আমাদের 'গুগল' বই বিক্রেতা

>নীলক্ষেত। পুরোনো বইয়ের বিচিত্র সমাহার এখানে। তবে করোনাকালে নীলক্ষেতের বইয়ের ব্যবসাতেও এখন ভাটার টান। তবে কি করোনার আঘাতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের গন্ধ? এর মধ্যেই বিক্রির মাধ্যমে হাতবদল হয়ে গেছে ‘মোস্তফা বইঘর’। এখন কোথায় আছেন বইপ্রেমীদের সেই মোস্তফা ভাই? আর এখানকার ‘গুগল’ বই বিক্রেতারাই-বা কেমন আছেন?

 আমার ফরাসি বন্ধু জুলিয়েন বাংলা ভাষা শিখতে খুব আগ্রহী। সে সপ্তাহে দুই দিন বাংলা ভাষা শিক্ষা ক্লাস করে। প্রতিদিন আমাকে (ওর সব বাঙালি বন্ধুকেই) মোবাইলে বাংলায় এক লাইন করে বার্তা লিখে পাঠায়। তাকে একদিন আমি নিয়ে গেলাম নীলক্ষেতে। উদ্দেশ্য ‘আদি বাল্যশিক্ষা’ আর ইংরেজি ‘টিনটিন’সহ ও রকম কয়েকটা বই কেনা, অবশ্যই সস্তায়। বড়লোক কোনো বইয়ের দোকানে হয়তো ওকে নিয়ে যেতে পারতাম, কফি খেতে খেতে বইও কিনতে পারতাম; কিন্তু সেই-ই বলল, এমন জায়গায় সে যেতে চায় যেখানে ‘আসল বাংলাদেশি লোক’ যায়। আমার মনে হইল, যে আসল বাংলাদেশ দেখতে চায় তাকে নীলক্ষেতেই নেওয়া উচিত। তাই নীলচাষিদের ওপর ইংরেজদের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে মুখে ফেনা তুলতে তুলতে হাজির হইলাম নীলক্ষেতে। তেহারির দোকান, ফটোকপির দোকান পার হয়ে হাজার হাজার লোকে ভরা ফুটপাত থেকে সরু গলির বইয়ের দোকানে ঢুকে বেচারার রীতিমতো আক্কেলগুড়ুম!

গলি, তস্য গলি—এসব গলি-ঘুপচি পেরিয়েই ঢুকতে হয় নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের সাম্রাজ্যে। ছবি: অরিন হোসাইন
গলি, তস্য গলি—এসব গলি-ঘুপচি পেরিয়েই ঢুকতে হয় নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের সাম্রাজ্যে। ছবি: অরিন হোসাইন

সেদিন বাংলাদেশও কেন যেন আসল চেহারা দেখাতে উদ্‌গ্রীব ছিল। তাই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এসে নীলক্ষেতের নিম্নাঞ্চল কাদায় ভরে রাখল। আমরা লুঙ্গি তোলার কায়দায় প্যান্ট তুলে ছপছপ করে  ওই কাদার ওপর দিয়ে হেঁটে পলিথিনে ঢাকা কয়েক হাজার বিসিএস, ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিকেল বই পার করে চিপায় মাত্র কয়েক ফুট আকারের এক দোকানে গিয়ে থামলাম। দোকানদারের মাথায় পলিথিন, বইয়ের ওপরও নীল পলিথিন, সে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বইয়ের নাম শুনে চড়া হাসি দিয়ে তরতর করে মই বেয়ে উঠে গেল ওপরে। আর জুলিয়েনের চোয়াল ঝুলে পড়ল বিস্ময়ে।

‘এইটুকু দোকান—যার নিচে কাদা—সেটা আবার ডুপ্লেক্স!’

আমি রহস্যের হাসি হেসে বললাম, এটাই তো এখানকার মজা!

বেশ কয়েকটা দোকান ঘোরার পরেও আমরা বই কিনতে পারি নাই। কারণ দোকানদাররা একটু বেশিই দাম চাইতেছে বলে মনে হইল আমার।

আমি ওকে বললাম, সাদা চামড়া সাথে থাকলে দাম বেশি বলবেই। তুমি বাইরে দাঁড়ালে আমি একা গিয়ে কম দামে কিনে নিয়ে আসতে পারি।

সে কিছুতেই রাজি হইল না।

বলল, ‘ইশ্‌, পুরান বইয়ের দাম আর কয় টাকা বেশি নিবে, এরা গরিব বিক্রেতা! দিলে না হয় একটু বেশি।’

আমি ওসবে রাজি হই নাই। নীলক্ষেতের মামা যা দাম হাঁকবে তার চেয়ে অন্তত এক শ টাকা কমে বই কিনতে না পারলে যেটাকে ইংরেজিতে বলে, ‘কাস্টমার স্যাটিসফিকেশন’ মানে গ্রাহকের সন্তুষ্টি, সেটা হয় না। বিক্রেতারও কেমন বিব্রত লাগে নিশ্চয়ই!

এই নীলক্ষেতের মধ্যেও কিন্তু একদরের দোকান আছে। সেটা মোস্তফা ভাইয়ের দোকান। তার সঙ্গে দরদাম করতে গেল উল্টা বিব্রত হতে হয়। কারণ উনার বলা দামের ওপরে কথা বললে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যান উনি। মাঝে মাঝে বলেন, ‘বাকি টাকা পরে এসে দিয়েন।’

ছাত্রজীবনে সেই কথা মধুর লাগত। এখন লজ্জা লাগে।

সেদিন নীলক্ষেতের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরতে ছিলাম। এ নীলক্ষেত যেন চেনাই যায় না। ফুটপাতে নানা রঙের মাস্ক ঝুলে আছে। ভেতরে অন্ধকার, দুপুরের মতো নির্জন। যেখানে গলির প্রস্থ এক ফুটের কম সেখানে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, নিরাপদ দূরত্ব প্রভৃতি হাবিজাবি পশ্চিমা ধারণার কথা ভেবে হাসিও পাইল, কষ্টও হইল। অল্প কয়েকটা দোকান খোলা। ক্রেতা এতই কম, এক–দুইজন যাওয়ামাত্র মশার মতো তাকে ঘিরে ধরতেছে বিক্রেতারা।

মোস্তফা ভাইয়ের কথা মনে পড়ল তখন। তাঁর দোকান মানে দোকানের বইগুলি বেচে দিয়ে উনি গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। আমার জানতে ইচ্ছা হইল, কী করেন উনি সারা দিন এখন? ফোন করলাম উনার ছেলেকে।

উনার ছেলে সাকিব জানাল, বাড়িতে তার বাপের কোনো কাজ নাই। তাই সারা দিন বই পড়ে।  এখন পড়তেছেন, ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ, শরৎচন্দ্রের জীবনী।

আমার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করল, নীলক্ষেতের হইচই মিস করে না লোকটা?

জিজ্ঞাসা করি নাই। করলাম, ‘মোস্তফা বইঘর’ কি আর খুলবেন নাকি?

সাকিব নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললেন, ‘ওটা তো খোলাই, আমরা বেচে দিছি আরেক দোকানদারকে। বন্ধ তো আর হয় নাই।’

আমি হাসলাম। একসময় আমিও এ রকম ভাবতাম। কয়েকটা বই আর বসবার একটা মোড়া থাকলেই বইয়ের দোকানদার হওয়া যায়।  

ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখে তুরস্কের বই দোকানদার হতে চাইছিলাম। সিনেমাটা বেশ সুন্দর। এক ছেলে তার চরিত্রহীন বাবার এক রক্ষিতার মৃত্যুর সাথে দুর্ঘটনাবশত জড়ায়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পরে তার সম্পত্তির ভাগ দেবার জন্য ওই রক্ষিতার মেয়েকে খুঁজতে তুরস্ক যায় সে। সেখানে গিয়ে মেয়েকে খুঁজে পায় না। একটা বইয়ের দোকান কিনে সেখানে দোকানদারি করা শুরু করে। ওই বয়সে তুরস্ক দেখে আর অমন কফি-স্যুপ বেচা বইয়ের দোকান দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছিল। ভাবছিলাম, বড় হলে তুরস্ক চলে যাব আর বইয়ের দোকান দেব। কারণ, বইয়ের দোকান দেওয়া তো এতই সহজ! ক্যাশে বসে থাকব, বই পড়ব আর কফি খাব।

‘মোস্তফা বইঘর’-এর মোস্তফা ভাই। বইয়ের এই  দোকানটি এখনো আছে। কিন্তু তাঁকে আর দেখা যাবে না এখানে। ছবি: অরিন হোসাইন
‘মোস্তফা বইঘর’-এর মোস্তফা ভাই। বইয়ের এই দোকানটি এখনো আছে। কিন্তু তাঁকে আর দেখা যাবে না এখানে। ছবি: অরিন হোসাইন

তখন পর্যন্ত আমার দেখা বইয়ের দোকান দামপাড়ার ‘ইভা লাইব্রেরি’, আর বাবার সাথে যাওয়া নূপুর মার্কেটে পুরান বইয়ের দোকান, যার মালিক আবার আমার বাবার বন্ধু। এই সব দোকানের না আছে কোনো ছাদ, না কোনো ছিরি। কীভাবে বই রাখবে, তার কোনো সিস্টেম নাই, স্তূপের পরে স্তূপ, এক বিষয়ের সাথে অন্য বই, এক লেখকের সাথে অন্য লেখক। সঙ্গে স্তূপ হয়ে থাকা পুরান বইয়ের গন্ধ। ওই গন্ধটা কি কাগজের, নাকি কাঠের, নাকি এই দুইটা মিলে একটা একক গন্ধ—কে বলতে পারবে সে কথা। মার্কেটের বাকি দোকানগুলি যাই-ই হোক, বইয়ের দোকানের সাইনবোর্ডের মতো মলিন আর প্রাচীন কোনো সাইনবোর্ড সেখানে নাই। আরও ছন্নছাড়া দেখতে বইয়ের দোকানদার। মাথার সব চুল পাকা, এলোমেলো, গায়ে একটা মলিন সাদা শার্ট আর চোখে ভারী চশমা। কিন্তু যে বইয়ের নামই তাকে বলেন, ওই বইয়ের চৌদ্দ গুষ্টি তার মুখস্থ। আমার মনে হইত, বই পড়তে পড়তে তার চোখ যেমন নষ্ট হয়ে গেছে, বইয়ের নাম-দাম মনে রাখতে রাখতে মাথাও হয়ে গেছে তেমন—বইয়ের দোকানদাররা অবশ্যই আধা-পাগল কতগুলি লোক।

চট্টগ্রামের পুরান বইয়ের দোকান থেকে চেরাগি পাহাড়ের ‘বাতিঘর’ হয়ে এসে পড়লাম নীলক্ষেতে। এ এক এমন গোলকধাঁধা, প্রথম প্রথম মনে হইত এখানে আমার দোকান থাকলে আমি পরদিন নিজের দোকান নিজে চিনে খুলতে পারতাম না। এত বই, এত ধরনের, এত বিষয়ের বই আর এত তাদের বয়স! নীলক্ষেতে ভালো করে খুঁজলে বিশ টাকায় কত দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যায় ফুটপাতের ওপরেই, পাওয়া যায় দামি বইয়ের সস্তা সংস্করণ, যার টানে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অমোঘ আকর্ষণের নাম ছিল নীলক্ষেত; আর এখন লেখক হিসেবে সেই পাইরেটেড বইয়ের দোকানগুলিই আমার দুই চোখের বিষ।