'চোখ দুটো মাটি খেয়ো না'

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ রোগভোগের পর আজ প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের আধুনিক গানের অন্যতম শিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

কিছুদিন আগে যখন জানতে পেরেছিলাম এন্ড্রু কিশোরের শরীর এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে তাঁকে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, সেদিন হঠাৎই নিজের অজান্তে ঘরে বসে শুনলাম শিল্পীর কন্ঠে 'আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, শুধু চোখ দুটো মাটি খেয়ো না, আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো মিটবে না।' ( কথা ও সুর: আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল) হৃদয় দিয়ে গাওয়া এই গানটি যেন আমাদের সবার মনের কথা বলছে। মনটা চায় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও যেন আমরা দুই নয়নে পৃথিবীর সৌন্দর্য, প্রিয় মানুষের মুখটা দেখতে পাই। এন্ড্রু কিশোর এত দরদ দিয়ে গানটি গেয়েছিলেন যে মনটা ছুঁয়ে গিয়েছিল।

আমাদের তরুণ বয়সের রোমান্টিক শিল্পী ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। সেই শিল্পী আজ চলে গেলেন। দয়াল তাঁকে ডাকল।
যে সময়ের কথা বলছি তখন আজকের মতো ইন্টারনেট, ইউটিউব, স্মার্ট ফোন ছিল না। তাই গান শুনতে হতো রেডিও আর ক্যাসেট প্লেয়ারে। সেই সময়ে ভারতের মান্না দে, হেমন্ত, আশা ও লতার গানের পাশাপাশি আমরা শুনতাম আমাদের দেশের সাবিনা ইয়াসমিন, আবদুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর,সুবীর নন্দী ও রুনা লায়লার গাওয়া সিনেমার গান।

যতটুকু মনে পড়ছে, কলজয়ী এই গায়কের গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্যে ভালো লেগেছিল সৈয়দ শামসুল হকের লেখা 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস' এই গানটিও। করোনাভাইরাসে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখে সেদিন ফেসবুকে এক বন্ধু স্মরণ করেছিল এই গানটি।


এঁদের মধ্যে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশি স্মার্ট ও আকর্ষণীয় চেহারার এক গায়ক। তাঁর গায়কি ঢং আর শ্মশ্রূমণ্ডিত সুন্দর চেহারার অন্যরকম একটা আবেদন ছিল। তাঁর দরাজ গলায় গানের পাশাপাশি এই চেহারাটাও ভালোবাসত সবাই। তাই তো হাসপাতালের বিছানায় ওঁর রুগ্ন চেহরাখানা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
এখনো মনে আছে, হলে গিয়ে 'নয়নের আলো' সিনেমাটি দেখেছিলাম। সিনেমা দেখে গানগুলো এতই ভালো লাগল যে বাসায় আসার সময় নিউমার্কেটের পেছনে ক্যাসেটের মার্কেট থেকে ওই সিনেমার গানের ক্যাসেটটা কিনে নিয়ে এসেছিলাম।
বাাসায় ফিরে আবার সেই গানগুলো শুনলাম আম্মাকে নিয়ে। আম্মা অবশ্য বেশি পছন্দ করেছিল 'আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে' গানটি। এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার কথা শুনে একে একে মনে হচ্ছে এই কথাগুলো।
যতটুকু মনে পড়ছে, কলজয়ী এই গায়কের গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্যে ভালো লেগেছিল সৈয়দ শামসুল হকের লেখা 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস' এই গানটিও। করোনাভাইরাসে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখে সেদিন ফেসবুকে এক বন্ধু স্মরণ করেছিল এই গানটি। আমাদের জীবনের সঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক এই গানটি এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেনও দরাজ গলায়, বড় মায়া মাখিয়ে।
তাঁর কণ্ঠের মধ্যে যে শৈলীটা ছিল, এখন পর্যন্ত আমরা সেটা মনে করতে পারি। 'ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না', 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে','আমি একদিন তোমায় না দেখিলে', এই গানগুলোতে কী যে মায়া! আজ এত বছর পরেও হৃদয়ের তন্ত্রীতে ঘা দেয় এই সব গান।

গত শতকের আশির দশকে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
গত শতকের আশির দশকে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

বোধ করি মানুষের মন-প্রাণে ফেরা, মুখে মুখে ফেরা এই গানগুলোর জন্যই আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে ডাকা হতো 'প্লেব্যাক সম্রাট' নামে। বাংলাদেশের সিনেমার অসংখ্য ভাল গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের নাম।
শিল্পী যেখানে গেলেন, সেখানে যেন ভালো থাকেন। ভালবাসা আর শ্রদ্ধা আমাদের তারুণ্যের এই শিল্পীর জন্য।