সব কাচ ফেটে যাচ্ছে

করোনাকালের বর্ষা-বৃষ্টির তোড় থেকে বাঁচতে পলিথিন দিয়ে নিজের মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রক্ষায় ব্যস্ত এক বিক্রেতা, ২১ জুলাই, ধানমন্ডি, ঢাকা। ছবি: আবীর আবদুল্লাহ
করোনাকালের বর্ষা-বৃষ্টির তোড় থেকে বাঁচতে পলিথিন দিয়ে নিজের মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রক্ষায় ব্যস্ত এক বিক্রেতা, ২১ জুলাই, ধানমন্ডি, ঢাকা। ছবি: আবীর আবদুল্লাহ

বর্ষায় প্লাবিত গ্রাম। কাদামাটির রাস্তায় গরুর গাড়িই একমাত্র যানবাহন। গ্রামীণ সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে হারিকেন ও কেরোসিন ল্যাম্প, সন্ধ্যার আগে জ্বলে ওঠে ঝিঙেফুলের হলুদ। জোড়াদহ-ভায়নার বাইরে হরিণাকুণ্ডু কিংবা পৃথিবীর কিছুই জানি না তখন, দেখিনি কিছুই। জন্মের পর বড় হচ্ছিলাম মামাবাড়িতে। সেই বয়সে বর্ষা বলতে তেমন কিছু কি মনে থাকে? তবে একদিন মামাবাড়ির উঠানে নারকেলগাছ বজ্রপাতের শিকার হলো, বৃষ্টি ছিল। সেই বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মধ্যে পড়ে গেলেন আমার মা, মায়ের ডাকনাম বুড়ি, মামাদের ছোট বোন। মায়ের কোলে তাঁর প্রথম সন্তান, আমি। আমরা বজ্রপাতের শিকার হলাম। মা বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন উঠানে, নারকেলগাছের পাশে। রান্নাঘর থেকে বিস্তীর্ণ উঠান পার হয়ে ঘরে উঠতে পারলেন না তিনি। তবে বজ্রপাতের মুহূর্তে মা যখন বজ্র-বিদ্যুতের প্রাণঘাতী অগ্নি-আঁচের শিকার, আমাকে হয়তো তিনি বুকের মধ্যে নিয়েই পড়ে গেলেন। আমার চেয়ে মা বেশি আক্রান্ত। কাঁসার থালাবাটি বাজিয়ে মার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছিল। সেসব আমার কিছুই মনে নেই। বড় হতে হতে মায়ের কাছে শুনেছি এসব। বড় হতে হতে আমি সেই মরে যাওয়া নারকেলগাছটাও দেখেছি অনেক দিন। ঘনঘোর বর্ষাপ্লাবিত ভায়না গ্রাম থেকে একদিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মধুপুর। মধুপুর গ্রামটি খুব ছোট, গাড়াগঞ্জ বাজারসংলগ্ন। কুমার নদের পাড়ে সেই গঞ্জ, সেই মধুপুর। ফারাক্কা বাঁধের শিকার শীর্ণকায় কুমার চলে গেছে শৈলকুপার দিকে। এ রকম বর্ষায় কুমার কিছুটা নাব্যতা পায় বটে, ফলে দেখতে থাকি আমার বাল্যকাল ভেসে ভেসে যায় কুমারের জলে। ভেসে যায় গাড়াগঞ্জ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মাঠ। সেই মাঠই পাঠ্য ছিল আমার। বর্ষায় মাঠ পানিতে সাদা হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতেই সকাল-দুপুর-বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা দেখার বাল্যকাল ছিল আমার। কী রকম দিগন্ত ঝাপসা করে আসা বৃষ্টি দেখার দিন ছিল আমাদের! টিনের চালের বাড়িতে বর্ষাকাল পায় যারা, আমিও তেমন প্রাপক। তারপর ছিলাম শ্রীপুর, মাগুরাতে। বাবার চাকরিসূত্রে আমার বাল্যকালেরও ছোটাছুটি আছে। শ্রীপুর ছাড়াও ছিলাম আড়পাড়ায়। অবশ্য এর আগেই কলেজে উঠে পড়েছি, ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের ছাত্র আমি, সেখানে ছিলেন ষাটের দশকের কবি ও গল্পকার অধ্যাপক শহীদুর রহমান। একদিন শহীদ স্যার বলেন, হেমন্তের আকাশ যদি হয় জীবনানন্দ দাশের, তবে বর্ষার আকাশ রবীন্দ্রনাথের। ছিলাম খুলনায়, আর্ট কলেজে। জলরং যে ছবি আকার এক মাধ্যম, জানা হলো। হাতেনাতে ধরা পড়ল মেঘ। আরও মেঘ ধরতে ঢাকায় চলে এলাম, চারুকলায়। দেখলাম, শাহবাগে বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলা কবিতা ভেসে যাচ্ছে পরীবাগের দিকে। পরীবাগেই তো দু–দুটো জলের আড়ত। এ সময় এক লাইন প্যারোডি মনে আসে, ‘একবার পিককের পানে চেয়ে, একবার সাকুরার পানে...অনেক কবিতা লিখে চলে গেল যুবকের দল’। তারা কোথায় গেল?

তবে কি ঝুম–বর্ষা ডাক দেয়? ঝিম বনের মধ্যে তুমুল বৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া যুবক আমি দেখেছি। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে না-ফেরা মানুষ আমি দেখেছি। বাংলা কবিতার মধ্যে আত্মগোপনে হারিয়ে যাওয়া তরুণ আমি দেখেছি। দেখেছি ও দেখি যে বৃষ্টির একেকটি শব্দদানা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কবিতার সাদা পৃষ্ঠা। সেই ভেজা পৃষ্ঠায় চোখ রেখে কেউ হয়তো নিজেকে তুরীয়ভাবে ভিজিয়ে নেবে। কবিতার মধ্যে পুকুরপাড়ের বকুলগাছটি দাঁড়িয়ে ভিজছে। বকুল কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বালিকারা। বালিকারা প্রত্যেকেই বকুল, বকুলের ঘ্রাণ আছে বালিকার বুকে। বর্ষাকাল না এলে সেই ঘ্রাণ আর কোথায় পেতাম?

শহরের সার্কুলার রোডের এক বাড়ির বারান্দায় বসে দেখছি, জানালার গ্রিলে ফোঁটা ফোঁটা মেঘ লেগে আছে। গ্রিলের বাইরে করোনাপীড়িত পৃথিবী। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কোভিড-১৯ ভাইরাসে। মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষ তার জীবনযাপন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে ছন্দ, বাক্য। আর্থিক ধাক্কায় বিপর্যস্ত সংসার। সংসার মানে প্রিয়জনের সঙ্গে একাকার করে একাধিক মানুষের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা, পরস্পরের জন্য মমতা ছড়িয়ে যাওয়া। আপাতত কি সব কাচ ফেটে যাচ্ছে! আমরা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর সংজ্ঞা শিখছি। সময়টা যতই অনতিক্রম্য মনে হোক না কেন, অতিক্রম তো করতেই হবে। আমরা কি এর আগে পেরিয়ে আসিনি বহু ঝড়ঝঞ্ঝা, প্লাবন, খরা-বন্যা, মারি ও মড়ক?

 ভয়ানক নিঃসঙ্গতা ও ভরপুর ভালোবাসা একসঙ্গে থইথই করছে, আমার বুকের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে ত্রুবাদুর।