এন্ড্রু কিশোর: মৃত্যুর মৌসুমে বিষণ্ন প্রস্থান

>আজ রাজশাহীর খ্রিষ্টান কবরস্থানে চিরঘুমে শায়িত হচ্ছেন সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। গত কয়েক দশক গান দিয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি। কী ছিল তাঁর গান আর গায়কির শক্তি?
গানকে মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো
গানকে মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো

এন্ড্রু কিশোর—সদ্যমৃত এক নক্ষত্রের নাম; মৃত্যুর এই মৌসুমে আমাদের বিষণ্ন ও মৌন করে দিয়ে চলে গেছেন অনন্ত প্রস্থানের দেশে। আজ হিমঘর থেকে প্রথমে রাজশাহীর সিটি চার্চে, পরে সেখান থেকে কালেক্টরেট মাঠের পাশে খ্রিষ্টান কবরস্থানে চিরঘুমে শায়িত হচ্ছেন তিনি। এই শিল্পী কি জানেন মানুষের কত কত স্মৃতির অন্দরে তিনি আছেন? গত কয়েক দিনে কতভাবে কত অতীতের কাছে ফিরে যাচ্ছে সবাই? প্রকৃতপক্ষে একজন তারকা জড়িয়ে থাকেন মানুষের একক ও যৌথ স্মৃতি ও সংবেদনার সঙ্গে। সে অর্থে সংস্কৃতির কারখানায় শুধু তারকাই উৎপন্ন হন না, উৎপাদিত হয় স্মৃতি ও ইতিহাস। স্মৃতি হয়তো অনেকাংশেই ব্যক্তিগত, আর ইতিহাস প্রধানত যৌথতার। তবু স্মৃতি ও ইতিহাসের যোগসূত্র আছেই। এন্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক স্মৃতি ও ইতিহাসের সুউচ্চ মনুমেন্ট। প্রথাগত উচ্চ-সংস্কৃতির ধারণা দিয়ে এই সৌধকে বোঝা যায় না। কারণ উচ্চ-সংস্কৃতি যতটা রবীন্দ্র-নজরুলতাড়িত, তার সিকিভাগ মগ্নতা নেই এন্ড্রু কিশোরদের নিয়ে।


আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে উচ্চ-সংস্কৃতির দুটি প্রধান নিয়ন্ত্রক রূপ আছে; একটি উদার মানবিকতাবাদী ধারা, আরেকটি প্রোলেতারিয়েত রাজনীতি ঘেঁষা মার্ক্সবাদী ধারা। দুটির নেতৃত্ব মূলত মধ্যবিত্তের হাতে। সমাজের ধনিক শ্রেণি প্রথম ধারাটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। প্রোলেতারিয়েত ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা সে ধারার উপভোগ করলেও রাজনৈতিক সমালোচনা হাজির করেন পুরোদস্তুর। এই ঘরানা ‘গণসংস্কৃতি’ অভিধায় সাংস্কৃতিক পণ্যগুলোকে বিচার করার প্রয়াস রাখে। এই দুই ঘরানার মধ্যবর্তী ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ ব্যাপার হলো জনপ্রিয় সংস্কৃতি।


উচ্চ-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও ভোক্তা হিসেবে দুই দলই জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রতি নাখোশ থাকেন কিংবা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। যদি তা বাজারচলতি সিনেমা হয়ে থাকে, তাহলে নাসিকা কুঞ্চনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তার প্রধান কারণ, এক দল মনে করে, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে উচ্চ রুচির অবনমন ঘটে। আরেক দল মনে করে, এই সংস্কৃতি ব্যবসাদার সংস্কৃতি ও রুচির প্রশ্নে নিম্নগামী। কিন্তু দুই দলের ব্যর্থতার জায়গা এই যে, কোনোটিই জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রিয় হয়ে ওঠার প্রবণতাকে রুখে দিতে পারে না। কোনো রাজনৈতিক বা নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনা জনপ্রিয়তাকে দুর্বল করে দিতে পারে না। এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শক্তি এই যে, বহু মানুষের সংবেদনাকে সহজেই সে গ্রাস করে নিতে পারে; প্রচার, পুনঃপ্রচার ও পুনরুৎপাদনের ভেতর দিয়ে বিস্তৃত একটি জায়গা দখল করে নেয় দ্রুততার সঙ্গে।


এন্ড্রু কিশোর উচ্চ-সংস্কৃতির সংগীতায়োজনে যুক্ত থাকা শিল্পী নন; সারা জীবন ধরে গেয়েছেন মূলত চলচ্চিত্রের গান। বাজারি ঘরানার চলচ্চিত্রের বাইরের ছবিতে তাঁকে সাধারণত গাইতে দেখি না আমরা। তাত্ত্বিকভাবে ভাবতে গেলে এই প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রশ্ন তৈরি হয়: এন্ড্রু কিশোর কেন এত প্রিয়তা লাভ করেছেন? কেন কোটি শ্রোতার অন্তরমহলে বেজে ওঠেন তিনি? সরল কোনো জবাব দিয়ে এর ফয়সালা করা যাবে না। তবে একটি প্রশ্ন দ্বিধাহীনভাবে মীমাংসিত, সেটি এই: এন্ড্রু কিশোরের আছে খোলা, স্বচ্ছ, দরাজ একটি কণ্ঠ; যেকোনো গানে তিনি মিশে যান কথার সঙ্গে; যেকোনো কণ্ঠে মিশিয়ে দেওয়া যায় তাঁর কণ্ঠ; সুর আর কণ্ঠের সম্মিলন এমন হয়ে ওঠে যে, চমৎকার একটি গান বেরিয়ে আসে তাঁর গলা থেকে।


আশির দশকের শুরুতে সংস্কৃতি কারখানায় তাঁর আবির্ভাবের আগেই বাংলাদেশে গান ও চলচ্চিত্রের মিলিত ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত। আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রুনা লায়লা প্রমুখ শিল্পী গুরুত্বপূর্ণ সব উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের সিনেমায়। ওদিকে ইউরো-আমেরিকান সংগীতের প্রভাব গায়ে মেখে গড়ে উঠেছে ব্যান্ড সংগীতের নানা দল। রবীন্দ্র-নজরুল ও লোকায়ত গানের পরম্পরা সার্বক্ষণিকভাবে ছিলই। এই প্রেক্ষাপটে কণ্ঠের কারুকাজ ও বিশিষ্টতা ছাড়া কোনো শিল্পীর পক্ষে গানের বিশাল দরবারে বরমাল্য পাওয়া সহজ কাজ নয়। এন্ড্রু পেরেছিলেন কণ্ঠ দিয়ে কণ্ঠহার জয় করতে। তিনি ছুঁয়ে ফেলতে পেরেছিলেন অজস্র মানুষের মন। সবাই তো কান দিয়ে শোনে, কিন্তু মন দিয়ে শোনে কজন? এন্ড্রুর গান স্পর্শ করতে পেরেছিল মনকে। এর, ওর আর অনেকের মন।