সন্দেশের লুৎফর ভাই

আজ প্রয়াত হয়েছেন সন্দেশ প্রকাশনীর প্রকাশক লুৎফর রহমান চৌধুরী। তাঁকে শ্রদ্ধা।
লুৎফর রহমান চৌধুরী
লুৎফর রহমান চৌধুরী

‘সন্দেশ’ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারীর নাম যে লুৎফর রহমান চৌধুরী—এটা আমরা কজনই–বা জানতাম বা জানলেও সম্বোধনে রাখতাম! আমাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘সন্দেশের লুৎফর ভাই’। প্রথম দর্শনে ভীষণ কাঠখোট্টা একজন মানুষ কিন্তু গভীরে গেলে অনুধাবনে আসত তাঁর হৃদয়বত্তা। আজকাল অবশ্য গভীরে যাওয়ার অবকাশ কজনের হয়! তবু আমরা কোনো না কোনোভাবে যারা তাঁর নিকটে গেছি, তারা আজ তাঁর আকস্মিক বিয়োগবার্তায় বিহ্বল হয়ে আছি৷ এমন তো নয় যে তাঁর সঙ্গে খুব আড্ডা হতো, এমন তো নয় যে তাঁর প্রকাশনী থেকে আমার বই বের হয়েছে, তবু তিনি আপন মানুষ হয়ে গেছেন নিবিড় নিরায়াসে।

সন্দেশ আমার কাছে এক আনন্দ আশ্রমের নাম ছিল আমার বন্ধু ও লুৎফর ভাইয়ের স্বজন হেলালউদ্দিন হৃদয়ের সূত্রে। একটা বড় সময় সেই সন্দেশে বসত আর জাহাঙ্গীরনগর থেকে সদ্য পড়াশোনা শেষ করে আমি তখন ঢাকা শহরের অনিয়মিত বাসিন্দা। নানা জায়গায় কাজ শেষে আড্ডা দিতে আসতাম হৃদয়ের কাছে, আজিজ মার্কেটে সন্দেশের বিক্রয় বিপণিতে। খাওয়া-দাওয়া-চা-নাশতার ফাঁকে সেখানেই বসে পড়েছি সন্দেশ প্রকাশিত জি এইচ হাবীব, বেলাল চৌধুরী, অদিতি ফাল্গুনী অনূদিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বই, আইজাক আসিমভের বই, ইয়াস্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগৎ’, সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদ কবিতাবই ‘বিম্বিত কবিতাগুচ্ছ’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ভ্রমণকাহিনি, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর আত্মজীবনী কিংবা মাহমুদুল হকের ‘মানুষ মানুষ খেলা’। অবাক হয়ে ভাবতাম, এক প্রকাশক কত বৈচিত্র্যপূর্ণ পাণ্ডুলিপির খোঁজ রাখেন। এখানে আরেকটি বলার কথা হলো, ওরিয়ানা ফাল্লাচির বিশ্বখ্যাত ‘লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন’-এর আনু মুহাম্মদ-কৃত অনুবাদ ‘হাত বাড়িয়ে দাও’-এর মতো স্বল্পমূল্যের মহার্ঘ বই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কত বন্ধুবান্ধবের জন্মদিনে যে উপহার দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই কোনো!

তো, সন্দেশে বসে ভাবতাম এই সব বইয়ের প্রকাশককে কাছে পেলে কথা বলব, বই বাছাইয়ে তাঁর বৈদগ্ধ্যের প্রতি মুগ্ধতা জানাব। তবে যখনই তিনি দোকানে আসতেন, সেখানের কর্মীরা এত তটস্থ হয়ে উঠত যে আমি কখনো পরিচিত হওয়ার অবকাশই পাইনি৷ ধারণা করতাম, খুব রাশভারী আর বদমেজাজি মানুষ তিনি।

পরিচয় হলো অবশ্য একদিন প্রয়াত লেখক শান্তনু কায়সারের সূত্রে। সন্দেশের পাশাপাশি লুৎফর রহমান চৌধুরী ‘বুক ক্লাব’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন৷ সেখান থেকে শান্তনু কায়সারের সম্পাদনায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি বেরিয়েছিল৷ সেটার কপি আমাকে দিতে শান্তনু স্যার নিয়ে গিয়েছিলেন লুৎফর ভাইয়ের কাছে৷ তারপর আমার বন্ধু হেলালউদ্দিন হৃদয়ও সরকারি চাকরি নিয়ে চলে গেল সন্দেশ ছেড়ে অন্যত্র। তখন আমার সন্দেশাভিমুখে আসাযাওয়াতেও ছেদ পড়ে৷ তবে লুৎফর ভাইয়ের প্রকাশনার বইপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ না হয়ে তো উপায় ছিল না কোনো। গোলাম মুস্তাফার ‘বঙ্গভঙ্গ ও তৎকাল’ থেকে সাজ্জাদ শরিফের ‘যেখানে স্ট্যাচু মানে লিবার্টি’র মতো ভিন্ন স্বাদের বই দেখে বুঝেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকাশকের বৈচিত্র্যপিপাসা প্রবল হয়েছে৷ আহমাদ মোস্তফা কামাল, আফসানা বেগম, রাশিদা সুলতানার বই প্রকাশ শুধু নয়, বইমেলার স্টলে তাঁদের সচিত্র প্রচারণা দেখে ভালো লাগত খুব৷ অনেক বিশিষ্ট প্রকাশক যখন ‘খ্যাতিমান'-দের প্রচারণাই চালান তাঁদের বইমেলা-স্টলে, লুৎফর ভাই তখন ‘তারুণ্যবান্ধব’ বাক্যবন্ধটা ব্যবহারিক স্তরে প্রমাণ করে গেছেন।

অনেক বিশিষ্ট প্রকাশক যখন ‘খ্যাতিমান’-দের প্রচারণাই চালান তাদের বইমেলা-স্টলে, লুৎফর ভাই তখন ‘তারুণ্যবান্ধব’ বাক্যবন্ধটা ব্যবহারিক স্তরে প্রমাণ করে গেছেন।

তাঁরই মতো অতি আকস্মিক শান্তনু কায়সার প্রয়াত হলে তিনি বিদেশ থেকে আমার ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়ে তাঁর শোকস্তব্ধতা প্রকাশ করেছেন। আর আফসোস, ‘শান্তনু কায়সার স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশের সময় কতজনকে লেখার জন্য বলেছি, কিন্তু ভ্রমবশত লুৎফর ভাইকে বলা হয়নি। বইটি চারুলিপি প্রকাশনে দেখে তিনি ফোন করে আমাকে একটু অভিমানী ক্ষোভই জানালেন, আবার এটা বলতেও ভুললেন না, ‘ভালো একটা কাজ করেছেন৷ আমাদেরই তো করার দরকার ছিল।’ প্রশংসাকৃপণ সমাজে এইটুকু কজনই বলে ইদানীং!

২০১৭ সালে কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায় গিয়ে হঠাৎ শুনি, নন্দনপ্রাঙ্গণে কে যেন আমাকে ডাকছেন পেছন থেকে। ফিরে তাকিয়ে দেখি লুৎফর ভাই। বললেন, ‘আসেন, একটা ছবি তুলে রাখি আপনার সাথে।’ আশ্চর্য, পরে তাঁর ফেসবুকে দেখি, ছবিটা পোস্ট দিয়েছেন আমার সম্পর্কে অনেক শংসা-বাক্যসমেত। পরদিন মেলাপ্রাঙ্গণে দেখা হতেই হেসে বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাদের অনেকের লেখাই নিয়মিত পড়ি।’ আমি জানি, আরও অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে৷ আপাতদৃষ্টে গম্ভীরতার প্রতিমূর্তি কিন্তু ভেতরে এক ভালোবাসার বহতা সরোবর৷ যে ভালোবাসা টের পেলাম কলকাতায় গত বাংলাদেশ বইমেলার কালে এক বৃষ্টিব্যাপক সন্ধ্যারাতে। কলকাতার অভিযান প্রকাশনের প্রকাশক মারুফ ভাইয়ের আমন্ত্রণে তাঁর কলেজ স্ট্রিট অফিসে আড্ডা দিতে গেছি। লুৎফর ভাইয়েরও আসার কথা ছিল৷ বৃষ্টি দেখে বাতিলও করেছিলেন৷ কিন্তু মারুফ ভাইয়ের কাছে আমার কথা শুনে প্রায় কাকভেজা হয়ে এলেন রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটের অভিযান অফিসে। সেদিন তিনি বলছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে শারজাহ-বিশ্বের বড় বড় বইমেলা ভ্রমণের স্মৃতি। আড্ডা দিতে দিতে তিনি আমাদের রীতিমতো উসকে দিলেন তুরস্ক যাওয়ার ব্যাপারে। যেমনটা তিনি অনেকের জন্যই করতেন৷ আসামে বাংলাদেশের বইয়ের বাজার সৃষ্টির জন্য আমাদের তরুণ প্রকাশকদের যেভাবে তিনি উৎসাহিত করেছেন, সেটা আজকাল কে করে অন্য কারও জন্য! বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতের জ্ঞানগত ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য তিনি গত কয়েক বছর নানা প্রশিক্ষণমূলক কাজে যেভাবে নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা ও শ্রম দিয়েছেন, তা বিশদে বলতে পারবেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নেতৃবৃন্দ।

লুৎফর ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আজিজ সুপার মার্কেটের দীর্ঘদিনের গ্রন্থগত ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।

আমি শুধু তাঁর হৃদয়বত্তার একটি গল্প বলেই শেষ করব। গত একুশে বইমেলায় একজন সম্মানিত অতিথির আগমন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়লে আমার হঠাৎই মনে পড়ল লুৎফর ভাইয়ের নাম। কারণ, কলকাতার আড্ডায় তিনি বলছিলেন ওরহান পামুকের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার কথা। আমাদের মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে বলতেই তিনি ফোন করলেন লুৎফর ভাইকে৷ আশ্চর্য, বইমেলার ঠিক আগে নিজের কাজ ফেলে তিনি একাডেমিতে চলে এলেন আমাদের হয়ে ওরহান পামুককে ই–মেইল করতে৷ আমি কী কাজে যেন একাডেমির বাইরে ছিলাম।

কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায় প্রকাশক লুৎফর রহমান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদ
কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায় প্রকাশক লুৎফর রহমান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদ

এসে দেখি লুৎফর ভাই আমার জন্য ভরদুপুরে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন বর্ধমান হাউসের নিচে। নিজের সময় ব্যয় করে একটি জাতীয় কাজের জন্য এমন আন্তরিকতা আজকাল কি খুব সুলভ! লুৎফর ভাই মেইল করলেন পামুককে, তবে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় পামুকের আসা হলো না। আমাদের চেয়ে লুৎফর ভাইয়ের যেন ব্যর্থতাবোধে বেশি খারাপ লাগছিল। পরদিন ফোন করে বললেন, কাজু ইশিগুরোর আসার ব্যাপারে কি কথা বলব? তখন বইমেলার কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় বিষয়টা আর এগোয়নি, তবে লুৎফর ভাইয়ের স্বতঃপ্রণোদিত এই সহায়তার কথাটি সব সময় মনে থাকবে।

লুৎফর ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আজিজ সুপার মার্কেটের দীর্ঘদিনের গ্রন্থগত ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। জানি না তাঁর প্রকাশনী সংস্থাটির ভবিষ্যৎ কী হবে!

তবে বহিরঙ্গে রুক্ষ অবয়বী কিন্তু এটা নিশ্চিত অন্তরঙ্গে কুসুমিত-প্রাণ লুৎফর রহমান চৌধুরী আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর থাকবেন বহুকাল।

 

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]