নতুন নন্দনের সন্ধানে

‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’-এর প্রচ্ছদ
‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’-এর প্রচ্ছদ

একদিন বিকেলবেলা হাতে তুলে নিলাম ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’। মাসরুর আরেফিনের এই কবিতার বই একটু উল্টেপাল্টে দেখলেই স্পষ্টভাবে কয়েকটা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে পাঠকের। প্রথমত, কবিতাগুলো বড় বড়। হ্রস্ব কবিতার এই যুগে এতগুলো দীর্ঘ কবিতা পাঠকের জন্য বিরল অভিজ্ঞতাই বটে। বইটার ২৩টি কবিতার মধ্যে মাত্র একটি কবিতাই এক পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। অন্যগুলো দুই বা ততোধিক পৃষ্ঠার। দ্বিতীয়ত, কবিতাগুলো গদ্য কবিতা। কোনো কবিতাই প্রচলিত কোনো ছন্দে রচিত নয়। তৃতীয়ত, কবিতাগুলোর আঙ্গিক ও গঠনশৈলী প্রায় একই রকম। এরপরই ধীরে ধীরে, কবিতাগুলোর অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে করতে পাঠক ঢুকে পড়বেন এমন এক জগতে; যেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন এক নতুনতর ও ‘মারাত্মক’ অভিজ্ঞতা নিয়ে।

তাঁর কবিতায় বহু বহু বিষয়, বিষয়ের ইঙ্গিত যুগপৎ একাকার হয়ে থাকে। থাকে পৃথিবী, তথা মানুষের বিধ্বংসী ভয়ংকর রূপ, পরিবেশবাদী চেতনা, নিসর্গের বহুমাত্রিক বর্ণনা, নিজস্ব দর্শন, নতুন নতুন চিত্রকল্প, আপাত অনর্থকতার ব্যঞ্জনা, সময় আর ইতিহাসচেতনা, রাজনীতি, মিথ-পুরাণের বিনির্মাণ প্রভৃতি। তবে কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়ের চেয়েও অধিক গুরুত্ব এর উপস্থাপনগত কলাকৌশলের। অর্থাৎ কী বলা হচ্ছে, তা নয়; বরং কীভাবে বলা হচ্ছে, তা-ই বেশি গুরুত্ব ও মনোযোগের দাবি করে। আমি তাই মাসরুরের কবিতার বিষয়ের চেয়ে এর টেকনিক নিয়েই বলার চেষ্টা করব।

মাসরুরের কবিতা আখ্যানধর্মী ও অ্যাবসার্ড। কবিতার ভেতরে ছোট ছোট গল্প বুনে দেন তিনি। সেসব গল্প বাস্তব ও পরাবাস্তবের দোলাচলে অদ্ভুত, ‘ইন্টারেস্টিং’। যেমন ‘জীবন যেমন জেনেশুনে’ কবিতার এক জায়গায় আছে—‘তাদের’ ঘরে ভুল করে একটা বাদুড় ঢুকে পড়ে ঘরজুড়ে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। জানালা-দরজা খোলা থাকার পরও সে বাদুড় যাচ্ছে না। তার এই না যাওয়ার পেছনের কারণ নাকি, ‘আমরা যে এইভাবে একসাথে থাকি/ এক বিছানা বাথরুম সাবান শ্যাম্পু টয়লেট সব একসাথে/ আর এইভাবে কোনো না কোনোভাবে জীবনকে চাই অর্থ দিতে--/ ব্যাপারটা তার ভালো লেগে গেছে।’ কিন্তু এটুকু বললে যে নিরীহ, সুন্দর একটা বোধ তৈরি হয়, কবিতাটা মোটেও সে রকম নয়। একটু পরই দেখা যাচ্ছে, ওই বাদুড়কে কীভাবে হত্যা করা যায় তার পরিকল্পনা করছে একটা বিড়াল আর একটা ছোট্ট মেয়ে। এখানেই শেষ নয়, পরতে পরতে রং পাল্টাতে থাকে কবিতাটা।

আবার অন্যদিকে তাঁর ‘আমাজন অ্যালেক্সার প্রতি’ কবিতার কয়েকটা লাইন তো রীতিমতো ভবিষ্যদ্বাণীর মতো শোনায়। কেননা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অনেক আগেই তিনি লিখছেন, ‘…অ্যালেক্সা বলো, সেই সব প্লেগ বা অন্য মহামারি যদি/ এইভাবে পৃথিবীকে বেড় দিয়ে ধরে/ যদি শহরে ঢেউখেলা ছাদে চিকিৎসাগৃহের পরে/ ফের, পরে, একসার হাসপাতালই চলে আসে/ যা দেখে রিলকে একদিন লিখেছিল/ মানুষ এখানে, এইখানে, কোনো দিন কীভাবে বাঁচতে আসে?’

মাসরুরের কবিতা পড়তে পড়তে জীবন-জগৎ সম্পর্কে এক ধরনের ফাঁপা, অর্থহীনতার বোধ তৈরি হয়। জন্ম নেয় বিপন্ন ব্যক্তির শঙ্কাবোধ, যে ব্যক্তি নিজ অস্তিত্বের ভেতর জেগে থাকা শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে হতবিহ্বল, একা। এর ফলে আক্রান্ত হতে হয় বিষাদ ও বিষণ্নতায় এবং শেষাবধি আপনাকে গ্রাস করতে থাকে আতঙ্ক আর ভয়।

কবিতাগুলো কত নরম, কোমল; অথচ কত নৃশংস, কত ভয়ংকর, বিধ্বংসী। কবিতার ভেতরের কণ্ঠ যেন সেই আততায়ীর; যাকে নম্র, নিরীহ কোনো প্রেমিকের মতো লাগে। যার স্বর উচ্চকিত নয়; নমিত, শীতল। এর মধ্য দিয়ে যে ফাঁদ, যে ক্যামোফ্লেজ মাসরুর তৈরি করেন; তা তাঁর কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

>তাঁর ‘আমাজন অ্যালেক্সার প্রতি’ কবিতার কয়েকটা লাইন তো রীতিমতো ভবিষ্যদ্বাণীর মতো শোনায়। কেননা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অনেক আগেই তিনি লিখছেন— ‘…অ্যালেক্সা বলো, সেই সব প্লেগ বা অন্য মহামারি যদি/ এইভাবে পৃথিবীকে বেড় দিয়ে ধরে/ যদি শহরে ঢেউখেলা ছাদে চিকিৎসাগৃহের পরে/ ফের, পরে, একসার হাসপাতালই চলে আসে/ যা দেখে রিলকে একদিন লিখেছিল/ মানুষ এখানে, এইখানে, কোনো দিন কীভাবে বাঁচতে আসে?’

নিশ্চিতভাবেই নিজস্ব একটা স্টাইল, রচনাশৈলী তিনি তৈরি করে নিয়েছেন, যা এক ধরনের নতুন সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিভাত হয়।

প্রকৃতি যে তাঁর প্রিয় বিষয়, সেটা বোঝা যায়। আর সেই প্রকৃতির দিকে তাকানো ও বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন পদ্ধতি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আবিষ্কার করেছেন যেন। আবার এমন সব দৃশ্য এনে জুড়ে দেন কবিতায়, যার উপাদানগুলো বাস্তবতাকে অতিক্রম করে আপনাকে ছুড়ে দেবে রহস্যময়তা, প্রহেলিকা আর গোলকধাঁধায়।

মাসরুরের বেশির ভাগ কবিতাতেই জীবন-জগতের নশ্বরতা, অর্থহীনতা, মৃত্যুচিন্তার মতো বোধগুলো অন্তঃপ্রবাহের মতো বয়ে চলে। এ জন্যই বোধ হয় এত নরম করে বলার পরও তাঁর কবিতা পড়লে ভয় লাগে। আর এমন বোধও হতে থাকে যে তাঁর কবিতার মূল চরিত্রটা একজন বিষাদগ্রস্ত ঠান্ডা মাথার খুনি, যে অর্থহীন জীবনে একটা অর্থ আরোপ করতে মরিয়া। ফলে তাঁর কবিতায় প্রায়ই ফুটে উঠতে দেখি অক্ষম ও অসহায়ের নৈরাজ্যবাদী দাঁতচাপা আক্রোশ।

জীবনের মানে, তাৎপর্য খোঁজার মধ্য দিয়ে এর অর্থহীনতা, অন্তঃসারশূন্যতা আবিষ্কার করেন মাসরুর। ফলে যেন অনিবার্যভাবেই, অস্তিত্ববাদী দর্শনের নানা উপাদান ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাঁর কবিতায়। যেমন নৈরাশ্যবাদ, নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্বের সংকট (ব্যক্তিসত্তা থেকেও নেই, না থেকেও আছির উপলব্ধি দেখি ‘কেন চিনতে পারছি না কোনো কিছু’ কবিতায়), উৎকণ্ঠা, ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, বিপন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, সমগ্রের বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যক্তিমানুষের অসহায়ত্ব প্রভৃতি।

কিছু কবিতা পড়তে পড়তে, দীর্ঘ কবিতার কারণেই হয়তো, মনে হয় কোথা থেকে যেন কী হয়ে যাচ্ছে! মনে হয় ধুন্ধুমার ঘটনাপ্রবাহের তোড়ে বিষয় থেকে বিষয়ান্তর যেন পারম্পর্যহীন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কিন্তু পড়া শেষ করার পর কবিতাটার একটা সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে। তখন এর গ্রন্থনা, বিন্যাস, বুননের ছোট ছোট সূক্ষ্ম কারুকাজ জ্বলজ্বল করতে থাকে মাথার ভেতর।