তেল গেলে ফুরাইয়া...

হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনার পর রিজেন্ট হাসপাতাল মামলার প্রধান পলাতক আসামি ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (হাতকড়া লাগানো)। ছবি: সাজিদ হোসেন
হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনার পর রিজেন্ট হাসপাতাল মামলার প্রধান পলাতক আসামি ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (হাতকড়া লাগানো)। ছবি: সাজিদ হোসেন

‘তেল গেলে ফুরাইয়া
বাত্তি যায় নিভিয়া
কী হবে আর কান্দিয়া...’

সৈয়দ আব্দুল হাদীর উদাত্ত কণ্ঠে শুনছিলাম গানটি। শুধু শোনা নয়, সেই সঙ্গে ছিল পর্দায় কিংবদন্তি অভিনেতা হ‌ুমায়ূন ফরিদীর লিপসিং। দুইয়ে মিলে গানের এক নিখুঁত দৃশ্যায়ন। ‘ত্যাগ’ সিনেমার এই গানটি এখন ইউটিউবে মেলে। ইচ্ছে হলে দেখে নিতে পারেন। এরপর ওপরের ছবির সঙ্গে গানের কথা মিলিয়েও দেখতে পারেন। তবে বলে রাখছি, সে ক্ষেত্রে কিন্তু আমি দায়ী নই!

নিশ্চয়ই এখন প্রশ্ন করবেন, কেন? আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি, আবার আমিই বলছি দায় নেই! এ তো হতে পারে না। কিন্তু এই দেশে সবই সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বাস্তব কার্যকলাপ থেকে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি বলে ভেবে নিতে পারেন। একটা হাসপাতাল, সেটার লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ, করোনাভাইরাসের চিকিৎসা আক্ষরিক অর্থে না দিয়েও কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল, করোনা পরীক্ষা না করেও দিনের পর দিন ভুয়া ফল দিয়ে গেছে, সরাসরি প্রতারণা করেও মালিকের দিব্যি ফটোসেশন করা—উফ্, দাঁড়ান দাঁড়ান, একটু দম নিতে দিন! জানামতে, উদাহরণের তালিকা চাইলে আরও দীর্ঘায়িত করা যায়। কিন্তু এত কিছুর পরও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ দপ্তর ও সেগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা যখন ‘দায় নেব না’, ‘দায় নেব না’ মন্ত্র আওড়াতে পারেন, তখন শুধু একটা গান শুনিয়ে মতান্তরে দেখিয়ে আমি কেন দায় স্বীকার করব?

সুতরাং যদি মিল পেয়েই যান, তবে তা একান্তই কাকতালীয় ঘটনা। গাছের ডালে কাকের বসা এবং ঠিক সেই মুহূর্তে তাল পেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।

>এভাবেই চলিতেছে সার্কাস। আমি-আপনি সেই সার্কাসের নিরুপায় দর্শক। দুয়ো নয়, হাততালি দেওয়াই আমাদের কাজ। টিকিট কিনতে কিনতে টেঁক ফাঁকা হলেও দায় আসবে আমাদেরই কাঁধে।

তবে গানের কলি বা কলিতে থাকা নির্দিষ্ট শব্দ নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। বঙ্গদেশে তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু। শুধু মাথায় দিতে বা রান্না করতে নয়, এই তেল আরও বহুবিধ কাজে ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে উভমুখী বিক্রিয়া সবচেয়ে লাভজনক। রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে, ‘...দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে...’। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই আসলে সবকিছু একটা আকার পায়, সব অকাজ বৈধতা পায়। রিজেন্ট হাসপাতালের ক্ষেত্রেও যে এমন কিছু হয়নি, তা কি বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিত করতে পারবে কেউ? সংশ্লিষ্ট সবার দায় অস্বীকারের প্রবণতা দেখে অবশ্য মার্ক জাকারবার্গের বাড়ির উঠানে ঘুরে বেড়ানো সব ছবিই মিথ্যে বলে বোধ হচ্ছে! আমি আশা করছি, শিগগিরই দায়ী সব মুঠোফোনের ক্যামেরা সমস্বরে বলে উঠবে, ‘আমরা দায়ী নই!’

তেল লেনদেনের বর্তমান এই ব্যবস্থা তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে, যখন উভমুখী বিক্রিয়া কোনো কারণে একমুখী হয়ে পড়ে। গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই তেলের সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিলেন, কারণ, সেটি ছাড়া দৃশ্যত তাঁর আর কিছুই নেই। তবে কোনো কারণে গ্রহীতারা নিশ্চয়ই বেজার হয়েছেন। আর তাতেই চতুর্দিকে নেমে এসেছে ঘোর অমাবস্যা। কী যন্ত্রণা! সাজা মাথায় নিয়েও বছরের পর বছর দিব্যি এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে স্বাধীনভাবে খেলে বেড়ানো একজন লোক হুট করেই হয়ে গেলেন ‘ভিলেন’!

অবশ্য পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, এমন ‘ভিলেন’ আমরা এর আগেও অনেক দেখেছি। সামনেও হয়তো দেখতে হবে। অর্থাৎ তেলচালিত উভমুখী বিক্রিয়া একটি চিরাচরিত প্রক্রিয়া, এই অঞ্চলে যা কিনা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে...

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতাল মামলার প্রধান পলাতক আসামি ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (হাতকড়া লাগানো)। ছবি: র‌্যাবের সৌজন্যে।
র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতাল মামলার প্রধান পলাতক আসামি ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (হাতকড়া লাগানো)। ছবি: র‌্যাবের সৌজন্যে।

দিন চলে না শুধু মো. আহিদুলের মতো মানুষদের। এই ব্যক্তি সম্প্রতি তাঁর রিকশায় আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন গন্তব্যে। কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, আগের আড়াই ঘণ্টায় তিনি রোজগার করেছিলেন মাত্র ৩০ টাকা। আর ঠিক আগের পুরোটা দিন প্যাডল মেরে আয় হয়েছিল মোটে ২৮০ টাকা। আচ্ছা হিসাব কষে বলুন তো, ওই টাকায় চারজনের সংসারে সবার তিন বেলা পেট ভরে ঠিকমতো?

আহিদুলরা করোনার কারণেই এই দুর্দশায় পড়েছেন। আর অন্যদিকে করোনা দিয়েই কতজনের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। তারা ধরা পড়লে আমরা দেখছি কর্তাদের একে-অন্যের দিকে চোরা চোখে ইতি-উতি চাহনি। এ বলছে সে দোষী, সে বলছে এ।

এভাবেই চলিতেছে সার্কাস। আমি-আপনি সেই সার্কাসের নিরুপায় দর্শক। দুয়ো নয়, হাততালি দেওয়াই আমাদের কাজ। টিকিট কিনতে কিনতে টেঁক ফাঁকা হলেও দায় আসবে আমাদেরই কাঁধে।

ওদিকে ‘টার্মিনেটর’ সিরিজের ছবির নায়কের মতো করে সার্কাসের ভিলেন বলে দিয়েছে, ‘আই উইল বি ব্যাক’!

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]