কেউ কোথাও নেই

ফাঁকা এক রেলস্টেশন। ছবি কৃতজ্ঞতা: সাদিয়া মাহ্জাবিন ইমাম
ফাঁকা এক রেলস্টেশন। ছবি কৃতজ্ঞতা: সাদিয়া মাহ্জাবিন ইমাম

ছবিটির মধ্যে কী একটা যেন লুকিয়ে ছিল। ধরতে পারছিলাম না সেটি কী, কিন্তু অনুভব করতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, পুরো ছবিটির মধ্যে একটা শূন্যতা, একটা রিক্ততা, একটা হাহাকার যেন কথা কয়ে উঠছিল। এমন কিছু ছবি নয়, একটি শূন্য রেলস্টেশনের ছবি। কেউ কোথাও নেই, দুটো সমান্তরাল রেললাইন চলে গিয়েছে দিগন্তে। লাল রঙের স্টেশনবাড়িটি কেমন একটি ‘কেউ কোথাও নেই’ এবং ‘কোথাও কিছু নেই’–এর আভাস দিয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মজুড়ে বড় কটি গাছ যেন রহস্যময়তার ফিসফিসানিতে মগ্ন। 

ছবিটি দেখতে দেখতে হঠাৎ করে ছোট্ট পরিত্যক্তপ্রায় রেলস্টেশনটির কথা মনে পড়ে গেল। প্রায় ৩০ বছর আগে কাজ উপলক্ষে যেতে হয়েছিল নিউজিল্যান্ডে। যেতে হয়েছিল ছোট্ট শহর ওয়াংগানুইতে মাওরি বন্ধুদের আমন্ত্রণে। ছবির মতো জায়গা ওয়াংগানুই—হাজার খানেক লোকের বাস। একটি মূল রাস্তা শহরে এবং মোটামুটি একটি করেই সবকিছু—একটি ডাকঘর, একটি ফুলের দোকান, একটি গাড়ি সারাইয়ের জায়গা ইত্যাদি। শহরটির একটি মাত্র রেলস্টেশন আমার মন কাড়ল। সাদা স্টেশনবাড়ি, পাথরের প্ল্যাটফর্ম, ছোট্ট একটি বইঘরও আছে সেখানে। সারা দিনে গোটা তিনেক রেলগাড়ি যায় এ স্টেশনের মাঝ দিয়ে। একটু দূরে শহরের একমাত্র গির্জার চূড়া। বেশ একটা খেলা খেলা ভাব।

দিন পাঁচেক ছিলাম ওয়াংগানুইতে। সকাল-বিকেল স্টেশনে যাই, ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখি, দেখি স্বল্প কিছু লোকের ওঠা-নামা। একদিন কী মনে করে বিকেলের দিকের রেলগাড়িতে উঠে বসলাম—একদম একা, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। এটা আমি প্রায়ই করি নানান জায়গায় ‘দেখা যাক, কোথায় রেলগাড়ি আমায় নিয়ে যায়’—এমন একটা ভাব করে। সেদিনও এর ব্যত্যয় ঘটল না।

জানালার ধারে বসেছি। সুন্দর আবহাওয়া, মিষ্টি একটা বাতাস। নীল আকাশে একটা–দুটো মেঘ ভারী আলস্যে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। ছোট্ট ট্রেন ছোট ছোট স্টেশনে থামছে। সাময়িক ব্যস্ততা, একটু হইচই প্ল্যাটফর্মজুড়ে। তারপর আবার শান্ত সুনসান চারদিক।

এমন করতে করতে রেলগাড়িটি অজগরের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে একটা ছোট্ট স্টেশনে এসে থামল। বহু পুরোনো স্টেশন, পরিত্যক্তপ্রায়। ধূসর রঙের স্টেশনবাড়ি, একটু দূরে সাদা রঙের কাঠের বেড়া। কিছু একটা ছিল জায়গাটার মধ্যে, কেমন যেন রহস্যময়ভাবে স্টেশনটি ডাকছিল আমায়। নেমে পড়লাম।

নেমেই যে কথাটি মনে হলো, তা হচ্ছে, আমি একা, ভয়ংকর রকমের একা। কেউ নামল না এ স্টেশন থেকে, কেউ উঠলও না। জনমনিষ্যিশূন্য জায়গা। কোনো কাকপক্ষীও নেই কোনো দিকে। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। আর স্টেশনজুড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসে কেমন একটা মাদক গন্ধ, পাশের বনের মধ্যে কেমন একটা ফিসফিসানি। মনে হলো কারা যেন আমার ওপর নজর রাখছে। সারা শরীরে একধরনের শীতল কাঁপুনি অনুভব করলাম। মনে হলো, এ হঠকারিতার দরকার ছিল না।

পায়ে-পায়ে এগোলাম স্টেশনবাড়িটির দিকে। দরজা হাট করে খোলা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। কিংবা মনে হলো, কেউ ছিল, এইমাত্র উঠে গেল। ধূলিধূসরিত টেবিল, কাগজপত্রের ডাঁই, দোয়াত-কলম। তার পাশে একটি টরেটক্কা যন্ত্র। কোনায় জলের কুঁজো, পাশে একটা ভাঙা চেয়ার। বিকেলের বাতাসে টেবিলের কাগজগুলো ফর ফর শব্দ করছে।

‘তুমি কি কিছু খুঁজছ?’ ঘাড়ের কাছে মৃদু নরম স্বরে কারও জিজ্ঞাসা। চমকে তাকিয়ে দেখি এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ, অনেকটা হেমিংওয়ের মতো চেহারা। আমি কিছু বলার আগেই বললেন, ‘কেন নামলে এইখানে? জানো না, প্রতি মাসে একবার শুধু একজন নামে এ স্টেশনে—উইলসনদের আর আমার জন্য মাসের জিনিসপত্র নিয়ে। আর কোনো দিন এ স্টেশনে কেউ নামে না, কেউ ওঠেও না।’ বলে একটু থামলেন ভদ্রলোক। ‘কিন্তু’, আমি কিছু বলার চেষ্টা করি। মনে হয় ভদ্রলোক বুঝেছেন, আমি কী বলব। তার আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, ‘তবু স্টেশন আছে। প্রতিদিন একটি গাড়ি যায়, একটি গাড়ি ফেরে। আমি এ স্টেশনের স্টেশনমাস্টার।’

>

নেমেই যে কথাটি মনে হলো, তা হচ্ছে, আমি একা, ভয়ংকর রকমের একা। কেউ নামল না এ স্টেশন থেকে, কেউ উঠলও না। জনমনিষ্যিশূন্য জায়গা। কোনো কাকপক্ষীও নেই কোনো দিকে। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। আর স্টেশনজুড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসে কেমন একটা মাদক গন্ধ, পাশের বনের মধ্যে কেমন একটা ফিসফিসানি। মনে হলো কারা যেন আমার ওপর নজর রাখছে। সারা শরীরে একধরনের শীতল কাঁপুনি অনুভব করলাম। মনে হলো, এ হঠকারিতার দরকার ছিল না।

‘কিন্তু উইলসন কারা?’ বেমক্কা প্রশ্ন করি আমি। ‘ও উইলসনরা?’ ভদ্রলোক মৃদু হাসেন। ‘ওরা এই শহরের একমাত্র বাসিন্দা। আমাকে নিয়ে এ শহরেরে লোকসংখ্যা মাত্র তিনজন।’ আমার বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছ না তো? এসো ঘরের মধ্যে এসো। বলি তোমাকে। দেখেছ, রোদ কী রকম চড়চড় করে বেড়ে যাচ্ছে, লু হাওয়ার মতো বাতাস।’ ছায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে ভারী ভালো লাগে আমার—কেমন শেওলার মতো শীতল। এক গ্লাস ঠান্ডা জল আর একটি আপেল আমার সামনে ধরে বলেন, ‘এটা খাও,’ তারপরই বিব্রত হন, ‘আর কিছু নেই আমার কাছে।’

আপেলে কামড় দিতে দিতে তাঁর গল্প শুনি। একদিন এই শহর গমগম করত মানুষে—জমকালো যৌবন ছিল তার। তামার খনির ওপরে ভিত্তি করেই এ শহরের উত্থান ও অগ্রগতি। দিনে–রাতে আধা ডজন রেল এ স্টেশন ধরে যেত। তখনই এসেছিলেন এ ভদ্রলোক এখানে স্টেশনমাস্টার হয়ে। তারপর একদিন তাম্র কোম্পানি লালবাতি জ্বালাল, বন্ধ হয়ে গেল সব ব্যবসা-বাণিজ্য। দলে দলে লোক ছাড়ল এশহর। দোকানপাট উঠে গেল, আবাসিক এলাকা জনশূন্য হয়ে গেল। পরিত্যক্ত একটি রিক্ত জায়গায় পরিণত হলো এ শহর।

স্টেশনমাস্টারের কথা শুনতে শুনতে বাইরে তাকিয়ে দেখি আস্তে আস্তে আলো মরে আসছে, ধূসর সন্ধ্যা নামছে চারদিকে। এবড়োখেবড়ো আঁধার কালো বিড়ালের থাবার মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকতে শুরু করেছে ঘরের আনাচ-কানাচ। ‘যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে’, তবু কোথাও পাখির কলকাকলী নেই, নেই ঘরে ফেরা মানুষের পদশব্দ। বড় অস্বাভাবিক নিশ্চুপ চারদিক।

‘সবাই চলে গেলে উইলসনরা গেল না,’ ভদ্রলোক আবার গল্প শুরু করেন। ‘বহু বছর আগে ওঁদের জোয়ান ছেলেটি তামার খনিতে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যায়। বাড়ির সামনেই ছেলেটির কবর। ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না উইলসনরা।’ তেষ্টা মেটাতে তিনি এক ঢোঁক জল খান। ‘এ শহরে আজ আমরা মাত্র তিন বুড়োবুড়ি থাকি, আর কেউ নেই। প্রতিদিন রাতে আমি ওঁদের ওখানে যাই। চুপচাপ তিনজন রাতের আহার সারি প্রায় নিঃশব্দে। তারপর আমি ফিরে আসি আমার ডেরায়। এই তো আমাদের জীবন,’ কেমন যেন আর্ত শোনায় ভদ্রলোকের স্বর। উঠে গিয়ে কালচে হয়ে যাওয়া প্রদীপটি জ্বালেন তিনি। সে আলো এত ছোট যে ঘরের অন্ধকারকেই সে যেন বাড়িয়ে দেয়।

‘উইলসনদের সঙ্গে দেখা করা যায় না?’ নরম গলায় প্রশ্ন করি আমি। ‘না,’ হঠাৎ করে কঠোর শক্ত গলায় বলেন তিনি। ‘যে রেলগাড়িতে তুমি এসেছ, ১০ মিনিট পরে সেটা আবার এখান হয়ে যাবে। তুমি সেটাতে উঠে ফেরত যাবে।’ তাঁর গলার নির্মমতায় আমি অবাক হই, কী হলো? অমন মৃদু কণ্ঠের মানুষটি ঝট করে খেপে গেলেন কেন? আমার মুখের ভাবান্তর তিনি বোধ হয় টের পান। নিজেকে সংবরণ করেন, তাঁর গলার কোমলতা আবার ফিরে আসে।

‘রাত বাড়লে এ শহর কেমন যেন হয়ে যায়। কারা যেন দখল করে নেয় এ জায়গা। কেমন ফিসফিসানি কথা শোনা যায়। একটা কেমন যেন ঘোর নেমে আসে। তার আগেই তুমি চলে যাবে।’ তাঁর চোখে কি জলের ছায়া দেখলাম? ‘এ শহরের একটা অদৃশ্য মায়াবী টান আছে। বেশিক্ষণ থাকলে তুমি আটকা পড়ে যাবে। দেখছ না, আমি কেমন আটকা পড়ে গেছি বছরের পর বছর ধরে।’ এবার তাঁর নীল চোখে সত্যিই জল দেখলাম, কারণ, তিনি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।

হঠাৎ করে দূরে ঝিকঝিক শব্দ শোনা গেল। বুঝলাম রেলগাড়ি আসছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি, দূরে ধকধক করছে তার আলো। নিকষ কালো অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে মুচড়ে মুচড়ে গাড়িটি এসে থামল প্ল্যাটফর্মে। ‘খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ করে,’ বলে পাশে তাকিয়েছি। দেখি কেউ তো সেখানে নেই। কেমন যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া আমাকে চিরে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভয় পেলাম। লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম সামনের কামরায়। দেখতে চেষ্টা করলাম স্টেশনের নামটি দেখতে, কিছুই দেখতে পেলাম না। হঠাৎ করে মনে পড়ল, সারা বিকেল-সন্ধ্যা একসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোক তো এক লহমার তরেও তাঁর নাম জানাননি। রেলগাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।