অল্পস্বল্প দীর্ঘ জীবন

>অন্য আলো ডটকমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে লেখক-অভিনেতা-চিত্রকর আফজাল হোসেনের স্মৃতি ধারাবাহিক ‘অল্পস্বল্প দীর্ঘ জীবন’। বিচিত্র এক জীবন পাড়ি দিয়েছেন আফজাল হোসেন। সাতক্ষীরার গণ্ডগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে চারুকলায় পড়েছেন, পত্রিকায় কাজ করেছেন, মঞ্চ কাঁপিয়েছেন একসময়। আর টেলিভিশনে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা তো বলাই বাহুল্য। বিজ্ঞাপনের জগতেও আছে তাঁর নিবিড় পদচারণ। আবার লেখক ও চিত্রশিল্পী হওয়ার কারণে লেখক-চিত্রকরদের অনেকের সঙ্গেই রয়েছে অন্তরঙ্গ সখ্য। জীবনের এসব নানা বর্ণের গল্পগুলো আফজালের কলমে উঠে আসবে এখানে। আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় কিস্তি।

তিন

বাড়ি থেকে পালিয়েছি দুবার। ক্লাস সিক্সে থাকতে কবি নজরুল ইসলামের মতো হতে হবে ভেবে পালানোর পাঁয়তারা করেছিলাম, শেষমেশ সাহসে কুলোয়নি। বাড়িতে বাঘ মার্কা দাদা আর স্কুলে রয়েছেন ভয়ানক দরবেশ আলী, হেড স্যার। তাঁর হাতে রাজদণ্ডের মতো থাকা ফোর ইন ওয়ান বেতটাও চোখ রাঙিয়ে ইচ্ছাকে বলেছিল, তফাত যাও।

এ কথাও সত্য, কয়েক দিনে নিজের ধরনের বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়ে গেছে, যারা বিকেলবেলা মাঠে খেলতে যায় না, আনন্দ উপভোগ বলতে অন্য অনেক কিছু বোঝে। এক–একদিন এক–একটা বিষয় মাথায় এসে ঢুকত। কেউ হয়তো বলল, কোন পাখি কেমন করে ডাকে—ব্যস, আমরা পলকে হয়ে যেতাম পাখি। কিংবা সুগন্ধ সবার প্রিয় হলেও অনেক দুর্গন্ধকেও পছন্দ করি আমরা। সেগুলো কী কী? প্রশ্নের ঠ্যালা খেয়ে উত্তর খুঁজতে নেমে পড়া। পাট পচানোর গন্ধ, কেরোসিন, জিওলের আঠা—এসব হড়হড় করে বলতে পারার পর সবাই চুপ হয়ে, মনোযোগের গভীরে ঢুকে দৌড়ঝাপ করা, আর কী কী? অধিকসংখ্যক উত্তর দিয়ে সেরা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় উত্তেজনাময় মুহূর্ত পার হয়ে যেত।

আমাদের ভালো লাগত তাঁতিদের পাড়ায় চলে যেতে। সেখানে কত কিছু দেখার ছিল। লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি ছাড়াও সে পাড়াতে কেন জানি প্রচুর পরিমাণে গজ ব্যান্ডেজ তৈরি হতো। তাঁত বোনার খটাশ খটাশ শব্দে বোধ হয় জাদু ছিল, সে শব্দের সঙ্গে সুতো নিয়ে মাকুর বাম-ডানে অস্থির ছোটাছুটি দেখতাম হাঁ হয়ে। দেখতাম সাধারণ মানুষদের যোগ্যতা, অসাধারণত্ব। দেখতাম মানুষের বুদ্ধির জোরে সুতো কীভাবে কাপড় হয়ে উঠছে।

যে যেখানেই থাকি, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে হাঁস-মুরগিদের মতো নিজেদের খোয়াড়ে ঢুকে যেতে হবে; ছিল কড়া নির্দেশ। প্রত্যেকে ছিলাম জাত অভিনয়শিল্পী। আদর্শ ছাত্রের ভূমিকায় দক্ষ। ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে সবাই বসে যেতাম যার যার পড়ার টেবিলে। ছাত্ররা পড়তে বসেছে কি না, মৌলভি স্যার প্রতি ঘর ঘুরে দেখে যেতেন। স্যারের প্রস্থানের পর আমরা আবার হয়ে যেতাম আমাদের মতো, খেয়ালখুশির রাজা।

ঘরের বন্ধুরা আমাকে বুঝেছিল। ছবি আঁকতে পারি, কবিতা লিখি, একটু মনভোলা ধরনের। মাঝেমধ্যেই আমি, নিজের একটা জগৎ রয়েছে, সেখানে চলে যাই। অন্ধকার কি শুধুই কালো নাকি তার ভেতরে আরও রং রয়েছে? এ রকম অনেক রকমের হঠাৎ প্রশ্ন শুনে অবাক হতো না বা হাসিঠাট্টায় মেতে উঠত না তারা, তার জন্য আপন মানুষদের মধ্যে রয়েছি, এমন অনুভব হতো।

আকাশ আর মেঘ মিলে রোজ যে ছবি আঁকাআঁকি করে, তা ওদের দেখাতাম। পরে ওরা নিজেরাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করত, নীল মেঘের বুকে কোথায় সাদা মেঘপুঞ্জ ঘোড়ার আকৃতির মতো হয়ে আছে বা বিশাল ডানা মেলে কোনো নাম না–জানা পাখি অসীম ক্যানভাসে ওড়ার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে কি না!

রোজ নিয়ম করে বই নেড়ে পাতা উল্টে পড়তে হবে, ভালো লাগত না। পড়া মুখস্থ করে ক্লাসে যাও, স্যার পড়া ধরলে কলকল করে বলে দাও—তুমি ভালো ছাত্র হয়ে গেলে। ব্যাপারটা খুব বোকা বোকা মনে হতো। পড়ে কী লাভ হবে? প্রশ্নটা মনে জেগেই থেকেছে। ক্লাসে পড়া ধরলে বলতে না পারাটা অবশ্যই লজ্জার ছিল। বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়াটায় শাস্তির চেয়ে অপমান বোধ হতো বেশি। ওই ভয়ে বই না পড়েও ক্লাসে পড়া বলতে পারার একটা উপায় বের করে ফেলেছিলাম। খুবই সহজ উপায়।