিবার থাকত ৫ নং চামেলীবাগে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেই বাড়িতেই ছিলাম আমরা। এ বাড়ি থেকেই বর্তমান মাগুরা জেলার আড়পাড়ার শরুশুনা গ্রামের সন্তান ‘ইত্তেফাক’-এর তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর আলবদর সদস্যরা। আমরা নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে উঠলে রানাদের পরিবার সে বাড়ি ভাড়া নেয়। এরপর বাড়ি বদলে সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ির সামনে একটি বাড়িতে ওরা চলে আসে।

কয়েক বছর পর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয় রানাদের। ওরা গিয়ে ওঠে মগবাজারের একটি ভাড়া বাড়িতে। মগবাজার মোড় থেকে যে সরু রাস্তাটা নয়াটোলা–মধুবাগের দিকে চলে গেছে, সে পথে রেললাইন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই হাতের ডান দিকে একটা গলি। সে গলিপথে কিছুদূর এগোলে রানাদের বাড়ি। নিউ ইস্কাটন আর মগবাজারের দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায়, হয় আমাদের বাড়িতে, নয় রানাদের বাড়িতে আমাদের আড্ডা চলতে থাকে। বিকেলে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট ছিল অবধারিত।

মগবাজারে রানাদের বাড়ি যাওয়ার পেছনে একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। একটা ‘দরিদ্র’ রেস্তোরাঁর সামনে বিকেলের দিকে ততোধিক দরিদ্র এক ভদ্রলোক একটা চাদর পেতে তাতে বই নিয়ে বসতেন। আমরা তখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছি। পড়ার নেশায় পাগল। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনি। ‘তিমির পেটে কয়েক ঘণ্টা’, ‘লেবুমামার সপ্তকাণ্ড’, ‘ভীনদেশী এক বীরবল’, ‘নূলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’, অর্থাৎ ছোটদের বইগুলো পড়ে চলেছি। ঠিক এ সময় ফুটপাতের সেই শশ্রুমণ্ডিত দরিদ্র ভদ্রলোক আমাদের দৃষ্টা আকর্ষণ করলেন।

বইপত্র নাড়াচাড়া করতে দেখে তিনি একদিন বললেন, ‘বড়দের বই কিনতে চাও? আমার কাছে ছোটদের বই নাই।’

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘কিন্তু তোমরা বড়দের বই পড়তে পারো। আমার কাছে খুব ভালো ভালো বই আছে।’

সে তো আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাই। খুবই সস্তাদরের কোনো প্রকাশনালয় থেকে বের হওয়া পাইরেটেড বইগুলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। আমাদের আর্থিক সংগতি নেই বলে কিনতে পারি না।

‘শরুশুনা নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। যশোর থেকে বাবার সঙ্গে যখন ফিরতাম, তখন বাস থেকে নামতাম খাজুরায়। তারপর সেখান থেকে নারিকেলবাড়িয়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম শরুশুনা গ্রামে!’

বৃদ্ধ আবার বলেন, ‘“চিতা বহির্মান” নিতে পারো। খুব ভালো বই।’

বইটার প্রচ্ছদ দেখি। লেখা আছে, ‘চিতা বহ্নিমান’। ভদ্রলোকের উচ্চারণের ত্রুটি ধরিয়ে দিই না। কিন্তু বইটির পাশেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কিরীটি রায়’ সিরিজের একের পর এক বই দেখে লোভে পড়ে যাই। বইগুলোর দাম ছিল দুই থেকে ছয় টাকার মধ্যে। মোটামুটি ১৫০ পৃষ্ঠার মধ্যে নিউজপ্রিন্টে ছাপা বইগুলো পাওয়া যেত তিন টাকায়। টিফিনের পয়সা আর রিকশাভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে আমাদের ‘বড়দের বই’ পড়া শুরু হয়ে যায়।

একদিন তিনি একটা বই বের করে দেন থলে থেকে। বলেন, ‘এটা পড়ো। পড়ে ফেরত দিয়ো।’

কিনতে হবে না! পড়ার জন্য ধার দিচ্ছেন!

বইটার নাম ছিল ‘মেমসাহেব’। লেখক নিমাই ভট্টাচার্য!

তিন.

নিমাই, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন—নামগুলো বললে সাহিত্যবোদ্ধাদের অনেকেই নাক সিটকায়। আমি ভেবে দেখেছি, দস্তয়েভ্‌স্কি, তলস্তয়, ও হেনরি, মোপাসাঁ, চেখভ পড়ার পরও আগে যাঁদের নাম বললাম, তাঁদের লেখার প্রতি আমার আকর্ষণ একটুও কমে না। যে বয়সে ওঁরা আমার কাছে এসেছেন, সে বয়সে ওঁদের ভাবনা ও ভাষায় মুগ্ধ হয়েছি। কে কতটা উচ্চমার্গের লেখা লিখেছেন, তা নিয়ে বিচারে বসিনি। নিমাই ভট্টাচার্যকে আমরা ওই সব তত্ত্বজ্ঞানীর আলোচনায় ছেড়ে দেব না; বরং নিজের মতো করেই তাঁকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব।

‘জার্নালিস্টের জার্নাল’ বইটায় নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর দারিদ্র্যের কথা যে নিরাসক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। নামগোত্রহীন এক সস্তা পত্রিকার রিপোর্টারের প্রতি আশপাশের মানুষের অবহেলার গল্পটি তিনি এমন ভঙ্গিতে বলেছেন, যাতে তাঁর প্রতি যেন করুণা না হয়। এক শ টাকা মাইনের রিপোর্টার, যিনি দিল্লি থেকে আশি টাকা পাঠাচ্ছেন কলকাতায় থাকা পরিবারের জন্য, ২০ টাকা দিয়ে কায়ক্লেশে কাটিয়ে দিচ্ছেন সময়; তিনিই যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন প্রধানমন্ত্রীকন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে পাচ্ছেন স্নেহ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। পোশাকে–আশাকে ও চেহারায় দারিদ্র্য ফুটে ওঠা এই যুবককে দেখে যখন নেহরু জেনে নিলেন তাঁর আর্থিক অবস্থা, তখন সেটা বুঝতে দিলেন না নিমাইকে। শুধু নিজের সঙ্গে বসিয়ে কফি খাওয়ালেন, স্যান্ডউইচ খাওয়ালেন, এবং বলে দিলেন, এখন থেকে এই ছেলের অবাধ অধিকার থাকবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। দিনে এক বেলা খাওয়া নিমাইয়ের জন্য সে ছিল এক বিশাল ব্যাপার।

আরও একটি ব্যাপার সে বই থেকেই প্রথম জানা। বাঙালি স্বভাব। খুব ছোট এক পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন বলে দিল্লির বড় বড় বাঙালি সাংবাদিক নিমাইকে পাত্তাও দিতেন না। নিজেরা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন একে-অন্যকে, কিন্তু নিমাইয়ের দিকে ভ্রুক্ষেপও করতেন না। একদিন সংসদ অধিবেশন থেকে বের হয়ে অন্য সাংবাদিকদের এড়িয়ে নিমাইয়ের কাঁধে হাত রেখে কথা বলতে বলতে চললেন নেহরু। জানিয়ে দিলেন, ছেলেটা তাঁর খুব কাছের। এরপর থেকে নিমাইয়ের কদর বেড়ে গেল সাংবাদিক মহলে। জাতে উঠলেন নিমাই।

সাংবাদিক পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলে আমাকে বরং নিমাই ভট্টাচার্যের সাংবাদিক জীবনটাই আকর্ষণ করত বেশি। ‘মেমসাহেব’ থেকে উঠে এসে দোলা বৌদি যে কখনো কখনো মনের পক্ষপাত পেতেন না, তা সত্য নয়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘মেমসাহেব’ বইটি কীভাবে লেখা হলো, সত্যিই মেমসাহেব বলে কেউ ছিলেন কি না, সে প্রশ্নগুলো আগ্রহের জন্ম দিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সে উত্তরগুলো পেয়ে জানার ইচ্ছে মিটেছে। ১৯৭২ সালে উত্তম–অপর্ণা অভিনীত ‘মেমসাহেব’ চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনো চাইলে দেখে নেওয়া যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ছবিটি এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কেন যেন নিমাই আমার বেশি আপন হয়েছেন তাঁর সাংবাদিকতার বর্ণনা দিয়ে। এমনও হতে পারে, সেখানে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া মানুষদের দেখা পাই বলে আকর্ষণটা বেশি।

আলোচনার স্বার্থে আরেকটি তথ্য এখানে রেখে আমরা চলে যাব সেই আলোচনায়, যা আমাদের গ্রামের, যা আমাদের পারিবারিক স্মৃতি।

নিমাই ভট্টাচার্যের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রাজধানীর নেপথ্যে’, ‘রিপোর্টার’, ‘পার্লামেন্ট স্ট্রিট’, ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘কেরানি’, ‘ডার্লিং’, ‘নাচনি’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘পিকাডিলী সার্কাস’, ‘কয়েদী’, ‘জংশন’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘ম্যাডাম’, ‘ককটেল’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’। এ বইগুলোর কথাই বলেন সবাই। তবে আমরা যারা নিজেদের শরুশুনা গ্রামের সন্তান বলে দাবি করি, তারা এখানে আরেকটি বইকে জায়গা করে দিই, ‘সদরঘাট’। হ্যাঁ, এই বইটায় রয়েছে মাগুরা জেলার শরুশুনা গ্রামের কথা।

চার.

উইকিপিডিয়া কিংবা তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় অনেকেই নিমাই সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে যেতে পারবেন। আমি সে পথে হাঁটব না।

গতকাল পিয়াস মজিদের স্ট্যাটাসে যখন দেখলাম, নিমাই ভট্টাচার্য আর নেই, তখনই ফোন করলাম আহসান ভাইকে। আহসানউল্লাহ আমার ফুফাতো ভাই। দৈনিক ‘জনতা’র সম্পাদক। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় কাজ করেছেন দীর্ঘকাল। এককালে দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক। পুরোনো দিনের কথা বলতে পারেন নির্ভুলভাবে। নিমাই ভট্টাচার্য যে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে পড়েছেন, সেই স্কুলেই পড়েছেন আহসানউল্লাহ। সেই স্কুলের এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নিমাই ভট্টাচার্যের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন তিনি। এর আগে ‘ভারত বিচিত্রা’য়ও বসেছিল এক আড্ডা।

‘আহসান ভাই, নিমাই ভট্টাচার্য সম্পর্কে একটু বলবেন?’

‘ক্যান, আবার কী হইল? যশোরে এসেছিল যখন, তখন অনেক কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। আমাদের স্কুলেই তো পড়তেন। আবার...’

‘তিনি মারা গেছেন।’

কিছুক্ষণ আহসান ভাই কথা বলেন না। তারপর বলেন, ‘হ্যাঁ, এখন তো তাঁর সঙ্গে তোলা ছবিগুলো ছাড়া তাঁকে আর পাব না।’

আহসান ভাইয়ের কাছে শোনা যায়, সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৬ সালে নিমাই ভট্টাচার্য যশোরে এসেছিলেন। এই স্কুলের ১০০ বছর পূর্তিতে তিনি বিরাট একটি লেখা লিখেছিলেন। সেটিরই কিয়দংশ ছাপা হয়েছিল ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে।

ক্লাস নাইন পর্যন্ত এই স্কুলে পড়েছিলেন তিনি। দেশভাগের পর পারিবারিকভাবে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়।

সে সময় স্কুলের পুরোনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিমাই ভট্টাচার্যের যে কথাবার্তা হয়েছিল, তাতে তাঁর ‘সদরঘাট’ উপন্যাসটির প্রসঙ্গ এসেছিল। সে উপন্যাসে শরুশুনা গ্রামের কথা আছে বিশদে। জানা গেল, যখন নিমাই ভট্টাচার্যের বাবা তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে নামলেন শরুশুনা গ্রামের ঘাটে, তখন সমস্ত গ্রামের বউ–ঝিয়েরা উপচে পড়েছিল বাজারের বাঁ দিকের ঘাটটিতে। শরুশুনা গ্রামে নাকি এত সুন্দরী মেয়ের আবির্ভাব হয়নি এর আগে। স্মৃতিচারণাকালে নিমাই বলেছিলেন ছেলেবেলার শরুশুনার স্মৃতি। আমাদের গ্রামের আমসত্ত্বের খুব কদর ছিল। তিনি বলেছেন, বাড়িতে বানানো আমসত্ত্ব তিনি খেতেন চুরি করে।

স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়েছে তাঁর। আহসানউল্লাহ ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদক থাকাকালে একবার তাঁর অফিসে এসেছিলেন নিমাই ভট্টাচার্য। দোতলায় কোনো কাজে এসেছিলেন আহসানউল্লাহ, তখন কেউ একজন বলল, ‘তিন তলায় যান। দেখুন, কে এসেছে।’

তিনতলার ঘরে গিয়ে আহসানউল্লাহ দেখলেন, নিমাই ভট্টাচার্য টেবিলে বসে আছেন। তাঁর চারপাশে সাংবাদিকেরা চেয়ারে বসে।

আহসানউল্লাহও একটি চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, ‘আপনার গ্রামের বাড়িতেই আমার নানাবাড়ি।’

‘তাই নাকি? শরুশুনায়?’

‘জি।’

‘জার্নালিস্টের জার্নাল’-এর প্রচ্ছদ
‘জার্নালিস্টের জার্নাল’-এর প্রচ্ছদ

‘শরুশুনা নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। যশোর থেকে বাবার সঙ্গে যখন ফিরতাম, তখন বাস থেকে নামতাম খাজুরায়। তারপর সেখান থেকে নারিকেলবাড়িয়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম শরুশুনা গ্রামে!’ নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের গাঁয়ে ছিল ইংল্যান্ডের মতোই হাউস অব লর্ডস আর হাউস অব কমনস। গ্রামের জমিদারের বাড়ির আড্ডার নাম দিয়েছি হাউস অব লর্ডস। আর আমাদের শরুশুনা বাজারে শিক্ষক, চাষি, দোকানদারদের নিয়ে যে আড্ডা ছিল, তার নাম হাউস অব কমনস!’

ঠিক সে সময় একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের ইন্টেলেকচুয়ালরা তো আপনাকে ইন্টেলেকচুয়াল বলে মনে করে না।’

নিমাই ভট্টাচার্য একটু বিব্রত হলেন। কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। তারপর সেই সাংবাদিকের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘আচ্ছা, ইন্টেলেকচুয়াল কাকে বলে, বলুন তো?’

এবার থতমত খেয়ে গেলেন সেই সাংবাদিক। তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।

নিমাই ভট্টাচার্য বললেন, ‘আপনি তো ওই তাঁদের কথা বলছেন, যাঁরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেও দেখেন না। বাঁকা চোখে দেখেন। যাঁরা বড় বড় কথা বলেন, তাঁরাই তো ইন্টেলেকচুয়াল? হ্যাঁ, কলকাতার সেই ইন্টেলেকচুয়ালরা আমাকে মূল্য দেয় কি দেয় না, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি ঢাকায় এসে আপনাদের ফুটপাতে আমার যে অসংখ্য বই দেখেছি, তাতে বুঝেছি, আপনারা আমাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। কলকাতার রাস্তা দিয়ে যখন যাই, সেখানেও ফুটপাতে আমার বই বিক্রি হতে দেখেছি। আমার ‘মেমসাহেব’ উপন্যাস নিয়ে ছবি হয়েছে। আমি যখন কলকাতার রাস্তা দিয়ে হাঁটি, আমাকে দেখে কলেজের একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই ঝাল খাবি না টক খাবি।’ আমার উপন্যাসের একটা সংলাপ এভাবে মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। আমি তো নাকউঁচু ঘরানায় জায়গা পাইনি, সাধারণ মানুষের অন্তরে জায়গা পেয়ে গেছি।’

চার.

‘যাঁরা বড় বড় কথা বলেন, তাঁরাই তো ইন্টেলেকচুয়াল? হ্যাঁ, কলকাতার সেই ইন্টেলেকচুয়ালরা আমাকে মূল্য দেয় কি দেয় না, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি ঢাকায় এসে আপনাদের ফুটপাতে আমার যে অসংখ্য বই দেখেছি, তাতে বুঝেছি, আপনারা আমাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। কলকাতার রাস্তা দিয়ে যখন যাই, সেখানেও ফুটপাতে আমার বই বিক্রি হতে দেখেছি।’

নিমাই ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটা ছোট্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার পর সেখানে আমার চাচাতো বোন আফরোজা সুলতানা তাঁর স্মৃতিচারণা করেছে। আমার দুই বছরের ছোট সে। ও বলেছে, যখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ে (হিসাব করে দেখেছি, সেটা হবে ১৯৭৯ বা ৮০ সাল), তখন হঠাৎ শরুশুনা গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাই নিমাই ভট্টাচার্য আর তাঁর ‘মেমসাহেব’ উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। এরপর বললেন, আজ তিনি সস্ত্রীক আমাদের গ্রামে আসছেন।

একটু পরেই গ্রামের বাজারের দিক থেকে খেয়ানৌকায় করে আমার চাচা শরফউদ্দীন হোসেনের সঙ্গে নিমাই ভট্টাচার্য এলেন। সঙ্গে স্ত্রী। তাঁরা স্কুলে থাকলেন কিছুক্ষণ। মাঠে হেঁটে বেড়ালেন। আমার বোনটার হাত ধরে ঘুরলেন নিমাই ভট্টাচার্যের স্ত্রী।

এরপরের ঘটনাটা আমার চাচা শরফউদ্দীন হোসেনের কাছে শোনা। নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর পৈতৃক ভিটায় গিয়ে বাড়ির ধুলো–কাদা নিজের শরীরে মাখলেন। স্নানের পর ভিটেমাটির একটা অংশ ভেঙে সঙ্গে নিলেন। তারপর একটা বোতলে আমাদের চিত্রা নদীর পানি নিয়ে নিলেন বিদায় বেলায়।

পাঁচ.

না, আমি সামনাসামনি নিমাই ভট্টাচার্যকে দেখিনি। তাঁকে আমি চিনি তাঁর সাহিত্যের পথ ধরে। কিন্তু বছর বিশেক আগে একদিন শরুশুনা গ্রামের ব্রহ্মোত্তর পাড়া থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে দুটি তালগাছের নিশানার কাছে এসে হাতের বাঁয়ে ঘুরে আবার ডানে ঘোরার আগেই বাঁ দিকে একটি ভিটের দিকে আঙুল তুলে গ্রামেরই কোনো এক বড় ভাই বলেছিলেন, ‘এই যে, এটা নিমাই ভট্‌চাজের ভিটে।’

আমাদের গ্রামে ‘ভট্‌চাজ’ বলেই ডাকা হয়, ভট্টাচার্য নয়।

আমরা বাজারে যাওয়ার আগে সেই ভিটেয় ঘুরে এলাম।

হ্যাঁ, তত দিনে মগবাজার থেকে নিমাই ভট্টাচার্যের বই কেনার ব্যাপারটি অনেক দিন আগের কথায় পরিণত হয়েছে। ফেলুদা, এরকুল পুয়ারো, মাসুদ রানায় মজে যাওয়ার আগে আমিও অনেকের মতো নিশ্বাস নিয়েছি নিমাই, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন গুপ্তদের রোয়াকে বসে। মাঝেমধ্যে সে রোয়াকে কিছুক্ষণের জন্য বসেছি।

সে রোয়াক এখনো জীর্ণ হয়নি। বিশ্বসাহিত্যের বিশাল অঙ্গন পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে দেখি, এখনো তা রয়েছে যথেষ্ট ঝকঝকে তকতকে। সেখানে আরামে বসতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না।

 

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]