ভুবনপুরের প্রজাপতি

ভোর চারটার দিকে মনিরুজ্জামান সাহেবের ঘুম আচমকা ভাঙল। তার মনে হলো আলেয়া বানু, যার সঙ্গে তিনি সংসার করছেন চল্লিশ বছর, ভালো নেই । শ্বাসকষ্ট বেড়েছে, জ্বরও। ‘তোমার হাতটা একটু দাও, আমি ধরে থাকি,’ আলেয়া বললেন, যেন ভুবনপুরের আকাশে ভেসে, এত আস্তে, ‘তাতে যাওয়াটা কষ্টের হবে না।’

যাওয়া মানে? মনিরুজ্জামান কি মরে গেছে? তিনি লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। বয়সের তুলনায় শরীরটা ভালো, হাতে বলও বেশ। সমস্যা একটাই: বছর যায়, বছর আসে, আর তার স্মৃতিরা মরতে থাকে। এখন সকালের গল্পটা বিকেলে এসে ধূসর এক চাদরের নিচে ঢুকে যায়। তাকে আর পাওয়া যায় না।

তারপরও একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখতে ভোলেননি। সেটি ডাকার জন্য ফোন করতে গিয়ে ভাবলেন, আলেয়ার হাতটা না ধরে কি ভুল করলেন? ভুলের খেসারত অবশ্য তার দুই হাত দিল—বেয়াড়া বাতাসে পড়া কুপির আলোর মতো তারা কাঁপতে থাকল।

ভুবনপুরের জগতে এমন ঘটনাও তাহলে ঘটে! ভোর পাঁচটায় অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে অগস্ত্য যাত্রায় বেরোনো যায়। সব মানুষের ভেতরটা তাহলে পাথরের নয়।

আলো ফোটার কালে মনিরুজ্জামানের মাথা আউলা হয়। তিনি দূরদেশে থাকা প্রভা আর রাজুকে যাত্রার কথাটা জানাতে ভুলে গেলেন। তবে জানাবেন যে আলেয়ার হাত তো ছিল তার মুঠোজুড়ে। যখন মনে পড়ল, মুঠো আলগা হওয়ার অনেক পরে, প্রভাকে এটুকু শুধু বলতে পারলেন, চোখ বোজার আগে মুখে একটুখানি হাসি ধরে ছিলেন আলেয়া, যেন তার কোনো কষ্ট নেই। হাসিটা তিনি বুকে জমা রেখেছেন, এটি তার সম্বল। আর রাজুকে কাফকার গল্প শুনিয়েছেন। পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে ছয়ের বারান্দায় একটুখানি ঠাঁই পাওয়া। এই সব। মানুষের তেলাপোকা হয়ে যাওয়া, অচিনপুরের মরা মাঠে আলেয়ার শেষ ঠাঁই হওয়া। এই সব।

দুই.

রাত আসে, রাত যায়। মনিরুজ্জামানের বুকের ভেতরটাকে মনে হয় যেন মেলাভাঙা মাঠ, শূন্য। ওয়ার্ডরোবের পাল্লা খুলে আলেয়ার শাড়ির ভাঁজে মুখ লুকান, যেন নিজেকে আর না দেখতে হয়। আলেয়ার ফোনে তার হাতের স্পর্শ খোঁজেন।

কাঁদতেও ভুলে যান।

খেতে ভুল করতে থাকলে শরীর অবশ্য একদিন হুকুম দিল, বাজারে যাও। মুখোশের নিচে নিজেকে লুকিয়ে বাজারে গেলেন মনিরুজ্জামান। স্মৃতিকে বললেন, ফেরার পথটা ভুলিয়ে দাও। স্মৃতি বলল, আলেয়াকেও? তিনি দ্রুত বাজার হাতে ফিরলেন। শরীরকে বললেন, আজ থাক, কাল নাহয় সবজিগুলো রাঁধব। আজ পাউরুটিতে সন্তুষ্ট থাকো।

আলেয়ার রান্নাঘরে দুই–তিন ঘণ্টা থাকলে তিনি কি বেঁচে ফিরবেন?

তিন.

এক সকালে তিনি দেখলেন, ফেলে রাখা সবজিগুলো আবর্জনা হয়ে গেছে, কিন্তু আশ্চর্য, কয়েকটা প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে সেসব ঘিরে! সবজি কি তাদের আঁতুড়ঘর? প্রজাপতির জন্মরহস্য তার অজানা, শুধু জানেন ডিম থেকে ডানা পর্যন্ত তারা অবাক বদলায়। কত দিন লাগল তাহলে? তিনি কি কুম্ভকর্ণের ঘুমে ছিলেন? বেঁচেও ছিলেন? কীভাবে? কয়টা পাউরুটি এনেছিলেন বাজার থেকে?

অনেক প্রশ্ন, উত্তর শূন্য।           

প্রজাপতিরা তো ওড়ে নিঃশব্দে। হয়তো তাদের ভুবনে শব্দ হয়, গান হয়, মানুষ শোনে না। কিন্তু এই প্রজাপতিরা যেখানে যেখানে উড়ছে, শূন্য ঘরজুড়ে, শুধু গান বাজছে। মিহি গলার, যেন পাহাড়ের আড়াল থেকে একটা ঝরনা গাইছে। গানগুলো আনন্দের।

তার কান্না পেল। আলেয়াও গাইতেন, মিহি গলায়, তরঙ্গ তুলে। 

চার.

ঘুম ভাঙলে মনিরুজ্জামানের স্বস্তি লাগল, বুক চেপে ধরা পাথরটা আর নেই। হালকা লাগছে। জানালার বাইরে হুটোপুটি বৃষ্টি। ভুবনপুরের আকাশে এখন আষাঢ়, যদিও মনিরুজ্জামানের তা মনে থাকার কথা নয়।

এখন তাহলে উঠতে হয়। পাউরুটি কি আর আছে?

‘পাউরুটি? এটা খাবার জিনিস হলো?’ আলেয়া বললেন।

চমকে, কথা হারাবার আগে, বিভ্রান্ত, বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনিরুজ্জামান শুধু বলতে পারলেন ‘তুমি?’

‘প্রভা এসেছে, রাজুও আসছে। এখন ওঠো। খাবে। অনেক ধকল তো গেল,’ আলেয়া বললেন, তারপর রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

মনিরুজ্জামান দেখলেন, ওয়ার্ডরোবের পাল্লাটা খোলা। শাড়িগুলো কিছুটা এলোমেলো, যেন এখনো তার কান্না ধরে আছে। আলেয়া এটি বন্ধ করেনি কেন? কখনো তো এমন হয়নি?

ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি প্রজাপতিগুলোকে দেখতে পেলেন না। প্রভার ঘরে শব্দ হচ্ছে। রান্নাঘর থেকে মিহি গলার গান ভেসে আসছে। গানটা আনন্দের।

কে গাইছে?