অন্তর্লীন অন্ধকার

অরণী বেশ কিছুদিন একই স্বপ্ন বারবার দেখছে। স্বপ্নটি শেষ হতেই প্রতিদিন নিয়মমাফিক অরণীর ঘুম ভেঙে যায় । এরপর বাকি রাত কাটে ঘরের শূন্য সাদা ছাদে নির্নিমেষ চোখ মেলে।

অরণী লক্ষ করে, রাত বাড়তে থাকলেই অন্ধকারের রঙেও বদল আসে। কখনো গাঢ় জমাট বাঁধা কালো অন্ধকারের দৌরাত্ম্য, আবার কখনো ফ্যাকাশে অন্ধকারের উন্মত্ততা। সেসব রং সাদা দেয়ালে ছায়া ফেলে। অনেক রকম ছায়া। সেসব ছায়ার অতল থেকে অদ্ভুত এক বিষণ্ন ঢেউ এসে আঁকড়ে ধরে অরণীকে। পুঞ্জীভূত দীর্ঘশ্বাসের তলায় হাবুডুবু খেতে শুরু করে তার একেকটি রাত।

একটি দরজা-জানালাহীন বদ্ধ ঘরে আটকা পড়েছে সে, এই স্বপ্নই কয়েক রাত দেখছে অরণী।

‘একটি বদ্ধ ঘরে আমি আটকা পড়েছি। বের হওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু দরজা খুঁজে পাই না। বাতাসহীন সে ঘর আমার স্নায়ুতে চাপ দেয়। আতঙ্কিত আমি চিৎকার করে তোমাকে ডাকতে চাই কিন্তু শব্দহীন সেই বিমূঢ় সময় আমাকে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার এক সুড়ঙ্গের ভেতর।’

‘সুড়ঙ্গ না গুহা?’
কৌশিকের এই প্রশ্ন জড়তাগ্রস্ত করে দেয় অরণীকে। প্রশ্নটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কৌতুক সংশয়ে ফেলে দেয় তাকে। এরপর খুবই কাতরভাবে সে প্রশ্ন করে কৌশিককে,
‘আগে কি আমি গুহা বলেছিলাম?’
ঠিক যেন এই বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনার জন্য কৌশিকের সাহায্য চাইছে অরণী।

কৌশিকের প্রতি এই নির্ভরতা অবশ্য তার এক দিনে তৈরি হয়নি। প্রায় বছর তিনেকের পরিচয় ওদের।

বাদামি চোখের অরণীকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিল কৌশিকের। আর এর সঙ্গে ছিল অরণীর উচ্ছলতা। কথায় ছলছল করে হেসে ওঠা মেয়েটি খুব তাড়াতাড়িই আপন হয়ে উঠেছিল কৌশিকের।

কিন্তু এই মানুষ দুটিই অচেনা হয়ে উঠছে ক্রমশ। এই স্বপ্নের দীর্ঘ বৈরী রাত একটু একটু করে অগোচরে বিছিন্ন করছে ওদের।

কৌশিক প্রথম প্রথম বিভ্রান্তি মোচনের সব দায়িত্ব নিয়ে বলত, ‘হোক গুহা বা সুড়ঙ্গ, তাতে কী আসে যায়। সে তো মামুলি এক স্বপ্নই।’
কিন্তু সেই মামুলি স্বপ্ন যখন রাতে রাতে ভোগাতে শুরু করল অরণীকে, তখন কৌশিক মূলতই রূঢ় হয়ে উঠল।

‘কী হয়েছে তোমার? ওগুলো স্বপ্ন নয়, তোমার ভাবনা। বাজে ভাবনা।’

স্বপ্ন শেষ হওয়ার পর বিক্ষিপ্ত রাত অস্থির করে তোলে অরণীকে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা কৌশিকের নির্লিপ্ততা ওকে চেতনারহিত করে দেয়। জাগিয়ে রাখে রাতের পর রাত।
সেসব রাতের নিস্তব্ধতা একটু একটু করে পাঁজরে বসত গাড়ে অরণীর। মর্মান্তিক এক অস্বস্তি জায়গা করে নেয় নিভাঁজ রাতের পরতে।
তার এই বিপন্নতায় বিরক্ত কৌশিককে দেখে আরও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে অরণী।
ঘুম থেকে কৌশিককে জাগিয়ে স্বপ্নের বিভ্রান্তি মোচনের অর্থহীন আবদার করা বন্ধ করে দেয় সে।
আর অরণীর বিক্ষিপ্ত রাতকে পেছন পাশে রেখে নির্দ্বিধায় ঘুমায় কৌশিক।
এভাবেই রাতের সাদা দেয়ালে মূর্ত ছায়াগুলোর মতো অতিশয় বাস্তব বিপন্নতায় এক পা, দুই পা ফেলে দূরে সরে যেতে থাকে অরণী ও কৌশিক।
তবে এই বিষণ্ণ তরঙ্গিত রাতের সঙ্গে যুদ্ধ করার কৌশলও শিখে ফেলেছে অরণী, খুব তাড়াতাড়ি। রাতের রং বদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে অবলীলায়।

তবু যখন ব্যত্যয় হয়, তখনই কৌশিকের স্পষ্ট বিরক্তি, ‘স্বপ্ন দেখেছ আবার? আশ্চর্য! কতবার বলেছি বাজে ভাবনাগুলো বন্ধ করো।’
এই শব্দগুলো বহুবর্ণ রূপ ধরে অরণীর মনের গলি-ঘুপচিতে অস্থির ঢেউ তোলে। প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মেয়েটি মনে করার চেষ্টা করে কোন কোন বাজে ভাবনায় তার সময় আবর্তিত হয়।

না, পারে না মনে করতে। শুধু ভাবনায় জোর ফেলে উদ্ধার করে আনে একটি দিন।

দিনটা এমন ছিল—

কৌশিকের সঙ্গে সেদিন ডিনারে গিয়েছিল অরণী। ‘কালারস অব স্পাইস’ নামের সদ্য ওপেন হওয়া দামি রেস্টুরেন্ট ছিল সেটি। মেইন খাবারের অর্ডার অরণীই করেছিল। আর খাবার শেষে ডেজার্টে তিরামিশু ছিল কৌশিকের পছন্দে।

বাইরে থেকে ডিনার করে আসার পরই কৌশিক বসে গিয়েছিল ল্যাপটপে। স্টাডিরুমে। আর সে রাতে স্কিন কেয়ার শেষ করে অভ্যাসমতো একটি বই হাতে নিয়েছিল—‘দ্য গার্ল বিফোর’।

বইটি চুম্বকের মতো টেনে রেখেছিল তাকে। পড়তে পড়তে কখন যে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি সে। হঠাৎ খুট করে একটি আওয়াজ হলো। আর বেডসাইড টেবিলের আলোটাও কোনো রকম সুযোগ না দিয়ে নিভে গেল দপ করে।

প্রথমে অরণী অবাক হলো।

তারপর যতটুকু না ভয়, তার চেয়ে বেশি দ্বিধা নিয়ে বিছানা ছেড়ে নামল।

ততক্ষণে অন্ধকারের প্রকটতা অনেকটাই কমে এসেছে টেবিলঘড়ির সবুজ আলোর কাছে। শব্দহীন সে ঘরে তখন শুধুই উন্মত্ত ফ্যাকাশে অন্ধকার।

তবে থিতিয়ে আসা সে সময় খুব বেশি প্রলম্বিত হলো না। টেবিলঘড়ির ঝিঁঝিঁ শব্দটি উসকে দিল শব্দের ধারাবাহিকতাকে। এর পরপরই তেড়ে এল আরেকটি শব্দ।

ঘরটির নিভাঁজ নিস্তব্ধতা অসাড় হলো টিকটিকির ‘টিক টিক’ শব্দে। ঘুরে তাকাল অরণী। পেছনের দেয়ালে। একটি নিথর পিতল রঙের টিকটিকি সেখানে।

ঠিক যেন দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পুরোনো কোনো শোপিস। সময়ের প্রাচীনতাকে প্রকট করতেই কারও এই চেষ্টা।

তবে সময়ের আবেদন ঠিক অত সরল ছিল না। বিক্ষিপ্ত সময়ের ছেঁড়াখোঁড়ার ফাঁক গলে তখন উঁকি দিচ্ছিল দুঃসহ আরেক মুহূর্ত।

নিথর টিকটিকি আচমকাই থিতিয়ে আসা সময়কে অগ্রাহ্য করে নড়ে উঠল। অসংলগ্নভাবে দেয়াল বেঁয়ে নেমে এল অরণীর ঠিক পায়ের কাছে। যেন লক্ষ্যটি তার আগে থেকেই স্থির করা ছিল।

তারপরই অরণীকে অপ্রস্তুত করে টিকটিকি উঠে এল পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর। এরপর...

এরপর তো আর মনে নেই। অনেক চেষ্টা করেও সে সময়ের ধূম্রজাল ভেদ করতে পারে না অরণী। এরপর শুধু অন্ধকার একটি রাত। একটি স্বপ্ন। একটি বদ্ধ ঘর আর অন্ধকার গুহা...

‘তাহলে সেটা গুহা ছিল?’
কৌশিকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অরণী আর নিজের স্মৃতিশক্তিতে জোর দিতে পারে না।

‘তুমি বিশ্বাস করছ না আমার কথা?’
অরণীর এই প্রশ্নে কৌশিকের মুখের সূক্ষ্ম হাসি মিইয়ে যায়। মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে বলে, ‘কে বলল বিশ্বাস করিনি। করেছি তো। আর বিশ্বাস থেকেই বলছি, ওটা স্বপ্ন ছিল। তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছ।’

>কিন্তু অরণীর চিৎকার, আতঙ্ক, এই কান্না মিথ্যে নয়। সে জানে, রাত হলেই দেয়ালের ছায়াগুলো একটি সুড়ঙ্গ বানায়। আর সুযোগ পেলেই স্বপ্নটি তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সুড়ঙ্গের ভেতর। তার দম আটকে আসে। একটু বাতাসের জন্য আছাড়িবিছাড়ি করে সে। তবে কৌশিক এটা বিশ্বাস করে না। তার মনে হয়, এগুলো ওই সব থ্রিলার পড়ার দোষ। নয়তো সারা দিন যে মেয়েটি উচ্ছল, চঞ্চল প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়, সে কেন রাত হলেই এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়বে।


এরপর কৌশিকের ‘আমার অরণীকে কোনো কালো বদ্ধ ঘর আটকে রাখতে পারবে না’—আহ্লাদের শব্দগুলো সন্ধি করে এই অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি দেয়ালে।
তারপর প্রায় প্রতি রাতেই অরণী জেগে ওঠে স্বপ্নটি দেখে।
প্রথম প্রথম কৌশিক এই ঘটনাকে উচ্চহাসি দিয়ে গুরুত্বহীন করে দিত। এর কিছুদিন পর সূক্ষ্ম হাসি দিয়ে উপেক্ষা করত। আর তারও পর, এখন বিরক্ত হয়ে ঘটনাটিকে ‘বাজে ভাবনা’ বলছে।
কৌশিক জানে, প্রতিদিন রাতে একজন মানুষের একই স্বপ্ন দেখতে পারে না। সে ভাবে, তার স্ত্রী মিথ্যে বলছে।
কিন্তু অরণীর চিৎকার, আতঙ্ক, এই কান্না মিথ্যে নয়। সে জানে, রাত হলেই দেয়ালের ছায়াগুলো একটি সুড়ঙ্গ বানায়। আর সুযোগ পেলেই স্বপ্নটি তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সুড়ঙ্গের ভেতর। তার দম আটকে আসে। একটু বাতাসের জন্য আছাড়িবিছাড়ি করে সে। তবে কৌশিক এটা বিশ্বাস করে না। তার মনে হয়, এগুলো ওই সব থ্রিলার পড়ার দোষ। নয়তো সারা দিন যে মেয়েটি উচ্ছল, চঞ্চল প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়, সে কেন রাত হলেই এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়বে।
‘তুমি এবার থ্রিলার পড়া বন্ধ করো।’
অরণী প্রশ্নহীন চোখ নিয়ে তাকায় কৌশিকের দিকে। বলে, ‘বইকে প্রতিযোগী ভাবার কারণ নেই।’
অরণী জানে, শুরু থেকেই কৌশিক বই পড়া খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। বইয়ের ভেতর তার ডুব দেওয়াকে কৌশিক তাকে ফাঁকি দেওয়া ভাবে।
কৌশিকের মনে হয়, ওই বইগুলোর একটি নিস্তব্ধ কুঠরি আছে। তাকে উপেক্ষা করতেই এ দিনগুলোতে অরণী প্রবেশ করে সেই কুঠরিতে।
উঁহু, তবে আজ সেসব কথা ভাবতে পারল না কৌশিক।
আজ অরণী যখন ঘুমহীন রাতের যন্ত্রণায় কাতর হচ্ছিল, মর্মান্তিক অস্বস্তিতে প্রায় নিঃশব্দে ঘর টপকে বারবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল একটু দম নেওয়ার আশায়, তখনই সে সিদ্ধান্ত নিল, অরণীকে যন্ত্রণামুক্ত করবে সে। এই বাজে রোগ থেকে মুক্ত করবে অরণীকে।

‘আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম ও একটু অসুস্থ। তুমি বিশ্বাস করোনি তখন।’
এটুকু বলেই টিভির ভলিউম বাড়িয়ে সেদিকে মনোযোগী হয় বড় খালু। কৌশিকের বাকি কথায় তার আগ্রহ নেই।
‘অসুস্থ হলে তো তার চিকিৎসা করাবে?’
বড় খালা চায়ের কাপ কৌশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন।
খালা অরণীকে দেখাশোনা করছেন সেই কিশোরী বয়স থেকে। মা-বাবা হারিয়ে মেয়েটি যখন তাদের জিম্মায় এল, তখন ওর বয়স চৌদ্দ। তখন অরণী শোকগ্রস্ত হলেও অসুস্থ নয় মোটেও। এর কিছুদিন পর আস্তে আস্তে সে শোক কাটিয়ে মেয়েটি এ বাড়িতে উড়ে বেড়াতে শুরু করল।
‘সে সুস্থ, শুধু একটু ভিতু। মা-বাবাহারা মেয়ে তো, অন্ধকার ভয় পায়। ভয়ের স্বপ্ন দেখে।’
মেয়েটার জন্য বড় খালার স্নেহসুর অবশ্য কৌশিক অব্দি পৌঁছাল না।
‘ওসব ভয় না, রোগ। বংশগত রোগ।’
কৌশিক জানে বড় খালুর এই ইঙ্গিত তার মৃত শ্বশুরের প্রতি।
এবার বড় খালার প্রতিবাদী সুর খালুকে চুপ করিয়ে দিল।
‘উনি ছিলেন সৎ মানুষ। বড় অফিসারদের দুর্নীতি ধরে ফেলেছিলেন। তাই মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাকে ছাঁটাই করেছিল। অপমানে মাথাটা একটু ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল।’
এই গল্প কৌশিক অনেকবার শুনেছে অরণীর কাছে। এসবে তার আগ্রহ নেই। সে এসেছে তার স্ত্রীর গার্ডিয়ানদের পরামর্শ নিতে।
‘আরে! পরামর্শ আবার কী? স্বপ্ন দেখে ভয় পেলেই কি তাকে অসুস্থ বলা যায়? ও সুস্থ।’
বড় খালা চায়ের কাপ নিয়ে হনহন করে ভেতরে চলে গেলেন। বড় খালু গভীর মন দিয়ে রাত নয়টার নিউজ দেখছেন।
‘আজ ষষ্ঠ দিনের মতো আমেরিকা উত্তাল বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে।’
কৌশিক উঠে দাঁড়াল বাড়ি ফেরার জন্য। বড় খালুকে পেছনে ফেলে দরজার নব ঘোরালো খোলার জন্য।
‘এসব অসুখ চিকিৎসায় ঠিক হয় না।’
আচমকা শব্দগুলো ছুটে এল। হুট করে ঘুরে তাকাতে গেল কৌশিক। আর তখনই তাড়াহুড়োয় পাশের কর্নার টেবিলে ধাক্কা খেল সে। টেবিলে সাজানো কিছু শোপিস নিচে পড়ে গেল। বড় খালু তখনো মন দিয়ে খবর শুনছেন।
না, অরণী আগে থেকে অসুস্থ ছিল না, কৌশিক জানে। বিয়ের আগে যে কয়েকবার দেখা হয়েছে, তাতে অরণীকে একজন সুশিক্ষিত, উচ্ছল আর রুচিশীল মেয়ে বলেই মনে হয়েছে।
বড় খালুর বাসা থেকে ফেরার পথে কৌশিক তার রুচিশীল স্ত্রীর জন্য অনেক দিন পর একগুচ্ছ দোলনচাঁপা কিনল। দোলনচাঁপার আড়ালে থাকা কৌশিকের ভালোবাসাটুকু অরণীকে আজ দম নেওয়ার একপশলা বাতাস এনে দিল। অনেক দিন পর অরণী রাতের খাবার টেবিলে অনেক গল্প করল। অফিসের গল্প, শপিংয়ের গল্প—সব বলল কৌশিককে।
কৌশিক দেখে তার স্ত্রী আর পাঁচটা সুস্থ মানুষের মতোই। তার গল্প বা আচরণে কোনো অসংলগ্নতা নেই। সে নির্ভার হয়।
কিন্তু অরণী জানে, তার এই নির্ভার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। মধ্যরাতের স্বপ্নের দিকে সে নির্বোধের মতো এগিয়ে চলেছে অন্য পাঁচটা দিনের মতোই।
‘স্বপ্নের ঘরটাতে কোনো জানালা নেই, তাই না?’
অরণী অবাক হয় কৌশিকের প্রশ্নে। তবু স্মৃতিতে জোর দেয়।
‘না, জানালা নেই। দরজাও খুঁজে পাই না।’
‘সত্যি বলছ? ঠিকঠাক মনে করতে পারছ তো?’
অরণী গভীরভাবে তাকায় কৌশিকের দিকে। কৌশিকের চোখ মাটির দিকে। তার ভেতর কোনো অসহিষ্ণুতা নেই। খুব শান্তভাবে আবার প্রশ্ন করে, ‘তুমি মনে করতে পারো এই বদ্ধ ঘর তোমার স্বপ্নে কবে থেকে আসছে?’
মেয়েটির মনে হলো, কৌশিক তার দিকে তাকাতে গিয়েও চোখ নামিয়ে নিল।
অরণী ভাবতে শুরু করে। খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে একদম সঠিক সময়। বয়স তখন চৌদ্দ নাকি তেরো ছিল? ভাবনায় ডুবে গেল সে।
কৌশিক তাকাল অরণীর দিকে। আশপাশের রাস্তা থেকে দু-একটি গাড়ির হর্ন, বসার ঘরের টিভির একঘেয়েমি টক শো আর শোবার ঘরের ঘড়িটার ঝিঁঝিঁ ডাক—এই সব স্বাভাবিকতার মধ্যে তার স্ত্রীকে খুব অস্বাভাবিক মনে হলো।
আর তা আজ প্রথম মনে হলো।
অরণী ঘেমে উঠছে। অন করা এসির মধ্যেও সে ঘেমে উঠছে। অরণী কিছুতেই মনে করতে পারছে না তখন তার বয়স কত ছিল। স্ত্রীকে ভাবার সুযোগ দিয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে এল কৌশিক। মোবাইল থেকে ফোন নম্বরটা বের করে ভেবে নিল, আগামীকাল সাইকিয়াট্রিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কনফার্ম করতে হবে।
অরণীর ভেতর অস্থিরতা বাড়ছে। তখনকার বয়সটা ঠিক ঠিক মনে করতে পারছে না। শুধু মনে পড়ছে বড় খালার বিশাল ওই বাড়িতে তারা মাত্র তিনজন ছিল।
না, ভুল হলো।
অধিকাংশ সময় বড় খালু বাইরে থাকতেন। চাকরির জন্য। সপ্তাহে একবার আসতেন। যখন আসতেন, বড় খালা সব সময় খালুর সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন।
তবে এই সঙ্গে থাকায় ব্যত্যয় হয়েছিল একবার। বড় খালার জা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তখন। তারা দুই জা ছিলেন দুই বোনের মতো। তাই তাকে সেবা করতে হাসপাতালে রাতে থেকে গিয়েছিলেন বড় খালা।
আর সে রাতেই বড় খালু তাকে ডেকে নিয়েছিলেন বসার ঘরে। পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে। টিভিতে তখন রাত দশটার খবর হচ্ছিল।
সেদিন টিভির আওয়াজ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
অরণী সব মনে করতে পারছে, এই বদ্ধ ঘরের স্বপ্ন সেদিনের পর থেকে নিয়মিত আসত। শুধু বয়সটাই মনে আসছে না তার। কত বয়স হবে তখন, চৌদ্দ নাকি তেরো?
কৌশিক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল অরণীকে। বোঝার চেষ্টা করল নতুন কোনো অসংলগ্নতা। দেখল, অরণী কিছু বিড়বিড় করছে আর মাথা নাড়ছে।
কৌশিক নিশ্চিত হলো, অরণীর সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য প্রয়োজন। মনের সবটুকু দ্বিধা দূর হতেই গুনগুন করে উঠল কৌশিক, ‘লেটস স্টে টুগেদার...’
এরপর পকেট থেকে বের করে আনল একটি টিকটিকি। পিতলের টিকটিকি। এই খেলনা টিকটিকি সেদিন রাতে বেডরুমে কৌশিক ইচ্ছা করেই রেখেছিল অরণীর সঙ্গে মজা করার জন্য। সে জানত, অরণী টিকটিকি ভয় পায়।
কিন্তু এটা তখন কৌশিকের অজানা ছিল, এই ক্ষুদ্র মজা অরণীকে আবার নতুন করে নিক্ষেপ করবে দুঃসহ স্বপ্নের সেই বদ্ধ ঘরে। ঠিক এ রকমই আরেকটি টিকটিকি আজ কৌশিক দেখে এসেছে বড় খালার জানালাহীন বসার ঘরে, কর্নার টেবিলে সাজানো। আর অদ্ভুতভাবে সে ঘরের দরজাটিও একটি দীর্ঘ প্যাসেজের পর। যেন কেউ ইচ্ছা করেই ঘরের দরজাটা আড়ালে রেখেছে।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]