আর আমার খবর!

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

তাঁরা তিনজন। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক, সমবয়স্কা এক মহিলা এবং এক সদ্য তরুণী।

তাঁরা কেউ কি এই লেখা পড়বেন?

না পড়লে ভালো। পড়লে মুশকিল। জন্মের শত্রুকে তাঁরা শনাক্ত করে ফেলতে পারেন।

মধ্যবয়স্ক দুজনের অবশ্য এত দিনে বুড়োবুড়ি হয়ে যাওয়ার কথা। সদ্য তরুণী এখন হয়তো তরুণী। আরও অনেক দিন তরুণী থাকবেন। ধরে নিচ্ছি তাঁরা কেউ লেখাটা পড়বেন না।

বিতং না করে এখন ঘটনায় যাই। ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ–সংশ্লিষ্ট। স্যার তখন থাকেন এলিফ্যান্ট রোডে। এলিফ্যান্ট পার্ক অ্যাপার্টমেন্টসে। ছয়তলায় হাজার–বারো শ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। কাঠের দরজা বন্ধ থাকে না কখনো। তাঁর বাসায় প্রচ্ছদ দেখাতে গেছি একদিন সকালে, এগারোটার দিকে, দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ড্রয়িংরুমে স্যার তিনজন দর্শনার্থীসমেত বসে আছেন। সেই তিনজন।

মহিলা ও তরুণী স্যারের দুই পাশে বসে আছেন, আর ভদ্রলোক তাঁদের ছবি ওঠাচ্ছেন। মোবাইল ফোন যুগের বহু আগের বৃত্তান্ত। ক্যামেরা পারসন ছাড়া এক্সট্রা লেন্সওয়ালা দামি ক্যামেরা তখন কেউ ব্যবহার করত না।

মানুষজন ছবি তুলত ইয়াসিকা, নাইকন, জেনিথ ক্যামেরায়। বলত স্টিল ক্যামেরা।

ভদ্রলোক ছবি উঠিয়ে ক্যামেরা হস্তান্তর করলেন। এবার স্যারকে ছবি তুলতে হলো ভদ্রলোক ও তরুণীর সঙ্গে। ছবি ওঠালেন মধ্যবয়স্কা। পরের ছবির ফ্রেমে তাঁরা তিনজনই থাকবেন। ছবি কে ওঠাবে? স্যার বললেন, ‘ধ্রুব, তুমি উঠিয়ে দাও তো।’

আমি ছবি উঠিয়ে দেব! জীবনে ক্যামেরা ধরে দেখিনি। স্যার বলেছেন, ক্যামেরা নিলাম। ক্লিক করলাম না, ক্লিক ক্লিক করলাম। পরপর দুইবার শাটার টিপে দিলাম। ভদ্রলোক হা হা করে উঠলেন, ‘একবার! একবার!’

আচ্ছা, একবার। আরও একবার ক্লিক।

আমি নিশ্চিত একটা ছবিও ওঠেনি। উঠলেও আউট অব ফোকাস হয়েছে সবটাই। প্রিয় লেখকের সঙ্গে তিনজন মানুষের মূল্যবান স্মৃতি আমি নষ্ট করে দিলাম। আমার কোনো অন্তর্দাহ হলো না অবশ্য। তখন বুঝিনি। এখন বুঝলেও যায়-আসে না আর।

তাঁরা কারা ছিলেন আমি জানি না। জানলে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারতাম। এখন চেয়ে নিচ্ছি।

সেই ক্ষণে যাই।

বিদায় নিচ্ছেন তাঁরা।

‘আসি স্যার। স্লামালিকুম।’

‘আসি স্যার। স্লামালিকুম।’

‘আসি স্যার। স্লামালিকুম।’

‘ওয়ালিকুম সালাম। ঢাকায় যদি আর কখনো আসেন, অবশ্যই আসবেন। বাসায় কেউ নাই, চা-ও খাওয়াতে পারলাম না।’

‘জি স্যার! জি স্যার!’

চলে গেলেন তাঁরা, দরজা পার হয়ে লিফটে ঢুকেছেন মনে হয়, স্যার ডাক দিলেন মুস্তফার মা না কাকে। স্যারের বাসার গৃহকর্মী। মুস্তফার মা না কার মা মনে নেই। মুস্তফার মা ধরে নিয়ে বলি, স্যার তাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘মুস্তফার মা, দুই কাপ চা দাও। আর ধ্রুবকে কাঁচাগোল্লা দাও। কাল কাঁচাগোল্লা দিয়ে গেল না?...তারপর ধ্রুব, তোমার কী খবর বলো?’

আর আমার খবর!