শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: হিরণ্ময় স্মৃতি

১৯২১ সালের ১ জুলাই পূর্ববঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সূত্রে প্রতিষ্ঠানটি আজ ১০০ বছরে পড়ল। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার-স্বাধীনতা থেকে বাংলাদেশের জন্ম-আমাদের জাতীয় জীবনে এ শিক্ষায়তনের অবদান যেমন বিপুল, তেমনি অজস্র ব্যক্তির জীবনেও এর রয়েছে বিস্তর প্রভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এবং পরে শিক্ষক সেলিম জাহান লিখেছেন কোন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর জীবনে ভূমিকা রেখেছে।

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছরে পড়ল। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পূর্ববঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি তার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল শিক্ষার্থীদের জন্য। আর তার প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৬৯ সালে আমরা শিক্ষার্থী হয়ে প্রবেশ করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। তুঙ্গ সময় সেটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক আবু মাহমুদ কিছুদিন আগে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের গুন্ডাদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ওই ছাত্রসংগঠনের নেতা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের ত্রাস পাঁচপাত্তুর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়েছেন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আমাদের সরব প্রকাশ।

১৯৬৯-এর এক স্নিগ্ধ সকাল থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার নিত্য আনাগোনা ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে। উচ্চশিক্ষা ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য ৬ বছর আর পরামর্শক হিসেবে ২ বছর বাদ দিলে বাকি ১৭ বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে-পিঠেই আমার জীবন কেটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের বাইরে থাকলেও এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার নাড়ির টানে কোনো হেরফের হয়নি। এই সিকি শতাব্দীতে আমার বেড়ে ওঠা, বিকাশ ও বিবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে এক অমূল্য ভূমিকা রেখেছে।

প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয় মানে ‘বিশ্বের বিদ্যালয়’ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মানে যেখানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি বিশ্ববীক্ষণ পাওয়া যায়, যেখানে চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটি আমাকে দিয়েছে। একটি বৈশ্বিক সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি আমি লাভ করেছি এবং একটি ‘মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার’ চেতনা ও বোধ আমি অর্জন করেছি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ে আমার এ বোধ আরও গভীরতর হয়েছে এবং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা আমার সারা জীবনের পাথেয় হয়েছে। হয়তো এ কারণেই বহু ক্ষুদ্রতা, বহু নীচতা, বহু কূপমণ্ডুকতা আমাকে গ্রাস করতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে বহু অনন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি, যাঁরা আমাকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শিক্ষকেরা আছেন, আমার সহপাঠীরা আছেন, আছেন বহু বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীও।

অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদা, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের মতো দিকপালদের আমি শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অর্থনীতি শাস্ত্রের বহু শিক্ষা, বহু জ্ঞান, বহুবোধ এঁদের কাছেই পাওয়া। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বুঝেছি, কী প্রতিভাবান আর মননশীল ছিলেন আমার শিক্ষকেরা। কত যত্নে, কত দরদ দিয়ে তাঁরা আমাদের পড়িয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শেখা বিদ্যার বেসাতি সাজিয়ে এখনো দিন চলছে।

সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে এই শিক্ষায়তনের চার শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত
সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে এই শিক্ষায়তনের চার শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু এঁদের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন কিংবা শ্রেণিকক্ষের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। মনে আছে, বহু সকাল-সন্ধ্যা কেটেছে অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন সাহেবের বাড়িতে। গল্প চলছে, আড্ডা চলছে-অধ্যাপক ইনারী হোসেন চা-কফির অফুরন্ত জোগান দিয়ে চলেছেন। আশির দশকে তাঁদের নিজস্ব বাড়ি তৈরি হবে ধানমন্ডিতে। খোলা রিকশায় বসে স্বর্ণকেশী অধ্যাপক ইনারী হোসেনের সঙ্গে আমি চলেছি পুরোনো ঢাকায় চুন-সুরকি কিনতে। অধ্যাপক আনিসুর রহমান স্বকণ্ঠে গীত রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট উপহার দিয়েছেন আমাকে। এখনো তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর কণ্ঠ শুনতে পাই, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে’। কাজে-অকাজে প্রায়ই যেতাম অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদার ধানমন্ডির ঈদগাহের পাশের বাসভবনে। কী যত্নে যে আপ্যায়ন করতেন অধ্যাপক কুসসুম হুদা। তবে ওই বাড়িতে আমার চেয়েও বেনুর আদর ছিল বেশি।

বিভাগের বাইরে পেয়েছি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষীদের, যাঁরা আমার চিন্তা-চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে লেখালেখি, বেতার-টেলিভিশনে ভাষ্য, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণে কতবার যে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান হয়েছে। বানান থেকে শুরু করে গ্রন্থপঞ্জি, সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে সম্পাদনা, কত বিষয়ে যে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি তার লেখাজোকা নেই। বেতারে কৌশিক আহমেদের সঞ্চালনায় ‘প্রভাতি’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত অনুষ্ঠান থাকত আমাদের। নিয়ম করে এক সপ্তাহে প্রচারিত হতো স্যারের কথিকা ‘কথার কথা’, এবং অন্য সপ্তাহে আমার কথিকা ‘যা না বললেই নয়’। দেখা হতো বেতার ভবনে প্রায়ই হয় তাহের ভাইয়ের (সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক কবি আবু তাহের) কক্ষে, কিংবা স্টুডিওর সামনে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে কম জ্বালাইনি। মনে আছে, আটকে গিয়ে বেশ রাতে ফোন করে জানতে চেয়েছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে বেরিয়েছিল, তাও জানিয়েছেন অন্য আরেক দিন এক লহমায়। তাঁর কন্যা রুচির আমি শিক্ষক ছিলাম বলে তিনি চিরকাল আমায় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, এই কিছুদিন আগে ‘তুমিতে’ পদোন্নতি হয়েছে আমার। গত বছর আমার ‘বেলা-অবেলার কথা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

কী কারণে জানি না, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাকে ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলে সম্বোধন করতেন। বাড়িতে গেলেই বলতেন, ‘এক পেয়ালা চা খাইবেন নি, জনাব সেলিম জাহান?’ ফুলার রোডের দোতলা যে বাড়িতে থাকতেন তিনি, তার দ্বিতলেই থাকতেন অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক ইনারী হোসেন তাঁদের দুই কিশোর পুত্র জাফর আর রাজাকে নিয়ে। সে বাড়িতে যাওয়ার পথেই রাজ্জাক স্যারের ডেরায় আমার ঢুঁ মারা। মুনীর কাকার কথা বলতেন খুব, বলতেন আমার পিতার কথাও, যিনি তাঁর ছাত্র ছিলেন। বাজার, রান্না থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার মুসলমান, হ্যারল্ড লাস্কি থেকে শুরু করে কার্ল মার্ক্স, ঢাকার ইতিহাস থেকে আমার লেখা-কোনো কিছুই সে আলোচনায় পরিত্যাজ্য ছিল না। ছাত্রের পুত্র বলে একটি ‘পৌত্র-ছাত্রের’ মতো ব্যবহার ছিল তাঁর আমার প্রতি-গাম্ভীর্যবিহীন, ঠাট্টা-মশ্করার, হালকা চালের। তবে দাবা বিষয়ে তাঁর ত্রিসীমানায় তিনি আমাকে ঘেঁষতে দিতেন না। লক্ষ করেছিলাম, আমাকে যেমন তিনি ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলতেন, ছফা ভাইকেও সম্বোধন করতেন ‘মৌলভি আহমেদ ছফা’ বলে। আমার ক্ষেত্রের মতো এর কারণও অজানা।

অর্থনীতি বিভাগ সব সময়ই তারকাখচিত বিভাগ হয়, কিন্তু ১৯৬৯-এর দলটি ছিল উজ্জ্বল তারকামণ্ডিত। দেড় শ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪০ জনই ছিল বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রথম ১০ জনের মধ্যে স্থান করে নেওয়া ছাত্র-ছাত্রী। কী তাদের অনন্য ধী-শক্তি, বুদ্ধির দীপ্তি, মেধার দ্যুতি-জিলেট ব্লেডের মতো ধার তাদের। পড়াশোনায়, সাহিত্যে, নাটকে, বিতর্কে, এমনকি স্রেফ দুষ্টুমিতে তাদের সৃজনশীলতা আর কীর্তিকলাপ কিংবদন্তি পর্যায়ের। আমার সতীর্থদের কাছে আমার ঋণ অনেক। তাদের পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি আমার পঠনের পরিসীমা বর্ধনে উৎসাহ জুগিয়েছে; তারাই আমাকে শিল্প-সাহিত্যের বহুধা মাত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছে, তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে ঋদ্ধ হয়েছি। জীবন ও জগতের বহু শিক্ষা তাঁদের কাছেই।

আর শরীফ মিয়ার ক্যানটিন? সে ছিল এক মহা মিলনক্ষেত্র। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে-শেখ লুৎফর রহমান থেকে রফিকুন নবী, কবি নির্মলেন্দু গুণ থেকে রশীদ হায়দার, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে মাহফুজ আনাম। আসতেন কবি আবুল হাসান, সোহরাব হোসেন, অজয় রায়, জাহেদুর রহিম, শওকত আনোয়ারসহ আরও কজনা।

সতীর্থ বন্ধুদের কথা বলতে গেলে মন ভারী হয়ে আসে। গত কয়েক বছরে হারিয়েছি কত জনকে। বিভাগের সতীর্থদের মধ্য থেকে চলে গেছে আফসারী, মলি, বেনু, বদরুল, নীলুফার মতিন, পারুল, মাসুদ। বেনু তো চার দশকের জীবনসঙ্গীই ছিল আমার। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে পারুল কিংবা আফসারীর সঙ্গে দেখা হয়নি। বেনুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মলি। নিউইয়র্কে আমাদের বাড়িতে সে এসেছিল একবার। নীলুফার মতিন নিজের অসুস্থতার মধ্যেও অসুস্থ বেনুকে দেখতে এসেছিল আমরা যখন একবার ঢাকায় গিয়েছিলাম। আশির দশকে শেষ দেখা বদরুলের সঙ্গে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই কবি মাসুদ আহমেদ মাসুদ মানসিক ভারসাম্য হারায়। মাসুদ আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বরিশালের ছেলে অসাধারণ এই মেধাবী বন্ধুটি যখন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, তখন আমি উচ্চশিক্ষার্থে কানাডায় স্থিত। পরে দেশে ফিরলে বাবা আমাকে বলেছিলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মাসুদ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত, বাবাকে বলত, আমাকে সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দিতে। পৃথিবীর এত দেশ থাকতে কেন আমাকে সাইপ্রাসে যেতে হবে, সেটা আমার বাবারও বোধগম্য ছিল না, আমার কাছেও এক রহস্য। মনে আছে উনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে কলকাতা থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত মাসুদের কবিতা ‘সেদিন সকালে, সারা বরিশালে হরতাল হয়েছিল’। অর্থনীতি বিভাগের বাইরেও তো কত সহপাঠীকে হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছি কত সহপাঠী বন্ধুকে। নিজামের কথা মনে হয়। ১৯৭৫-এ হারিয়েছি শেখ কামাল আর খুকুকে। কদিন আগে চলে গেল জাহাঙ্গীর আর বাদল।

শিক্ষক-ছাত্র প্রীতি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। জগন্নাথ হলের মাঠে ফিল্ডিংয়ের জন্য যাচ্ছেন শিক্ষকেরা। বাঁ দিক থেকে হাবিব খোন্দকার, কাজী শহীদুল্লাহ্, আবদুল মোমিন চৌধুরী, এস. এম. এ ফায়েজ, কবীর চোধুরী, এ. টি. এম জহুরুল হকসহ আরও কয়েকজন, ১৯৭৬। ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষক-ছাত্র প্রীতি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। জগন্নাথ হলের মাঠে ফিল্ডিংয়ের জন্য যাচ্ছেন শিক্ষকেরা। বাঁ দিক থেকে হাবিব খোন্দকার, কাজী শহীদুল্লাহ্, আবদুল মোমিন চৌধুরী, এস. এম. এ ফায়েজ, কবীর চোধুরী, এ. টি. এম জহুরুল হকসহ আরও কয়েকজন, ১৯৭৬। ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাধারণ মানুষের অবিস্মরণীয় চরিত্র আমাকে মানবিক হতে সাহায্য করেছে। অর্থনীতি বিভাগের প্রবাদ চরিত্র কানুদাকে কী করে ভুলি? তাঁর স্নেহ-মমতা আমাকে ঘিরে রেখেছে দীর্ঘ ২৫ বছর-আমার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতা জীবনে। কানুদা ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের প্রবাদপুরুষ-জীবন্ত ইতিহাস। জানতেন আমার পিতা ও শ্বশ্রূপিতাকে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জীবনে। আমার প্রতি কানুদার একটি অন্য রকমের মমতা ছিল। অনেকটা আগলে রাখতেন আমাকে বিশেষত আমার শিক্ষকতা জীবনে। কানুদার ছেলে বাবুল, লাবু, মহসীন সেটা জানত এবং এখনো আমার জন্য তারা বুক পেতে দেয়। ভুলিনি নাজমুল, দাইয়ুমকে কিংবা বিভাগীয় দপ্তরের রহমান ভাই, নাজির মিয়া কিংবা করিম সাহেবেকে।

বিভাগে আমার বিবর্তনের সাক্ষী এঁরা। প্রশাসন দপ্তরে খন্দকার সাহেবকে এখনো মনে আছে। ছাত্রজীবনে বৃত্তির টাকা তুলতে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি জানতেন, হয়তো আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা তিনি প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন। সে শিক্ষা আজও ভুলিনি।

সলিমুল্লাহ হলের প্রহরী নাজু মিয়াকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। লম্বা পাগড়ির, বিরাট গোঁফের ব্যক্তিত্ববান নাজু ভাইকে দেখে উপন্যাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র বলে মনে হতো। শুনেছিলাম ২২ / ২৩ বছর আগে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আমার বাবাও নাজু ভাইকে সলিমুল্লাহ হলে দেখেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে বাবার সঙ্গে আমাকে দেখে নাজু মিয়ার চোখে-মুখে সে কী আনন্দের আভা। সে কী যত্নআত্তি আমার।

ভুলিনি কালুদাকেও। শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি আমার কক্ষের ঝাড়া-মোছা করতেন। শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা করে ফেরত এলে প্রায়ই বলতেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘স্যার সব সাফা করে দিছি।’ ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে কালুদার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জানার বিস্তার এবং আমার সময় কাটানোর পরিসীমা বেশির ভাগই ব্যাপৃত ছিল শ্রেণিকক্ষের বাইরে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও মিলনায়তন, গ্রন্থাগারের চাতাল, শরীফ মিয়ার ক্যানটিন-এ সবই ছিল আমার শিক্ষাক্ষেত্র। আড্ডার ঝড় তুলেছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও গ্রন্থাগারের চাতালে-জীবন ও জগতের বহু পাঠ তো সেখান থেকেই নেওয়া। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিতর্কের যুক্তিতে শাণিত করেছি নিজের চিন্তাশক্তি ও বলনের ক্ষমতা।

আর শরীফ মিয়ার ক্যানটিন? সে ছিল এক মহা মিলনক্ষেত্র। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে-শেখ লুৎফর রহমান থেকে রফিকুন নবী, কবি নির্মলেন্দু গুণ থেকে রশীদ হায়দার, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে মাহফুজ আনাম। আসতেন কবি আবুল হাসান, সোহরাব হোসেন, অজয় রায়, জাহেদুর রহিম, শওকত আনোয়ারসহ আরও কজনা। বাংলা, অর্থনীতি, ইংরেজি আর অন্যান্য বিভাগের দু-এক ক্লাস ওপরের ছাত্রছাত্রীসহ আসত আমার সতীর্থরা। যেমন আসতেন রিজওয়ানুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুক্তাদা, সেলিম সারওয়ার, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তেমনি আসত কাজী শহীদুল্লাহ, শেখ কামাল, কায়সার হামিদুল হক, ফিরদৌস মুর্শেদ। অনুজদের মধ্যে আতিউর রহমান, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনিস আহমেদ, প্রয়াত খান মোহাম্মদ ফারাবীসহ আরও কতজন।

দু-একজন মাঝেমধ্যে মধ্যে উঁকি দিলেও মেয়েরা বড় একটা আসত না শরীফ মিয়ায়। এলেও বসত না ওই ক্যানটিনে। তারা ওই গ্রন্থাগারের চাতালেই বসত। তাদের জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে যাওয়া হতো। হাসিতে-গানে-হই-হল্লায় ভরে যেত চারদিক। মনে আছে, ওই চাতালে বসেই একদিন রুমা (তাজিন মুর্শেদ) ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ পুরোটা গেয়ে আমাদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিল। শেখ কামাল কোরাসে ‘পাগলার মন নাচাইয়া, পাগলী গেল চলিয়া’-তারস্বরে চিৎকার করে গেয়েছিল।

শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে কত কী যে শিখেছি। হাসান ভাই একদিন ছন্দের শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমার বাল্যবন্ধু প্রয়াত শিল্পী হাসি চক্রবর্তী বুঝিয়েছিল রেখার টান বিষয়ে। শুদ্ধ কবিতার জন্য কবিতা, না সমাজ-চিন্তার জন্য কবিতা-এ বিতর্কে একদিন রেগেমেগে শাহনূর খান বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ কথা বলেননি আমার সঙ্গে। নভেরার ভাস্কর্যের ব্যাখ্যা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল খান মোহাম্মদ ফারাবীর সঙ্গে। ওই চাতালের আড্ডা থেকেই কামাল একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের ৩২ নম্বরের বাড়িতে-সেই দিন শুধু একবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

পঞ্চমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক মায়াময় স্মৃতি আমার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুদফায়। ১৯৭৫-এ এমএ পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আগেই বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৭৭-এ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে দুই বর্ষের শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি-তৃতীয় বর্ষের সম্মান ও এমএ ক্লাসে। দ্বিতীয় দফায় পড়িয়েছি ১৯৮৪ সাল থেকে উচ্চশিক্ষা সমাপান্তে বিদেশ থেকে ফিরে। আমার শিক্ষার্থীদের কাছে আমার অনেক ঋণ। তাদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি, বহু ভুলভ্রান্তি শুধরে দিয়েছে তারা। পড়াতে গিয়ে তাদের কখনো ঠকাইনি। নিজের যতটুকু সক্ষমতা, তার পুরোটাই উজাড় করে দিয়েছি।

যাদের শিক্ষক হওয়ার অনন্য সৌভাগ্য আমি অর্জন করেছিলাম, তারা আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। লেখে তারা আজও আমাকে, স্মৃতিচারণা করে সে সময়ের-আমার জন্যে তাদের অপরিমেয় মায়া-মমতা। প্রায়ই ‘আপনি-তুমিতে’ গুলিয়ে ফেলি, তারা আমোদিত হয়। বুঝি, তাদের আস্থার, বিশ্বাসের আর শ্রদ্ধার জায়গাটি হারাইনি। এ প্রাপ্তির কাছে আর কিছু কী আছে?
আমরা দুপুরুষ-আমার পিতা এবং আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছি। আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে-ছাত্রজীবনে ও পেশাগত জীবনে। নিয়েছি অনেক, কিন্তু দিতে পারিনি তেমন কিছু। তবু যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন এক মায়াময় মমতায় আমার মন ভরে ওঠে।
আর এক বছর বাদে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্ণ হবে। আর গত বছর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হয়েছিল। এ দীর্ঘ পথযাত্রার আমিও তো এক ক্ষুদ্র বালুকণা। সে বালুকণারও আছে এক হিরণ্ময় স্মৃতি জীবনের পাতায় পাতায়।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo. com