কবি দাউদ আল হাফিজ চলে গেলেন

গতকাল প্রয়াত হয়েছেন কবি-অনুবাদক দাউদ আল হাফিজ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
দাউদ আল হাফিজ
দাউদ আল হাফিজ

আন্তন চেখভ কিংবা মোপাসাঁর গল্প তখন কীভাবে পড়ব? র‌্যাবোঁ বা বোদলেয়র নামে যে কবি আছেন, তা-ও কি আমার জানা সম্ভব ছিল মধুপুরে বসে? ঝিনাইদহ জেলাধীন মধুপুর এমন একটি গ্রাম, যেটি গাড়াগঞ্জ বাজার-সংলগ্ন। বাজারের গা ঘেঁষে প্রবাহিত শীর্ণকায় কুমার, একটি নদ। কুমার চলে গেছে বারইপাড়া, হাবিবপুর, কবিরপুরের দিকে। কবিরপুরে ছোট্ট ব্রিজ, কুমার নদের ওপর। ব্রিজের ওপারেই শৈলকূপা থানার বাজার শুরু। শৈলকূপা ছাড়ালেই আবার গ্রাম। একটি গ্রাম মনোহরপুর, একটি গ্রাম বিজুলিয়া। বিজুলিয়াতেই বাড়ি সুনীল শর্মাচার্যের। সুনীল শর্মাচার্য কবি, অনুবাদক। ছোটগল্পও লিখতেন। আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল মধুপুর। আমি গাড়াগঞ্জ বহুমুখী বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। কীভাবে যে সুনীল শর্মাচার্যের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়, সে আর মনে নেই। পড়ার প্রতি আমার নেশা দেখেই হয়তো সুনীলদা আমাকে একদিন বিজুলিয়ায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বউদি ছাড়া দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। সুনীলদার মা-বাবা কি তখনো বেঁচে ছিলেন? তারপর সুনীলদার সঙ্গে একটা ভাব হতে থাকল আমার। সুনীলদাই সেই দশম শ্রেণির ছাত্র আমাকে মোপাসা, চেখভ, র‌্যাবো, টলস্টয় ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। সুনীলদার শৈলকূপার বন্ধু কবি সামসুজ্জামান লাবলুর সঙ্গেও আমার আলাপ হলো। লাবলু ভাইদের একটি প্রেস ছিল। অবশ্যই লেটার প্রেস। সেই আমার জীবনে প্রথম কোনো প্রেস দেখা হলো। কীভাবে বর্ণমালা সাজানো থাকে থরে থরে, কীভাবে কম্পোজ হয়...।

সুনীল শর্মাচার্যের আরেক সখা রণক মুহম্মদ রফিক, রোকনুজ্জামান রবার্ট, আহাদ আলী, মীর সোনা মিয়া বা আরও কেউ কেউ। কিন্তু সুনীলদা খুব বলতেন যাঁর কথা, তিনি দাউদ আল হাফিজ, ঢাকায় থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ছেন। দাউদ আল হাফিজের বাড়ি ব্রিজের ওপারে, কবিরপুরে। ছুটিতে আসতেন দাউদ আল হাফিজ, কবি ও কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’ সঙ্গে নিয়ে আসতেন। অবশ্য এরও কয়েক বছর আগে আমি দাউদ আল হাফিজের নাম শুনেছিলাম। বলা চলে পুরো এলাকাতেই সবাই তাঁর নাম জানত। ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের (কেসি কলেজ) বর্তমান অধ্যক্ষ বি এম রেজাউল করিম আজ ৩০ জুন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমি প্রায় বছরখানেক শৈলকূপায় জগন্নাথ স্যারের শান্তিনিবাসে ছিলাম। সেই সূত্রে দাউদ আমার সতীর্থ। এসএসসির ফল বেরোল, দাউদ সেকেন্ড স্ট্যান্ড করল। দাউদের এই রেজাল্ট অপ্রত্যাশিত নয়, বরাবরই ও ভালো ছাত্র। স্যাররা ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। ও তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করেছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলো। ওর বাবা নিতান্ত গরিব মানুষ, দিনমজুর। অনেকেই অনেকভাবে ওর সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে এল।
‘ঢাকা কলেজে ভর্তি হলো দাউদ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি বিভাগ। জাহিদ তখন ঢাকা সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে পড়ে, থাকে খিলগাঁওয়ের একটি মেসে। আমি একদিন রাজশাহী থেকে ঢাকায় গিয়ে জাহিদের মেসে উঠেছি। গিয়ে দেখি, পেছন ফিরে জাহিদের সিটে কেউ একজন ভরদুপুরে গভীর ঘুমে অচেতন। জাহিদ বলল, দাউদ। ও বেশ কিছুদিন হলো আমার এখানেই আছে। সিটের নিচে অগুনতি বই, সব দাউদের। এ রকম বইয়ের ভান্ডার ওর ঢাকা শহরে আরও কয়েক জায়গায় আছে।
‘ঘুম থেকে জাগবার পর ওর সঙ্গে আমার অনেক গল্প হলো। সংগত কারণেই সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে। ওর সম্পর্কে আমার নতুন ধারণা জন্ম নিল। আমি বুঝতে পারলাম, দাউদ এখন অনেক বড় হয়েছে। ওর লেখাপড়ার গভীরতা পরিমাপ করবার ক্ষমতা আমার নেই।

ঢাকা শহরের কবিতাসমাজে নিজেকে আসীন করার কোনো দায়ই ছিল না দাউদ আল হাফিজের। জীবনের প্রতি নিরাসক্তি এসে গিয়েছিল, নাকি তুলনামূলক আগেভাগেই বিয়ে করা বা সন্তানের পিতা হয়ে যাওয়ার ফলে সংসারের ঘানি টানার দায়িত্ব তাঁকে বেশি চাপে ফেলে দিয়েছিল?—এসব ভাবনা থেকেই যায়।


‘এরপর একদিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমীর আলী হলে আমার ৩৬১ নম্বর রুমে হাজির। বলল, হাসান আজিজুল হক স্যারের সঙ্গে ও দেখা করতে ঢাকা থেকে রাজশাহী এসেছে, কাজ সেরে আবার ঢাকা ফিরে যাবে। আমার রুমে বেশি সময় ও থাকেনি। তবে যেটুকু সময় ছিল তার পুরোটাই আলোচনা হয়েছে কবিতা নিয়ে।
‘আমি ঝিনাইদহে থাকতে শুরু করেছি, দাউদ শৈলকুপায়। ঝিনাইদহ থানার সামনে অডিও ভিশনে ও মাঝেমধ্যে আসে, কথাবার্তা হয়। খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্যারের “একবিংশ” ওর মাধ্যমেই পেতাম।’
গতকাল কবি দাউদ আল হাফিজ চিরকালের জন্যে চলে গেছেন। আজ ফেসবুকে কলকাতা থেকে সুনীল আচার্য একটি হাতে লেখা চিঠি প্রকাশ করেছেন। দাউদ আল হাফিজ লিখেছিলেন সুনীল শর্মাচার্যকে। সুনীল শর্মাচার্য পরে ঝিনাইদহ থেকে আবাস গুটিয়ে কলকাতা চলে গেছেন, এখন সুনীল আচার্য নামে নিয়মিত লেখেন।
দাউদ আল হাফিজ পরবর্তী-জীবনে ঢাকায় থাকতেন যেমন, আবার শৈলকুপাতেও থাকতেন। কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত কবি ও কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’র সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন দাউদ ভাই। লিখতেন তো বটেই। তবে অন্য কোনো কাগজে আর লিখতেন, এমনটি বলা যায় না। খুব সংযত, লেখা প্রকাশের বিশেষ আগ্রহ ছিলই না তাঁর মধ্যে। বই প্রকাশ নিয়েও তাই। আত্মপ্রকাশের চাপহীন কবি দাউদ আল হাফিজ। সা জ্যান পার্সের ‘আনাবাজ’ অনুবাদ করেছিলেন সেই কত আগে! ওই বইটাও প্রকাশের ব্যাপারে মাঝেমধ্যে কথা বলেছি দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে। একদা আজিজ মার্কেটের নতুন বইপাড়ার বারান্দায় কিংবা অধুনা করকর্ড এম্পোরিয়ামের আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে মাঝেমধ্যেই দু-এক পশলা আড্ডা হতো দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে। করোনাপীড়িত এই দুর্যোগের মধ্যেই, গতকাল ২৯ জুন তিনি চলে গেলেন। আর দেখা হবে না, আর কথা হবে না। একটা চাপা কষ্ট থেকে যাচ্ছে অন্তরে, দাউদ ভাইকে পাব না আর!
আমার বাবা চাকরিসূত্রে শৈলকুপার খুলুমবাড়িয়া, লাঙ্গল বান্ধ এলাকায় যেতেন। পথিমধ্যে শৈলকুপাতে দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বাবার দেখা হলে তাঁদের যা আলাপ হতো, তা হয়তো কবির জীবনের ভবিষ্যৎ ছবির গল্প। সেসব কথা বাবার সঙ্গে কখনো আমার শেয়ার না হলেও দাউদ ভাই দেখা হলেই বলতেন, ‘সেদিন তো তোমার বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল, অনেক কথাও হলো...’
আর কথা হবে না। ঢাকা শহরের কবিতাসমাজে নিজেকে আসীন করার কোনো দায়ই ছিল না দাউদ আল হাফিজের। জীবনের প্রতি নিরাসক্তি এসে গিয়েছিল, নাকি তুলনামূলক আগেভাগেই বিয়ে করা বা সন্তানের পিতা হয়ে যাওয়ার ফলে সংসারের ঘানি টানার দায়িত্ব তাঁকে বেশি চাপে ফেলে দিয়েছিল?—এসব ভাবনা থেকেই যায়।
মনে পড়ছে একটি স্মৃতি। আমি তখন ঝিনাইদহ কেশবচন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে ঝিনাইদহে এলেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ। এটি হতে পারে ১৯৮৯ সাল। তখনো আমি ‘প্রেম নেই’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘প্রতিবেশী’ পড়িনি। তাই গৌরকিশোর ঘোষের ওজন বুঝতে পারার জায়গায় ছিলাম না। ‘ইত্তেফাক’-এর ঝিনাইদহ প্রতিনিধি সাংবাদিক বিমল কুমার সাহা, সুনীল শর্মাচার্য ও দাউদ আল হাফিজ আমাকেও নিয়ে গেলেন ঝিনাইদহের ওয়াপদার ভেতরে একটি বাংলোতে, যেখানে সে সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ।
গৌরকিশোর ঘোষ ঝিনাইদহ এসেছিলেন দেশভাগের সময়ে রেখে যাওয়া তাঁদের বাড়ির ভিটা দেখতে। সুনীলদা ও দাউদ ভাই আমাকে গৌরকিশোর ঘোষ সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম ‘শৈলকূপার কবিরা’ নামে। সেই কবিতায় দাউদ আল হাফিজ, সুনীল শর্মাচার্য ও সামসুজ্জামান লাবলুর কথা এসে গিয়েছিল। দাউদ ভাই পছন্দ করলেন।

কবি সুনীল আচার্যকে লেখা দাউদ আল হাফিজের চিঠি
কবি সুনীল আচার্যকে লেখা দাউদ আল হাফিজের চিঠি

শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের ওপর একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন দাউদ আল হাফিজ। তবে তাঁর নিজের কবিতার বই, অনুবাদ নিয়ে গ্রন্থপ্রকাশ—সবই তো অসমাপ্ত রয়ে গেল মনে হয়। জীবনটাই তো অসমাপ্ত রয়ে গেল। এ রকম চলে যাওয়া খুব মর্মান্তিক। দাউদ ভাই, আপনার সখাগণ রয়ে গেলেন। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও তাঁর ‘একবিংশ’কে ঘিরে একদল প্রতিভাবান কবির বিকাশ ঘটেছে গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে। কবি দাউদ আল হাফিজের এই প্রস্থানে তাঁরা অনেক বেশি ব্যথাতুর হবেন, এ আমি জানি। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ তারিক, তুষার গায়েন, খলিল মজিদ—এঁদের সঙ্গে কত সময়ই না কেটেছে আপনার। ছোট কাগজ ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ আপনার জন্য ব্যথাতুর হবেন। আর ব্যথাতুর হবে আপনার পরিবার এবং শৈলকুপা-ঝিনাইদহের মানুষেরা, যাদের সন্তান আপনি। যাদের মাটিতে আপনি জন্মেছিলেন, দাউদ ভাই।
পৃথিবীজুড়ে এখন এক ঘোর করোনাপীড়া চলছে। মানুষ মরে যাচ্ছে হাজারে-হাজার। মানুষ আজ ঘরবন্দী। কেউ কোথাও পৌঁছতে পারছে না। মানুষ যেতে পারছে না মানুষের কাছে। এর মধ্যেই আপনি চলে গেলেন, দাউদ ভাই। আপনার কী সুন্দর হাতের লেখা, খুব মুগ্ধ হতাম। আপনার পড়াশোনা ও জানা-বোঝার ব্যাপ্তির কাছে কোনো দিন পৌঁছাতে পারব না। কিন্তু আপনাকে অনুভব করতে পারব, অনুভব করে যাব। আমাদের কাব্যসাহিত্যে আপনার উজ্জ্বল উপস্থিতি থেকে যাবে। কুমার নদের পারের মানুষেরা আপনার কথা বলাবলি করবে। আপনি আমার শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন আজীবন, দাউদ ভাই।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]