অরুণ সেনকে প্রণতি

>সম্প্রতি মারা গেছেন অধ্যাপক অরুণ সেন। কলকাতাবাসী এই লেখকের বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণ ও উচ্ছ্বাস ছিল প্রবল। তাঁকে শ্রদ্ধা।
অরুণ সেন
অরুণ সেন

অধ্যাপক অরুণ সেনকে জানা ও চেনার আগেই ১৯৯৫ সালে তাঁর লেখা একটি গ্রন্থ আমার হাতে আসে, বইটির শিরোনাম ‘কবিতা: এই সময়ের পাঠ’( প্রকাশক: প্রতিক্ষণ)। এই বইয়ের নারীদের রচিত কবিতা পাঠবিষয়ক একটি অধ্যায় আমাকে ভীষণভাবে আপ্লুত ও আলোড়িত করেছিল। সেই অধ্যায়ে তিনি একের পর এক উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন সমকালীন নারীদের রচিত কবিতায় নারীর অন্তর্জগৎ, জীবনবাস্তবতা, স্বপ্ন প্রভৃতি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কীভাবে প্রকাশিত হয়। সেই থেকে সচেতন হয়ে উঠি কাব্য পাঠের প্রতি, কবি নর বা নারী হলে কীভাবে কবিতায় কবির লৈঙ্গিক অবস্থান প্রতিফলিত হয়, সে বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করি। অরুণ সেনের কাছ থেকে পাওয়া আধুনিক নারী কবিদের কবিতা পাঠের সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে মধ্যযুগের নারী কবি চন্দ্রাবতীর রচিত ‘রামায়ণ’ পাঠেও বিশেষ সহায়ক হয়েছিল বৈকি। ‘কবিতা: এই সময়ের পাঠ’-এর আরেকটি অধ্যায়ে বাংলাদেশের কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতার নন্দনতত্ত্ব ও লোকায়ত জীবনের অবলোকন পাঠেও অভিভূত হয়েছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম মোহাম্মদ রফিকের কবিত্বশক্তির বৈশিষ্ট্য।

এর ঠিক ৫ বছরের মাথায় ২০০০ সালে অরুণ সেনকে নতুনভাবে খুঁজে পাই। সে বছর বগুড়ার দুই বাংলার থিয়েটার প্রকাশন থেকে তাঁর রচিত ‘সেলিম আল দীন: নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র’ শীর্ষক একটি অভিনব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উপর্যুক্ত গ্রন্থে বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রস্তুতি ও নিরীক্ষা থেকে শুরু করে সেলিমের শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি নিয়ে কয়েকটি পর্বে আলোচনা-বিশ্লেষণ স্থান পায়, যেমন প্রথম পর্বের আলোচনায় ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’ ও ‘হাত হদাই’ নাটকের পাণ্ডুলিপি ও তার উপস্থাপন নিয়ে আলোচনা রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’ ও ‘হরগজ’ নাটক নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তৃতীয় পর্বে ‘বনপাংশুল’ ও ‘প্রাচ্য’ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এ ছাড়া, ‘সেলিম আল দীনের সমগ্রের সন্ধান’ নামে একটি পর্ব এবং সংযোজন অংশ হিসেবে সেলিমের গ্রন্থালোচনা হিসেবে ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্যের সন্ধান’, সাক্ষাৎকারের আদলে ‘নাটকে আঞ্চলিক ভাষা: একদিনের কথালাপ’ এবং কলকাতার মঞ্চে সেলিম আল দীনের নাটকের প্রদর্শনী নিয়ে ‘কলকাতায় ঢাকা থিয়েটার ও সেলিম আল দীন’ শীর্ষক তিনটি ভিন্ন ধাঁচের রচনা মুদ্রিত হয়েছিল। নাট্যকার সেলিম আল দীনের জীবনের অর্ধশতবার্ষিকী অতিক্রমের উষালগ্নে যখন বাংলাদেশের কোনো সাহিত্য-বিশ্লেষক, গবেষক-লেখক সেলিম আল দীনের নাট্যকীর্তি নিয়ে আলোচনা করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সময় ক্ষেপণ করছিলেন, ঠিক তখনই সাহিত্যের পাকা জহুরি ও গুণবিচারী হিসেবে অরুণ সেন সাহসী একটি ভূমিকা গ্রহণ করেন, তিনিই প্রথম সেলিম আল দীনের সমগ্র সাহিত্যকীর্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থটি পাঠে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সেলিম আল দীন গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়, এখনো যার ধারাক্রম চলমান।

‘সেলিম আল দীন: নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র’ প্রকাশের ৫ বছর পর ২০০৫ সালে যখন সেলিম আল দীন তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশনার সংকলক ও সম্পাদক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করেন, তখন থেকে অরুণ সেনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রপাত। সেই সূত্রে অরুণ সেনকে নানাভাবে অবলোকন করতে থাকি, চোখ মেলে দেখি তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণমূলক গ্রন্থসমূহ—যেমন ১৯৭৭ সালে আশা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘এই মৈত্রী এই মতান্তর: বিষ্ণু দে-কে লেখা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চিঠি অবলম্বনে দুই কবির বন্ধুত্বের ইতিহাস’, ১৯৮৩ সালে অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বিষ্ণু দে: এ ব্রতযাত্রায়’, ভারতের কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমি থেকে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত জীবনীগ্রন্থ ‘বিষ্ণু দে’, প্রতিক্ষণ থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কবিতার দায়, কবিতা মুক্তি’, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘ডালপালার শিকড়’ প্রভৃতি। অরুণ সেনের এসব গ্রন্থ আমাদের ভেতর ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চার করতে থাকে।

অরুণ সেনের সঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে সাইমন জাকারিয়া
অরুণ সেনের সঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে সাইমন জাকারিয়া

দুই
আমরা প্রত্যক্ষ করি, বিচিত্র বিষয় নিয়ে অরুণ সেনের আগ্রহ; সাহিত্যের বিচিত্র শাখা কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক নিয়ে যেমন তাঁর আগ্রহের ডালপালা বিস্তারিত হয়েছিল, তেমনি বাংলা অভিধান থেকে শুরু করে বানানরীতি নিয়েও তাঁর ছিল অনন্ত আগ্রহ, এমনকি চিত্রকলা থেকে ভাস্কর্য হয়ে লোকশিল্পকলার প্রতিও তাঁর ছিল অন্তহীন মমত্ব। ২০১০ সালে কলকাতায় তাঁর বাসায় অবস্থানকালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন দেখেছিলাম, বিশেষ করে মাটির তৈরি উন্নতমানের শিল্পসুষমামণ্ডিত কয়েকটি ভাস্কর্যের মানসপটে ভাস্বর হয়ে রয়েছে, পাশাপাশি দেয়ালে টানানো গ্রামীণ নারীদের করা সূচিকর্মের শৈল্পিক নিদর্শন নকশিকাঁথা দেখেছিলাম। শুধু তা-ই নয়, সে সময় অরুণ সেন আমাকে একটি গ্রন্থ উপহার দেন, গ্রন্থের শিরোনাম ‘যোগেন চৌধুরীর ছবি: ব্যক্তি, দেশকাল ও কল্পনা’। প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে অরুণ সেন ভারতের অন্যতম চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী ব্যক্তিজীবন এবং তাঁর চিত্রকলার রেখা ও রঙে কীভাবে সমকালীন সমাজ-রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছে, এমনকি ভারতীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যবাহী ধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটেছে, তা বিশ্লেষণ করেছিলেন। গ্রন্থটিতে অরুণ সেনের চিত্রকলার নন্দনতত্ত্বের যে জ্ঞান প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে প্রতিমুহূর্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম। যোগেন চৌধুরীর চিত্রকলা নিয়ে অরুণ সেনের এই গ্রন্থটিও অরুণ সেনের বাংলাদেশপ্রীতির ব্যতিক্রমী নিদর্শন হিসেবে শনাক্ত করা যায়। কেননা, যোগেন চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের তৎকালীন ফরিদপুর (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) জেলার কোটালীপাড়ার ডহরপাড়া গ্রামে। যোগেন চৌধুরীর বাবা প্রমথনাথ চৌধুরী ফরিদপুরের জমিদার ছিলেন, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত-বিভাগের পর তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু অরুণ সেনের বিবেচনায় যোগেন চৌধুরী একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষ, আর তাঁর চিত্রকলায় এই অঞ্চলের মানুষের মূর্তি গড়ন ও লোকায়ত চিত্রকলা চর্চার সঙ্গে পরবর্তীকালে প্যারিসে গিয়ে চিত্রকলা অধ্যয়নের জ্ঞানের মিশ্রণ ঘটে, একই সঙ্গে যোগেনের চিত্রকর্মে ভারত বিভাগের পর কলকাতার শরণার্থী শিবিরে দেখা নর-নারীর মুখ উঠে আসে। গ্রন্থটি নতুন একটি অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে আমাদের মনে।

তিন
অরুণ সেনের বাসায় যাওয়ার বহু আগেই সেলিম আল দীনের মুখে শুনেছিলাম, তিনি অত্যন্ত মানবিক বোধসম্পন্ন এক উদার মানুষ। সে কথার সত্যতা পেলাম সেলিম আল দীনের প্রয়াণের কয়েক বছর পর অরুণ সেনের বাসায় অবস্থান নিয়ে। রাতে যখন খাবার টেবিলে খেতে বসলাম, আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, বাসায় অরুণ সেনের স্ত্রীর সহায়ক মহিলাটিও অরুণ সেনের আহ্বানে আমাদের সঙ্গে খেতে বসে গেলেন। সেলিম স্যারের মুখে শুনেছিলাম, অরুণ সেন তাঁর কাজের বাসার সহায়ক মহিলাটির মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, শুধু শিখিয়েছেন বললে যথার্থ হবে না, মাস্টার্স পাস করিয়ে যোগ্য পাত্রে বিবাহ দিয়েছেন। শুনেছিলাম, সেই বিবাহে সেলিম স্যার উপহার হিসেবে শাড়ি পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত দুই কি তিন রাত সেবার অরুণ সেনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই একান্ত আশ্রয়ে অরুণ সেন ও তাঁর পরিবারকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলাম। যখন তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সে সময় তিনি একটি তথ্য দিয়ে আমাকে চমকে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘সাইমন তুমি কি জানো, তোমার “ন নৈরামণি” নাটক নিয়ে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ হতে “সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায়” একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘তাই নাকি?’

অরুণ সেনের বই ‘সেলিম আল দীন: নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র’
অরুণ সেনের বই ‘সেলিম আল দীন: নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র’

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ বেরিয়েছে, আমি পড়েছি।’ পেশাগত জীবনে অরুণ সেন কলকাতার একটি কলেজে অধ্যাপনার কাজ শেষ করে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্য পড়িয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে এবং বারাসাতের পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বাংলাদেশের সাহিত্য বিচারে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক-গবেষকদের মধ্যে অনন্য এক পথিকৃতের ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে মেলবন্ধন করেই সাহিত্য পাঠ করতে অভ্যস্ত ছিলেন।