মহান মহিষদের দেশপ্রেম

>

আষাঢ় মাসে আজগুবি সব গপ্পগাথা বলা বাঙালির ঐতিহ্য। এই সংখ্যায় থাকল সমকালীন তিন লেখকের লেখা কল্পনার রঙে রঞ্জিত তিনটি উদ্ভট আষাঢ়ে গল্প

তার নাম নাটু। অবিশ্বাস্য এক চরিত্র।

সামান্য এটুকু লেখার পর বলপয়েন্ট আমলের নামি কলমটা বেঁকে বসে। নতুনের এমন দশা হবে কেন? প্রশ্ন মনে জেগেছে, উচ্চারণ করা হয়নি। মানুষের মনের কথা আজকালকার কলম বুঝে ফেলে নাকি!

: অবাক হওয়া ছেড়ে দিন। জেনে বলছি, আপনাদের অভিধানে অবিশ্বাস্য শব্দটা ঝাপসা হয়ে গেছে। কদিন পর মিলিয়ে যাবে শূন্যে।

নিজ কানে শুনতে পেলেও ডানে–বাঁয়ে চোখ ঘোরায় নিসার।

: স্পষ্ট শুনেছেন, তবু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। ঘর খুঁজছেন।

নিসার রহমান নিশ্চিত হয়, সাদা পৃষ্ঠার ওপর উবু হয়ে থাকা কলমই কথা বলছে।

: জানি, আজকাল সম্ভব–অসম্ভব, ভুল–ঠিকের ভেদ বুঝে ওঠা কঠিন। ভুল বলেছি? কাল রাতে আপনারা, বন্ধুরা অনলাইন আড্ডায় ভূতের গল্প বলতে বসলেন। অর্ধডজন বলাবলি হলো, তারপর শেষমেশ ভূত বলে কিছু নেই বলে আড্ডা শেষ হলো। ভাবখানা, বয়স অর্ধশত বছর পার হয়ে গেলেও গতকাল গল্প শুরুর আগপর্যন্ত সবাই জানতেন, ভূতেরা মিথ্যা নয়।

নিসার একটু নড়েচড়ে বসে। লিখতে বসে গল্পের চরিত্রদের কেউ কেউ হাজির হয়ে যায়, তাদের কারও কারও সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে বহুবার। সে অভ্যাসে কলমের কাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে দেখতে মন চায়।

: ভাবছেন, সামান্য দামের বলপয়েন্ট কলম, দয়া করে শুনে দেখি তাকে।

: তা মোটেও ভাবছি না। যেকোনো নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া উপকারে আসে। উপন্যাস, গল্প লিখতে তো আটঘাট বেঁধে বসি না।

: আটদিকের ঘাটই খোলা রাখেন স্যার, খোলা রেখে লাভ হয়।

: হুম, লেখা নিজে শুরু করে দিতে হয়, তারপর আসতে থাকে।

: ছক কেটে বসেন, তারপর ধীরে সেটা ভাঙতে থাকে। ভাঙা পথ বাড়ে। সব কটি দিক দিয়ে সরবরাহ পেতে থাকেন—লেখা এগোয়। আমি ও আমরা টেবিলে থেকে তেমনই দেখে থাকি।

কঠিনের ব্যাখ্যা সহজেই করে সে। কলম হাতে লেখকের মনে জানবার কৌতুহল।

: বেঁকে বসার কারণটা শুনি।

নিসার পাশে ঢেকে রাখা পানির মগটার দিকে হাত বাড়ায়, তখনই কলম জানায়—

: লিখতে বসে অনেকক্ষণ ধরে শুরু করতে পারছিলেন না, তখন পানি খেয়ে ফেলেছেন, স্যার।

নিসার সময় দেখে।

: স্যার কি সময় দেখলেন নাকি, ঘড়িটা চলছে কি না দেখে নিলেন!

: আমাকে স্যার সম্বোধন করার দরকার নেই।

: কী বলছেন জনাব। জাদুর কাঠির মতো কাজ করে ওটা। লেখক এবং নামডাক রয়েছে বলে আপনাকে এটা বলতে হয় না। হাত কচলানো, বোকাকাণ্ডে বাহ্ বাহ্ আর অকারণে হে হে যে খুবই কার্যকরী উপকরণ, তা আপনার জানা।

নিত্য শোনা–দেখা বিষয় নিয়ে কথা বাড়ানো মানে সময় মাড়ানো। এখনো সাদা পৃষ্ঠায় মাত্র একটা লাইন। একটু অস্থির ঠেকে। কলমটার মুখ বন্ধ করে রেখে দিয়ে সামনের অসংখ্য কলম থেকে আরেকটা নিয়ে লেখা শুরু করার কথা ভাবে নিসার। খোলা কলম সে কথা বুঝে ফেলে নাকি!

: এর আগে গরুর গাছে ওঠার গল্প শুনেছি। ভেবেছিলাম, আপনি সময়োপযোগী কিছু লিখবেন। যেমন কোনো মহিষ ঠিক করল দুর্যোগকালে বিদেশ চলে যাবে। ভাবামাত্র ভিসা-টিকিট হয়ে গেল।

থামাল নিসার, এমনটা হয়। হয়ে থাকে।

: আচ্ছা লিখুন তবে ছোটকালে আপনার গ্রামের নাটু চোরের গল্প। তারপর আমার যা বলার, বলছি।

: চোর বললে তার পরিচয় অসম্পূর্ণ থাকে। তাকে মানুষ চিনত নাটু চোর নামে।

তিরিশের কোঠায় বয়স। বিয়ে করেছিল। বউ সংসার করেনি। সে জন্য মনে দুঃখ ছিল না। হেসে বলত, ‘জেইনে–শুইনে চোরের সংসার কেডা করতি চায়? গরিব হলিও তো মানুষির মান-সোম্মানের দরকার পড়ে রে ভাই।’

অবাক হয় কলম।

: যে মানুষ-মান সম্মান বিষয়ে এতটা সচেতন...

: সে জন চুরির পেশায় কেন? কারণ, চুরি সে উপভোগ করে। চুরি তাকে আনন্দ দেয়। সে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না, কিন্তু অনেককে বলে বোঝাতে চেয়েছে, রাতের অন্ধকারে পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন খুব সাবধানে নিজের একটা সাধ, ইচ্ছাপূরণের আশায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা, তা জগতের আর কোনো কাজের মধ্যেই নেই।

: বাপ রে! এ কালে জন্মালে দেশবিখ্যাত হতে পারত সে।

: চুরি সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার সময়টাতে প্রতিবারই তার নাকি মনে হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে সাহসী ও সামর্থবান মানুষ সে।

: এসব কথা সে বলেছে, বলত?

: অসংখ্যজন তার মুখ থেকে অগুনতিবার শুনেছে। কারও কোনো কিছু চুরি গেলে মানুষ প্রথমেই খুঁজত তাকে। তার বাসায় হামলে পড়ত না, কর্তব্য হিসেবে চুরির মালের খোঁজ করতে যেত। নাটু চোর সে চুরির জন্য দায়ী না হলে জিব কেটে বলত, ‘ও চাচা, ও ভাই, আমি কাইল রাতি তুমার বাড়ি যাইনি, অইন্য গিরামে ছিলাম।’

ডাব কাটতে কাটতে বলত, ‘এই ডাব চুরি করে আনিছি কাইল অমুকির বড়ি থেইকে। নেও, পানিটা খেইয়ে দেখো, খুবই মজার।’

পিড়ি পেতে দিত, ‘নেও, বসে খাও। ধর্মে বলে, পানি বইসে খাতি হয়।’

: মানুষ তার কথায় বিশ্বাস করত?

: হ্যাঁ, কারণ মিথ্যা বলত না সে। সে বলত, আমি মন্দ কাজ করি, মানুষ মন্দ না।

চুপ করে থাকে কলম।

: কথা নেই কেন?

: তখন গ্রামে আর কোনো চোর ছিল না?

: তার মতো ছিল না কেউ। সেটা তো ভূরিভূরি চোর থাকার কাল নয়। নাটু ছাড়া যে দু-একজন ছিল, তাদের চোর হিসেবেই গণ্য করত মানুষ। তাদের বিশ্বাস করত না কেউ। মিথ্যা বলত। অপরাধবোধ ছিল তাদের। মানুষের নজর এড়িয়ে চলাচল করতে হতো। চুরির অভিযোগে প্রায়ই থানা-পুলিশ খুঁজত এবং মাঝেসাঝে হাজতবাসও কপালে জুটত তাদের।

একটু কাঁচুমাচু করতে দেখা গেল কলমটাকে।

: স্যার, ডজন ধরে কিনলে আমার দাম হবে ছয় টাকার সামান্য কম। ছোটমুখে বড় কথার মতো শোনালেও বলি, নাটু চোরের গল্পটা এখন ক্রিকেটের ভাষায় লুজ বল। আপনি বড় ব্যাটসম্যান হলেও ও বল পিটিয়ে এই ক্রিজে বাউন্ডারি হাঁকানো যাবে না। যে ক্রিজে খেলতে হচ্ছে, খেলোয়াড়েরা পরিচয়ে খেলোয়াড়। ডাকাতিতে মহাতারকা। তারা সংখ্যায় বহু। সবারই গোড়া শক্ত। তাই সুযোগ্য ও সম্মানিত। তাদের বোলিং ক্ষুরধার আর ব্যাটিং ক্যারিয়ার শতক, জোড়শতকে পূর্ণ। মান-সম্মান বাঁচাতে এই নাটুদের কারও স্ত্রী সংসার ত্যাগ করেছে শোনেননি।

একটানা বলে থামে কলম। মানুষ হলে বলা যেত দম নেয়। মানুষের মতোই গলা দুস্তর নামিয়ে ঘনিষ্ঠজনের ঢঙে বলে, আপনি নাটু চোরকে বিশেষ না ভেবে অন্য খুচরো চোরদের বিষয়ে ঘন করে ভেবে দেখতে পারেন। সেকালে বেচারা ছিল তারা, একালেও তেমনেরা তাই। মানুষ ও পুলিশ উভয়ে মনের আশ মিটিয়ে তাদের মতোদেরই অপছন্দ করে, চোর ভাবে। তারা যেন হাতে হাতে সান্ত্বনা পুরস্কার। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো চুরির মাপের চেয়ে অধিক মাত্রায় তাদেরকে শাস্তিদান করে হা হা হা অট্টহাস্য করা যায়।

নিসার রহমান নিজের চোখে দেখা আর নিজের কানে শোনা ঘটনাটা কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারবে না ভেবে মন খারাপ করে। নাটু চোরকে নিয়ে অন্য দিন অন্য কোনো গল্প লিখবে ভাবে। লিখে ফেলা লাইনটা কাটে। মনে নতুন একটা গল্প ঠান্ডা হাওয়া ছড়িয়ে ছাইরঙা মেঘ হয়ে উড়ে আসে। গল্পের আগে নামও মিলে গেল একটা। নিসার কেটে দেওয়া লাইনটার পরে লেখে, মহান মহিষদের দেশপ্রেম।