আমার অবস্থাও ধরেন মান্টোর মতো

কিছুদিন আগে প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট অনুবাদক জাফর আলম। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে তিনিই বোধ হয় সর্বোচ্চসংখক প্রগতিশীল উর্দু সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। সাদাত হাসান মান্টো, মির্জা গালিব, খাজা আহমেদ আব্বাস, কৃষণ চন্দর, মুন্সী প্রেমচন্দ, ইসমত চুগতাই, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ—এই প্রগতিশীল উর্দু কবি-সাহিত্যিকদের লেখা তাঁর অনুবাদেই পেয়েছি আমরা। করেছেন হিন্দি গল্পেরও অনুবাদ। তাঁর অুনুবাদে হেরমেন হেসের ‘সিদ্ধার্থ’ বইটি বহুল পঠিত হয়েছে। জাফর আলমের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মিরপুরের বাসায়। সে সময় তিনি নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত। তবু এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অনুবাদ ও নিজের সম্পর্কে বললেন অনেক কথা। বললেন, ‘কেউ তো আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসে না, আমাকে তো কেউ সাহিত্যিকই মনে করল না।’ সেই হিসেবে বলা যায়, মৃত্যুর আগে এটাই তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। এর খুবই সংক্ষিপ্ত একটি অংশ ‘গল্পপাঠ’ নামে একটি ওয়েবজিনে আগে প্রকাশ পেয়েছিল। তবে সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত অংশ অপ্রকাশিতই রয়ে গিয়েছিল। গেল ১৯ জুন এই অনুবাদকের মৃত্যুর পর সাক্ষারকারের রেকর্ড শুনে ‘অন্য আলো’র পাঠকদের জন্য এই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি তৈরি করা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অলাত এহ্সান। সঙ্গে ছিলেন এবং সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলিখন করেছেন হুমায়ূন শফিক

সাক্ষাৎকারের শুরুতে কোনো প্রশ্নের অপেক্ষায় না থেকে অনেকক্ষণ স্মৃতিচারণা করেন জাফর আলম। পরে তাঁর কথা প্রশ্ন-উত্তরের ভেতর পাওয়া যায়। প্রথমেই জানা যাক জাফর আলমের সেদিনের স্মৃতিচারণা, যার মধ্যে টুকরো-টুকরোভাবে লুকিয়ে আছে তাঁর বড় হওয়ার বৃত্তান্তও। পরে ‘সাক্ষাৎকার’ অংশে অনুবাদ নিয়ে বিশদভাবে কথা বলেছেন তিনি। আর ‘দরজার কাছে’তে আলাপন চলেছে মান্টো, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ থেকে শুরু করে বিচিত্র অনুসঙ্গে।

হাস্যেজ্জ্বল জাফর আলম। ছবি: সংগৃহীত
হাস্যেজ্জ্বল জাফর আলম। ছবি: সংগৃহীত


সাক্ষাৎকারের আগে: স্মৃতির আখর

আমার একটা ব্যাপার হলো, আমি তো সাংবাদিকতা করছি স্কুল লাইফ থেকে, ক্লাস এইটে থাকাকালে। দৈনিক ‘সংবাদ’, ‘পূর্বদেশ’, ‘পল্লীদেশ’—এই সব পত্রিকার জেলা সংবাদদাতা ছিলাম। তারপরে মেট্রিক পরীক্ষার পরে পাকিস্তান ‘অবজারভার’-এ জেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছি। তারপরে তো ঢাকা চলে আসলাম, ঢাকা কলেজে থাকার সময় ১৯৬২ বা ’৬৩ সালে আমি ম্যাগাজিন এডিটর ছিলাম। সাহিত্য সম্পাদক। সেই পত্রিকা উর্দু, ইংরেজি, বাংলা—তিন ভাষাতেই ছাপা হতো। অপসেট প্রেস ছিল না। পাতলা খান লেনে গিয়ে সেতার-ই-পাকিস্তান প্রেসেই পত্রিকাটা অপসেটে ছাপাতাম।

বগুড়া জিলা স্কুল পড়ার সময় কল্লোল কিশোর সাহিত্য করতাম। ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন বের করতাম। বগুড়া জিলা স্কুলে থমসন হল বলে একটা ছোট বিল্ডিং আছে, ওখানে আমরা মিটিং করতাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাড়ি আবার জেলখানার কাছে, ওর বাসায়ও আমরা মিটিং করতাম। আর ইলিয়াসের সাথে তো আমার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল।

লেখককে হতে হবে প্রগতিশীল চিন্তাধারার। মানে আমার কাছে লেখককে হতে হবে অসম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী। মানুষের কথা না বললে তো সে আর লেখক হলো না, বা ওই লেখা অনুবাদ করে তো কোনো লাভ নেই।
 

ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ নিয়ে আমি সেই ২০০৯ সাল থেকে কাজ করছি। ২০১১ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে একটা সেমিনার হয় মোহাম্মদপুরে। আমরাই করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম বাংলা উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশন। আসাদ চৌধুরী সভাপতি, আমি সহসভাপতি। ওখানে আমি প্রবন্ধ পড়েছি। সৈয়দ শামসুল সাহেব গিয়েছিলেন সেই সেমিনারে। আর কেউ কিচ্ছু করেনি। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের মতো এত বড় একটা ইন্টারন্যাশনাল কবি, যিনি ইকবালের সাথে টেক্কা দিতে পারেন, গালিবের সাথেও, সেই লোকটাকে আমরা স্মরণ করি না। অথচ এখানে তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। তবে রণেশদা (রণেশ দাশগুপ্ত) তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। রণেশদার সাথে ওঁনার বন্ধুত্ব ছিল। তবে হয়েছে কী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি যে দুটো কবিতা লিখেছেন, সেই দুটো কেউ অনুবাদ করেনি। একটা হলো ‘আমার শরীর থেকে দূরে থাকো’, আরেকটা কী যেন। আমি এই দুটো কবিতা অনুবাদ করে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ ছাপিয়েছি। তারপরে তিনি আরেকটা কবিতা লিখেছেন, ‘ঢাকাছে বাপাস আও’। ’৭৪ সালে ভুট্টোর সাথে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি কালচারাল উপদেষ্টা ছিলেন। তখন এখান থেকে গিয়ে তিনি এই কবিতাটি লিখেছেন। তখন অনেকে ওই কবিতাটি অনুবাদ করছে, কিন্তু আসল কথাটি কেউ বলেনি—তিনি মূলত ওই কবিতায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় আমার প্রবন্ধ বের হয়েছিল, সেখানে আমি এই কথাটা বলেছি।

এখন মুশকিল কী, আমি মুভ করতে পারি না। আমার কোমরে ব্যথা। তারপরে হাঁটুতে ব্যথা। হাঁটতে পারি না, লাঠি দিয়া টুকটুক করে হাঁটি। কোথাও বের হতে পারি না। খালি দাওয়াত পাচ্ছি। কিন্তু যেতে পারছি না। বাংলা একাডেমির বার্ষিক সভায়ও যাতে পারিনি। গত বছর গিয়েছিলাম, এই বছর আর যেতেই পারিনি। এক বছর ধরে কষ্ট করছি, তারপরেও আমার দুটো বই বাইর হচ্ছে, এটাই আনন্দ। এখন খালি ঠেলছি, ঠেলতে ঠেলতে যত দিন যায়।

আপনাদের আন্টি (জাফর আলমের স্ত্রী) মারা গেছে তো, আমার শুধু ছেলেই, রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া ঝামেলা, লেখালেখি করতে পারি না। এখন খুব কষ্টেই আছি। এবারে আমার দুটো বই বের হবে, গত বছর আমার কোনো বই বের হয়নি।

সাক্ষাৎকার শুরু: জমিনের অন্বেষা

অলাত এহ্সান: আপনার শুরু দিকের সব ‘মুক্তধারা’ প্রকাশ করেছে, আর আপনার অধিকাংশ বই হচ্ছে সাদত হাসান মান্টোর। এর কি কোনো সংযোগ আছে?

জাফর আলম অনূদিত ‘মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন’
জাফর আলম অনূদিত ‘মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন’

জাফর আলম: আমার অনুবাদের প্রথম বই বের হয়েছে , ‘মান্টোর শ্রেষ্ঠ গল্প’, ১৯৭৬ সালে। আমি বিশেষ করে উর্দু লেখক যাঁরা, যেমন: সাদত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, মুন্সী প্রেমচন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস, এঁদের বই অনুবাদ করেছি; এ ছাড়া মুলকরাজ আনন্দ, তাঁর বইয়েরও কাজ করেছি। তাঁর সাথে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হতো। কলকাতা থাকতেও যোগাযোগ হতো। ঢাকাতে ’৭৮ সাল থেকে যোগাযোগ ছিল। ঢাকাতে যখন ’৮৫ সালে তিনি আসলেন তাঁর, সাথে দেখা করেছি।

আমার মনে হয়, ওঁদের লেখাগুলো আমাদের এখানে অসাম্প্রদায়িক লেখা হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে মান্টোর লেখাগুলা। উর্দু সাহিত্যে বা উর্দু ছোটগল্পে প্রথম গল্প লিখেছেন প্রেমচন্দ, নাম হচ্ছে ‘কাফন’। এটা হলো বাস্তববাদী গল্প। তারপরে উর্দু পরিণতি পেয়েছে মান্টোতে এসে। মান্টো নিয়ে সালমান রুশদি বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ একজন গল্পকার হলেন মান্টো। কিন্তু খালেদ হাসান—যিনি মান্টোর গল্প অনুবাদ করছে ইংরেজিতে—তিনি বলছেন, মান্টো শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেই নয়, সারা দুনিয়ায় যত শ্রেষ্ঠ গল্পকার আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যেমন: গিয়াম দ্যা মোপাসাঁ, আন্তন শেখব। সবচেয়ে ভালো হলো, মান্টো অবহেলিতদের নিয়ে লিখেছেন। বিশেষ করে পতিতাদের নিয়ে তিনি লিখেছেন, এটা তাঁর আগে কেউ তেমনভাবে লেখেনি। এই সব কারণে মান্টো আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছেন। আমি সেই ’৭৬ সাল থেকে অনুবাদ করছি। তারপরে মুলকরাজ আনন্দ, তিনিও অসাম্প্রদায়িক লেখক। বিখ্যাত লেখক। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার কাছে তাঁর চিঠিগুলো আছে।


অনুবাদ তো আমি কোনো পুরস্কারের পাওয়ার উদ্দেশ্যে করিনি। মুক্তধারা ’৭০-র দশকে আমার চার-পাঁচটা বই করেছে। চিত্তরঞ্জন সাহা। আমি তখন ‘জনপদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করি। দৈনিক ‘বাংলা’য় আমি প্রথম সাব-এডিটর পদে চাকরি করি। তো, তিনি আমার বই করলেন, আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘রিটার্ন টিকেট’, প্রেমচন্দর ‘ললিতা গল্প সংকলন’, মান্টোর ‘এক টুকরো মিশরি’, তারপরে কৃষণ চন্দরের ‘মিস নন্দিতা’ এই কয়টা বই তিনি করলেন। মুক্তধারা প্রথমে নোটবইয়ের কারখানা ছিল। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে। ওরা সারা বাংলাদেশ নোটবই বিক্রি করত। এই সবের পরে আমার পরিচিতিও বেড়ে গেল। এর আগে তো আমাকে কেউ চিনত না। মুক্তধারা আর চিত্তবাবুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে পরিচিত করিয়েছেন। তারপরেই তো আরম্ভ হলো আমার যাত্রা। আশির দশকে কিন্তু আমার বেশি বই বের হয়নি।

এহ্সান: অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে কী মনে হয়, অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?

জাফর: অনুবাদ হলো একটা শিল্প। অনুবাদের জন্য ভাষার ওপর দখল থাকতে হবে। অরুন্ধতী রায়ের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর তো চার-পাঁচটা অনুবাদ বের হয়েছে। কিন্তু একটাও সাবলীল হয়নি। তাই শুধু ভাষার ওপর দখল থাকলে চলবে না, আপনি যে গল্প বা উপন্যাসের অনুবাদ করতে চান, সেটাকে পড়ে পড়ে প্রথমে আত্মস্থ করতে হবে। তারপর সেটা এমনভাবে লিখতে হবে যাতে পাঠক তা বুঝতে পারে। বিদঘুটে শব্দ ব্যবহার বা আক্ষরিক অনুবাদ করলে চলবে না। পরিশ্রম করতে হবে। যে সাহিত্যের অনুবাদ করতে চান, তার ওপর ভালো জ্ঞান থাকতে হবে।

আমি তো উপমহাদেশের গল্প নিয়ে কাজ করেছি। সেখানে আমার কাজটা কী, তা ভালো মতোই জানতাম। আর উপমহাদেশের সব সাহিত্যেরই খবর রাখতাম। যিনি অনুবাদ করতে চান, তারও সাহিত্যের সর্বশেষ খবরাখবর সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। পাঠক কীভাবে নেয়, সেটা সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। আবার ‘উপমহাদেশের গল্প সংকলন’-এর জন্য আমি পাকিস্তানের ১২-১৩টা গল্প খুব কষ্ট করে সংগ্রহ করছি, ভারতের ১৬-১৭টা। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, ভাষার পরিবর্তন হচ্ছে, আবার গল্পেরও পরিবর্তন হচ্ছে। উর্দু সাহিত্য কিন্তু আগের মতো নেই। এখন বেশির ভাগই প্রতীকী গল্প হয়। অনেকেই প্রতীকী গল্প লেখে। ইংরেজিতে যাকে বলে সিম্বলিক। এখন কোনো একটা বইয়ে গল্প পেলেন আর বললেন, ভাই, এটা অনুবাদ করেন, তাহলে তো হলো না। আবার পাঠকদের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। আমি ভাগ্যবান, আমার পাঠকের একটা গ্রুপ আছে। যারা আমার অনুবাদ পছন্দ করেন, অনুবাদ বের হলে সাথে সাথে সংগ্রহ করেন।

এহ্সান: অনুবাদ তো শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কী করেন?

জাফর: আমি তো আক্ষরিক অনুবাদ করি না, আমি আমার মতো করে লিখি সহজ-সরল ভাষায়, যাতে পাঠকেরা বুঝতে পারে।

এহ্সান: লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদি গভীরভাবে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে অনুবাদকের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। অনুবাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য কোনো একটা দেশ বা মহাদেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেওয়া উত্তম। তাই কি?

জাফর : আসলে এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। অনুবাদের ক্ষেত্রে যিনি অনুবাদ করবেন—সেটা তো তার বিবেচনা। আমি তো মান্টো, কৃষণ চন্দর—এঁদেরকে এ দেশে পরিচয় করিয়েছি। এর আগে আখতা-উন-নবী ছিলেন, মোস্তফা হারুন, কাজী মাসুম সাহেব ছিলেন। আমাদের এখানে ব্যাকগ্রাউন্ডটাও দেখতে হবে। এখানে কিন্তু অনেকে উর্দু চর্চা করতেন। যেমন: নবাব আব্দুল লতিফের ভাই নবাব আব্দুল নাছিক, ময়মনসিংহের খালিদ বাঙালি—তিনি বাঙালি হলেও উর্দুতে সাহিত্য চর্চা করতেন, মনির উদ্দিন ইউসুফ। এঁরা ভালো অনুবাদ করতেন। আমরা মুসলমান হওয়ার ফলে আমাদের ভাষাটও একটু উর্দুঘেঁষা। ষাটের দশকে অনুবাদের ভালো চর্চা হতো। মুশায়েরা হতো। কিন্তু এখন তো সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আর্থিক কষ্টের পাশাপাশি অন্য ঝামেলায়ও আছে। তারপরও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরে এখনো কিছু কিছু চর্চা হয়। আহমদ সায়েদী বলে একজন লেখক ছিলেন, মারা গিয়েছেন। তিনি শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও আলাউদ্দিন আল আজাদের বই অনুবাদ করেছেন। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ও অনুবাদ করেছিলেন উর্দুতে, চিন্তা করেন! চর্চা আছে আরকি। কিন্তু আমরা জানি না।

অনুবাদে উপমহাদেশের ভাষা নিয়ে কাজ করলে ভালো। তবে যার যার দক্ষতা অনুযায়ী বা চর্চা অনুযায়ী করতে পারলে ভালো। যেমন হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, এমনকি পাঞ্জাবিতেও করতে পারেন। পাঞ্জাবিতে সুফি, যেমন—আব্দুল কালাম বিটাই, শাহবাস কালান্দারসহ অনেক সুফি আছে; তারপরে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর, তিনি কবি ছিলেন। ইরানের ওমর খৈয়াম, জালালুদ্দিন রুমি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, মনসুর হাল্লাজের—এঁদের তো অনেক অনুবাদ হচ্ছে। একসময় এখানে ফারসি চর্চা ছিল। মুঘল আমলে তো রাষ্ট্রভাষাই ফারসি ছিল। তখন ফারসি ভাষার ভালোই চর্চা হয়েছে। দলিলপত্র সবই ফারসিতেই লেখা হতো।

এহ্সান: একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ-ছন্দের জন্য ওই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। সে ক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই কি ঠিক হবে?

জাফর: না, এমনটা নয়। তবে লেখককে হতে হবে প্রগতিশীল চিন্তাধারার। মানে আমার কাছে লেখককে হতে হবে অসম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী। মানুষের কথা না বললে তো সে আর লেখক হলো না, বা ওই লেখা অনুবাদ করে তো কোনো লাভ নেই। আপনি কোন লেখকের বই অনুবাদ করবেন, তা তো ভালোমতো দেখে নেবেন, তাই না? সব লেখকের লেখাও তো সবাই পছন্দ করবে না।

এহ্সান: তাহলে একজন অনুবাদকের তৃপ্তি কোথায়, একটি অনুবাদ করায়, না একটি ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি-লেখক সম্পর্কে গভীরভাবে জানায়?

জাফর: সংস্কৃতিকে জেনে তা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা আমার কাছে তৃপ্তির।
এহ্সান: প্রায়ই শোনা যায়, অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়। অনুবাদকে সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায়? কীভাবে সাহিত্য হয়ে ওঠতে পারে?

জাফর: ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে, পাঠকদের কাছে সহজ-সরলভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। পাঠক সৃষ্টি করতে হবে। পাঠকেরা যদি না পড়ে, অনুবাদে তাহলে লাভ কী? আর অনুবাদের মাধ্যমে আমরা বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানতে পাড়ছি, অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছি। মোটকথা, অনুবাদকে সাহিত্য হয়ে উঠতে এর পাঠকদের ওপর নির্ভর করে। পাঠকেরা যদি পড়ে, আনন্দ পায়, কিছু জানতে পারে, বুঝতে পারে, তাহলে অনুবাদ সাহিত্য হয়ে উঠতে সক্ষম।

এহ্সান: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো দেশের কিছু গল্প অনুবাদ করেই তাকে সেই দেশে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ বলে দিচ্ছে। বইয়ের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু থাকে না—এগুলো কেন শ্রেষ্ঠ গল্প, কীভাবে বাছাই করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাঠকেরা কি প্রতারিত হচ্ছেন না?

জাফর: আসলে দেখেন, আমি তো মান্টোর অনেক গল্প অনুবাদ করছি, কোনটা শ্রেষ্ঠ গল্প বলা মুশকিল। এক একজনের বিবেচনা আলাদা হয়। যেমন পাকিস্তান মান্টোর শ্রেষ্ঠ গল্প বের করেছে। আমি সেটা অনুবাদ করেছি। সেই বই আমাকে করাচি থেকে আনাতে হয়েছিল। তা ছাড়া দেখেন বই আনাও ব্যাপক খরচ। ওই বইগুলোর দামও বেশি।

এহ্সান: আমাদের দেশে সাধারণত যে অনুবাদগুলো হয়, সেগুলো মূল ভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনো ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

জাফর: আমার কাছে একটি বই আছে, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের; যেটার এক পাশে উর্দু আর এক পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে, কিন্তু ইংরেজি ঠিকভাবে অনুবাদ হয়নি। আবার বাংলায় যাঁরা করছেন, তাঁরাও উর্দু ঠিকমতো জানেন না, এতে করে আমরা বইটার আসল স্বাদ পাচ্ছি না। আবার ধরেন, আমি হেরমেন হেসের ‘সিদ্ধার্থ’ করেছি ইংরেজি থেকে। এটা অবশ্য আরও অনেকেই করেছে, কিন্তু আমারটা সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। তৃতীয় সংস্করণ হয়েছে শুনেছি।

জাফর আলম অনূদিত কৃষণ চন্দর গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস: দাঙ্গার গল্প’
জাফর আলম অনূদিত কৃষণ চন্দর গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস: দাঙ্গার গল্প’

এহ্সান: অধিকাংশ অনুবাদই বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলো হয়ে থাকে। এই অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে?

জাফর: হ্যাঁ, উপকার তো হবেই। আমরা সেই দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যাঁরা বুকার বা নোবেল পুরস্কার পান, তাঁদের বইগুলো কিন্তু অনেক মোটা, আর এইগুলো অনুবাদ হওয়ার পরে আমাদের এখানে পাঠক কোথায়? এখন একজন লোক যে বিনিয়োগ করবে, সেটা তো উঠে আসবে না। দেখেন, কলকাতায় কিন্তু জার্মান থেকে সরাসরি অনুবাদ করে। অন্যান্য ভাষা থেকেও করে। ওখানে ভাষা জানা লোক আছে। আমাদের এখানে নেই। এইখানে ফরাসি ভাষা ভালোভাবে গুটিকতক মানুষই জানেন, এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী। কিন্তু তিনি তো তেমন কাজ করেননি। যাঁরা ভাষা জানেন—ফরাসি ভাষা বলেন, স্প্যানিশ বলেন, বা জার্মানি; ওই ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করলে বেশি ভালো হয় আরকি।

এহ্সান: বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে, যেগুলো ভালো, কিন্তু বহুল আলোচিত নয়, তা অনুবাদে প্রকাশকরাও বিনিয়োগ করতে চায় না। সে ক্ষেত্রে মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কী করে পেতে পারি?

জাফর: আমাদের এখানে পাঠক সীমিত। তারপরেও আমরা কয়েকজন মিলে করেছি। আশির দশকে তো উর্দু অনুবাদ তেমন বের হয়নি। নব্বইতে বেশ কিছু বের হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকেও করেছে। বাংলা একাডেমি থেকেই আমার ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ বের হয়েছিল। এখন করছে ‘দাঙ্গার গল্প’। এখন হয়েছে কি, সব ভাষা থেকে অনুবাদ হওয়ার দরকার। এটার মূল উদ্যোগ নিতে হবে বাংলা একাডেমিকেই। একাডেমিতে অনুবাদ শাখা আছে। সেখানে আগে আবু জাফর শামসুদ্দিন বা কবীর চৌধুরী ছিলেন। আমি তো নিজ উদ্যোগে মান্টো বা কৃষণ চন্দরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখন সেখানে উপযুক্ত লোকের অভাব আছে। উপযুক্ত লোক নিয়োগ দিতে হবে। দরকার পড়লে বিদেশি বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক আনতে হবে।

এহ্সান: একটি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই বিশ্বের সেরা সাহিত্য, মননশীল-চিন্তাশীল বইগুলো ব্যাপকভাবে দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। আমাদের দেশে তা হয়নি। এটা কি আমাদের দেশের সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে মনে করেন?

জাফর: অবশ্যই। আমাদের তো ঠিক মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাই লেখা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে তো সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। চিন্তাশীল বইগুলোও তাই। আবার দেশ হয়ে গেছে দুই ভাগ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেকে তো দেখেছি, তাঁর সাথে যোগাযোগও ছিল। আমি ’৬২ সালে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। আমাদের এখানে আসলে সঠিক ইতিহাস লেখা দরকার। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা আমার কাছে আছে। এর উর্দু ভার্সনও আমার কাছে আছে।

এহ্সান: টেকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। আমাদের দেশে তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?

প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত জাফর আলম অনূদিত মির্জ গালিবের বই ‘দাস্তাম্বু: সিপাহি বিদ্রোহীদের রোজনামচা’
প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত জাফর আলম অনূদিত মির্জ গালিবের বই ‘দাস্তাম্বু: সিপাহি বিদ্রোহীদের রোজনামচা’
আমার ২৯টা বই বের হয়েছে, অন্য দেশ হলে আমার কিন্তু চাকরি করা লাগত না। অনুবাদকে পেশাদারিত্বের আওতায় আনা দুষ্কর এ দেশে। একজন অনুবাদক আছেন, শওকত হোসেন নামে। তিনি সরকারি চাকরি করেন, পাশাপাশি অনুবাদ। বেশ ভালো ভালো বই অনুবাদ করেছেন। আমি বাংলা একাডেমিকে রিকমান্ড করেছিলাম তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য, কিন্তু দেয়নি। এবার নাকি শুনলাম পুরস্কার দেওয়ার জন্য কাউকেই পায়ইনি। আবার অনুবাদকদের প্রকাশকরা টাকাও দিতে চায় না। আরও নানাবিধ সমস্যা আছে।

জাফর: পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আকাদেমি আর ঢাকার বাংলা একাডেমি মিলে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। অনুবাদকদের যদি একটি সমন্বয় পরিষদ থাকত, তাহলে অনুবাদ সাহিত্য উপকৃত হতো। আমি তো একবার ভেবেছিলাম অনুবাদ গবেষণা কেন্দ্র করব। কিন্তু বাংলাদেশে এত গ্রুপিং, খুবই বিরক্তকর। কেউ এক হয়ে ভালো কাজ করবে, সেই মানসিকতাই নেই। আমি তো কোনো গ্রুপেই নেই। আমার অবস্থাও ধরেন মান্টোর মতো। আবার একটা প্রতিষ্ঠান করব, অনেক টাকা-পয়সারও ব্যাপার। যেমন ছোটগল্পের একটা পত্রিকা বের হতো, সেখানে গল্পকাররাও কিন্তু এক হতে পারেনি। সেখানে দেখলাম, সবাই পদের জন্য মারামারি করে। এই হলো এ দেশের লেখক। আবার চাকরি করে এই সব করার এনার্জিও থাকে না। তারপরেও করতাম, যদি সবাই এক হতো। লেখক-প্রকাশকেরও একটা কমিটি দরকার। মুনতাসির মামুন একবার ঢাকা ক্লাবে বলেছিলেন, আমরা লেখক-প্রকাশকরা একটা অফিস নিয়ে বসব। সেখানে আমাদের কার কী সমস্যা আছে, সেসব নিয়ে কথাবার্তা হবে।

লেখক, কবি, অনুবাদক এঁদের আসলে আলাদা সংস্থা থাকা দরকার। ভাবের আদান-প্রদান হওয়া জরুরি—কী করছেন না করছেন, জানা দরকার। তাহলে কী হবে, কোনো অনুবাদ ডাবল হবে না। যে একটা করে ফেলেছে, সেটাকেই তখন আরেকটু ঠিকঠাক করা যাবে।এটাই ভালো নয় কি? তারপরে হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি, হওয়া দরকার।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার আলাদা মুগ্ধতা আছে। আর এর সঠিক ইতিহাস লিখতে হবে। প্রত্যেককেই লিখতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে আসলটা এসে যাবে। ৫০ বছর পরে আসল ইতিহাস বের হয়ে আসবে। এখন তো ৪০ বছর চলে গেছে, এখন আমাদের আলাদা আলাদা লাইনে কাজ করতে হবে।

এহ্সান: আপনার অনুবাদ সংস্থার প্রসঙ্গ ধরে বলি, অনেকেই মনে করেন অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি গঠন দরকার। আপনার কী মনে হয়? এভাবে কি মানসম্মত অনুবাদ পাওয়া সম্ভব?

জাফর: যদি অনুবাদের একটি সমিতি থাকে, তাহলে তো সেখান থেকেই এর সম্পাদনা করা যায়। মনে করেন জুনিয়ার একজন অনুবাদ করল, সে তো কাউকে দেখাতে পারছে না। সমিতি থাকলে সেখানে সিনিয়র অনুবাদকদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ থাকলে আরও ভালো হতো।


এহ্সান: জুনিয়র অনুবাদকের কথা বলছিলেন। তাদের মধ্য দিয়ে হোক, কিংবা সিনিয়রদের অনুবাদ হোক—প্রতিবছরই দেশে প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। তার সবই প্রায় জনপ্রিয় ও বহুলালোচিত গ্রন্থ। অপরিচিত কিন্তু শক্তিশালী লেখক বা বই তেমন কোনো আবিষ্কার নেই। এটা কি অনুবাদকের দুর্বলতা?

জাফর: সেটা তো বেছে নিতে হবে পাঠক ও অনুবাদককে। বেস্ট সেলার লেখক ছাড়াও যেসব ভালো ভালো লেখক আছেন, তাঁদের আবিষ্কার করা অনুবাদককের কর্তব্য। আমাদের পত্রিকাগুলোতে তো সাহিত্য পাতা নেই বললেই চলে। অনুবাদের জন্য আলাদা পত্রিকা হওয়া উচিত। সম্পাদরো আমাকে বলেন, ভাই, ছোট করে লিখবেন। কিন্তু ছোট করে লেখা যায় না। পত্রিকা দিয়ে তো অসলে সাহিত্যকে কতদূর বাঁচানো যাবে, কে জানে। সাহিত্যের জন্য পত্রিকাওয়ালা একপাতা, আধাপাতা মাত্র রাখে। আধেক পাতায় আর কীই-বা লেখা যায়।

এহ্সান: পত্রিকার পাতার এই সংকটের কারণেই মনে হয়, নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে ছোট কাগজকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। এখানেও অনেকে অনুবাদক হওয়ার চিন্তা করেন। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

জাফর: লিটল ম্যাগ থেকেই অনুবাদক তৈরি হতে পারে। তার জন্য যত্ন দরকার। আমাদের তো বিশ্বমানের অনুবাদ পত্রিকাও নেই।এগুলো দরকার।

এহ্সান: লেখালেখির ক্ষেত্রে তো পেশাদারিত্বের কথা বলা হয়। আমাদের দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারিত্ব কথা শুনি না। অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্ব গুরুত্ব কতটুকু?

জাফর : আমার ২৯টা বই বের হয়েছে, অন্য দেশ হলে আমার কিন্তু চাকরি করা লাগত না। অনুবাদকে পেশাদারিত্বের আওতায় আনা দুষ্কর এ দেশে। একজন অনুবাদক আছেন, শওকত হোসেন নামে। তিনি সরকারি চাকরি করেন, পাশাপাশি অনুবাদ। বেশ ভালো ভালো বই অনুবাদ করেছেন। আমি বাংলা একাডেমিকে রিকমান্ড করেছিলাম তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য, কিন্তু দেয়নি। এবার নাকি শুনলাম পুরস্কার দেওয়ার জন্য কাউকেই পায়ইনি। আবার অনুবাদকদের প্রকাশকরা টাকাও দিতে চায় না। আরও নানাবিধ সমস্যা আছে।

এহ্সান: রয়েলটির তো মূল লেখকেও দেওয়া হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখক জানতেই পারছেন না, আরেকটি ভাষায় তার লেখা অনুবাদ হচ্ছে। মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না।

জাফর: বিদেশে রয়েলটির নিয়ম ব্যাপকভাবে মান্য করা হয়। ওখানে তো এজেন্ট আছে। এজেন্টরাই প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি নিয়ে যায়, তারাও পার্সেন্টেজ পায়, এগ্রিমেন্ট হয়ে যায় সাথে সাথেই। কিন্তু আমাদের দেশে এর কোনো বালাই নেই। এরা তো বিদেশ থেকে ডলার এনে প্রকাশককে দেয়, বলে, ছাপিয়ে দেন। তবে লেখকের পারমিশন নেওয়া জরুরি। রয়েলটির ব্যাপারটাও চালু হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ধরেন, কৃষণ চন্দর সেই কত আগে মারা গেছেন, তাঁকে রয়েলটি দেওয়ার জন্য এখন কোথায় খুঁজব বা তাঁর পরিবারই এখন কোথায় আছে? আবার মান্টোকেই-বা কোথায় পাব? যদিও মান্টোর রয়েলটি তাঁর স্ত্রীর পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যতদূর শুনেছি কিছুই পাননি তিনি।

আরও কথা আছে, লেখকের পারমিশন না হয় নিলেন, আবার প্রকাশকের পারমিশনও তো নিতে হবে। মুলকরাজের একটা বই কলকাতা থেকে বের হওয়ার পরে তিনি আমাকে বললেন, আলম, বইটা আমাকে পাঠাও। আমি কিনেই তাঁকে পাঠালাম। কলকাতা থেকে বোম্বেতে (মুম্বাই)। এরপর তিনি আমাকে বললেন যে কলকাতা থেকে আমাকে এক পয়সাও রয়েলটি দেয়নি।

এহ্সান: অনুবাদ তো দুইভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমরা কিন্তু তা দেখছি না। এ থেকে উত্তোরণের উপায় কী মনে করেন?

জাফর: সেলিনা হোসেন সেদিন বলেছেন ইংরেজি ভাষার ওপর একটু জোর দিতে। তিনি মন্দ বলেননি। ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক আর অনুবাদক যাঁরা আছেন—যেমন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ মনজুরু ইসলাম—তাঁরা চাইলে ভালো কিছু করতে পারেন।

আবার বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যেতে পারে। যেমন, শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে এই সময়ের পর্যন্ত যেসব কবি আছেন তাঁদের কবিতা বেছে সিলেক্টেড পোয়েম ফ্রম বাংলাদেশ নাম দিয়ে বই হতে পারে। গল্পের ক্ষেত্রেও তাই।

এহ্সান: কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে একটা মন্তব্য আছে। রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার অনেকে অনুবাদ করেছেন; কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বা শামসুর রাহমানের মতো কেউ করতে পারেননি। তার মানে কি কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলেই সেরাটা পাওয়া সম্ভব? আপনার কী মনে হয়?

জাফর: হ্যাঁ, এটা সত্যি। কবিতা অনুবাদ একটু কষ্টদায়ক। আমি তো করেছি। ফয়েজ আহমেদের কবিতা করে আমি মোহাম্মদপুরে গিয়েছি উর্দুভাষী যেসব কবি আছেন, তাঁদের দেখাতে। তাঁদের সাজেশন নিয়েছি। অনেক শব্দ ঠিক করেছি। ডিকশনারি দেখে তো সবকিছু বোঝা যায় না। ওখানে আহমদ ইলিয়াস আছেন, প্রবীণ কবি। শামীম জামানভী আছেন। ওঁদের কাছে যাই। আর সত্যি বলতে—কবিতা অনুবাদ একজন কবি করলেই ভালো, আর গল্পের জন্য গল্পকারই শ্রেয়। তবে গদ্য অনুবাদে অন্তত বাইরের কেউও ভালো করতে পারবে, যদি তার সে রকম প্রস্তুতি থাকে।

এহ্সান: অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকে ভাষা, অনেকে ভাব, অনেকে মূল বক্তব্য অনুসরণ করেন। এতে কি একটি সাহিত্যের প্রকৃতাবস্থার হের ফের ঘটে যায় না?

জাফর: আগে গল্প পড়ে আত্মস্থ করতে হবে, তারপর ভাবানুবাদ করতে হবে। যাতে পাঠকপ্রিয়তা পায়। পাঠকেরা বুঝতে পারে। মূল বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। আসলে পাঠক যদি না পড়ে, তাহলে তো লাভ নেই।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক বক্তব্যে বলেছিলেন, তাঁর একটা বই নাকি প্রথম দিকে বেশি বিক্রি হয়নি, কিন্তু সেই বইটা এখন প্রতিবছরে আট শ থেকে হাজার কপি বিক্রি হয়। তাঁর এখন পাঠকপ্রিয়তা আছে। আবার যাঁরা বড় লেখক, তাঁদের উচিত তরুণদের উৎসাহিত করা। এখন লেখকদের মধ্যে ঐক্য নেই। কিন্তু ষাটের দশকে বামপন্থী নেতা থেকে শুরু করে লেখক-কবিদের মধ্যে সব সময়ভাবের আদান-প্রদান হতো। এখন কই সেসব? তখন কামাল লোহানী ছিলেন। দেখতাম, তিনি কীভাবে সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তাঁরা বিপ্লবও করছেন। যোগাযোগ বা সম্পর্কটাই হলো আসল।

এহ্সান: অনুবাদকের স্বাধীনতা, শব্দ তৈরি ইত্যাদি দিক অনেকে সামনে আনেন। এর বিপক্ষেও মত আছে। আপনার কী মনে হয়? অনুবাদকের আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে কি?

জাফর: নিজের মতো করেই লিখতে হবে, তবে বেশি স্বাধীনতা প্রয়োগ করা উচিত না। মূলের সাথে যোগাযোগ রেখে তারপর লিখতে হবে।

এহ্সান: সে ক্ষেত্রে অনুবাদক হিসেবে নিজেকে কীভাবে আলাদা করেন?

জাফর: আসলে আমি তো ভাবানুবাদ করি। যেটা আমার কাছে ভালো লাগে, সেটাকে আমি আগে ভালোমতো পড়ি। তারপর অনুবাদ করি। অন্যরা তা করেন কি না জানা নেই।

এহ্সান: একবারে সমসাময়িক বিষয়ে কথা বলি। এবার (একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৫) মেলায় আপনার একাধিক অনুবাদ গ্রন্থ বের হচ্ছে। সে সম্পর্কে বলুন।

জাফর: ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা ও প্রবন্ধের অনুবাদ সংকলন বেঙ্গলস পাবলিকেশন থেকে বের হচ্ছে; আর মাওলা ব্রার্দাস থেকে কৃষণ চন্দরের গল্প সংকলন ‘ইরানী পোলাও’—এই দুটো বই বের হচ্ছে।

এহ্সান: অনুবাদের জন্য এই গল্পগুলো বা এই লেখকের গল্পগুলো বেছে নেওয়ার কারণ কী?

জাফর: ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আমার খুব প্রিয় কবি। তিনি বামপন্থী চিন্তাধারার লোক। কৃষণ চন্দরও তাই। ফয়েজ আহমেদ জেলখানার মধ্যে বসেও কয়েদিদের কবিতা শোনাতেন। আন্তর্জাতিক ধারার কবি তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন।

এহ্সান: এই মুহূর্তে দেশে যে অনুবাদ হচ্ছে, তার মান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?

জাফর: না, অনুবাদের মান আরও উন্নতি করতে হবে। অনুবাদ সংস্থা থাকতে হবে, অনুবাদের সম্পাদনা শাখা থাকতে হবে। বাংলা একাডেমিকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।

এহ্সান: আমাদের দেশে অনেক অনুবাদক আছেন। বাজারে তাঁদের বিস্তর বই আছে। আপনি কাদের আদর্শ অনুবাদক বলে মনে করেন?

জাফর: কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত হোসেন। আর তরুণ যাঁরা আছেন, তাঁদের আমি ভালোমতো চিনি না।


দ্বিতীয় ভাগ: দরজার কাছে

এহ্সান: শুরু করে ছিলাম মান্টো বিষয় দিয়ে। মান্টোর জীবনীও তো আমাদের আগ্রহের জায়গা তৈরি করেছে।

সাদত হাসান মান্টো। ছবি: সংগৃহীত
সাদত হাসান মান্টো। ছবি: সংগৃহীত

জাফর: তাঁর বাবা ছিলেন মুনসেফ। তাঁকে বেশি যত্ন করতেন না। যার ফলে—তিনি অমৃতসরে থাকতেন—অমৃতসর থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগে গিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন, ভগত সিংয়ের মূর্তি থাকত তাঁর টেবিলে। গানবাজনার জন্য একটা ক্লাব করেছিলেন, সেখানে তাঁর বাবা গিয়ে হারমোনিয়াম-টারমোনিয়াম ভেঙে দিয়েছেন—এসব কী! বাবার মতে, এগুলো ছিল ছেলের ‘অনৈসলামিক কাজকারবার!’ মান্টোর বাবা তো মুনসেফ।

তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। যক্ষ্মা দেখা দেওয়ায় চলে এসেছেন ওখানে থেকে, আর গ্র্যাজুয়েশন হয়নি। আর তিনি তো মেট্রিক পাস করছেন তিনবারে, অনেক কষ্টে...হা হা হা।

এহ্সান: তারপর দেশভাগের মধ্যে তিনি পাকিস্তানের লাহোর চলে গেলেন। সেখানে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ তাঁকে আশ্রয় দেন।

জাফর: হ্যাঁ, সেখানে তো রেডিও স্টেশন তার জন্য বন্ধ ছিল। লেখালেখি করত তো সরকারের বিরুদ্ধে। কবিতা লিখত, গল্প লিখত। তার ‘বুঁ’ (গন্ধ) লেখা অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হলো।


এহ্সান: আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, লেখার বিরুদ্ধে এই অশ্লীলতা অভিযোগ সম্বন্ধে? আসলে লেখালেখিতে ‘অশ্লীলতা’র সংজ্ঞা আমরা কীভাবে নির্ধারণ করব?

জাফর: মান্টোর প্রসঙ্গে বলতে পারি, তখন তো ছিল একটা বুর্জোয়া সমাজ। তাদের একটা আলাদা নিয়ন্ত্রণ ছিল। যেমন সাজ্জাদ জহির বের করে ছিল ‘আঙ্গারে’—সে তো প্রোগ্রেসিভ রাইটার মুভমেন্টে যুক্ত ছিল—ব্যান্ড হয়ে গেল।

এহ্সান: সে সময়ই তো ইসমত চুগতাইয়ের ‘লেপ’ গল্পটা ব্যান্ড হলো, সেটা নিয়ে মামলা পর্যন্ত হলো।

জাফর: হ্যাঁ। ইসমত চুগতাই আমি অনুবাদ করেছি, আছে আমার কাছে, মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল। ইসমত চুগতাই ছিলেন মান্টোর খুব ঘনিষ্ঠ। কথা হলো কি, এখনো গোঁড়ামি ও মৌলবাদী প্রভাব আছে সমাজে, তবে যখনকার কথা বলছি, সেই সময় সমাজ ছিল আরও বেশি গোঁড়ামিতে ভরা। সমাজ। মান্টো, জহির—তাঁরাই তো এই গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখেছেন, শোষণ মুক্ত সমাজের জন্য।

এহ্সান: আপনার জন্ম-বেড়ে ওঠা নিয়ে বলুন। আপনার জন্ম তো কক্সবাজারে। দীর্ঘ সময় কলকাতায় কাটিয়েছেন। কীভাবে কলকাতা গেলেন? আপনার অনেক বড় সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব ছিল। এঁদের সম্পর্কে বলুন।

কলকাতায় যখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পা কেটে ফেলা হলো, তখন আমি কলকাতায়। নিয়মিত ওর খবরাখবর নিয়েছি। ওর অসাধারণ মনোবল। পা কেটে ফেলেছে, তার মধ্যেও নরমাল কথাবার্তা বলছে। তারপর কলকাতায় যখন বাসা নিয়ে ছিল, সেখানে গিয়েছি। তত দিনে সে ভালো হয়ে গেছে, লাঠিটাটি নিয়েছে তার পরে—তখন একটু রিঅ্যাকশন হয়ে হলো তার ভেতর।
 

জাফর: হ্যাঁ, আমার জন্ম কক্সবাজারে। কলকাতায়ও কটিয়েছি অনেকদিন।ক্যানসারের কারণে কলকাতায় যখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পা কেটে ফেলা হলো, তখন আমি কলকাতায়। নিয়মিত ওর খবরাখবর নিয়েছি। ওর অসাধারণ মনোবল। পা কেটে ফেলেছে, তার মধ্যেও নরমাল কথাবার্তা বলছে। তারপর কলকাতায় যখন বাসা নিয়ে ছিল, সেখানে গিয়েছি। তত দিনে সে ভালো হয়ে গেছে, লাঠিটাটি নিয়েছে তার পরে—তখন একটু রিঅ্যাকশন হয়ে হলো তার ভেতর। ন্যাচারাল ব্যাপার, এত বড় একটা ঘটনা। কিন্তু আমি খুব দুঃখ পেয়েছি ওর মৃত্যুতে। বোধ হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ওর অপারেশন হলো, ঢাকায় এসে জানুয়ারিতে মারা গেল। আমরা রেডিওতে শুনলাম। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল, ঢাকা কলেজে যখন পড়ত। তারপর সেখানেই যখন শিক্ষকতা করত, আমার ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল।

এহ্সান: আপনার স্নেহের প্রশ্রয়ে বলতে পারি, আমিও ঢাকা কলেজে। যে বামপন্থীর কথা বললেন…

জাফর: আমি ঢাকা কলেজে পড়তাম, ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ভাসানি ন্যাপের সমর্থক ছিলাম। তুমি?

এহ্সান: আমিও, ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক ছিলাম। হায়দার আকবর খান রনো ভাইয়েরা কি আপনাদের সময়ের, নাকি ছোট?

জাফর: আমাদের সময় তো তারা ছিলেন না। তারা তো অনেক পরের। সিক্সটি ফোরে আমার গ্র্যাজুয়েশন। আমি নর্থ হোস্টেলে থাকতাম। আমাদের সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন জালাল উদ্দিন সাহেব, জিল্লুর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) সাহেবের আত্মীয়।

এহ্সান: কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তো আপনাদের পরে প্রিন্সিপাল হয়ে আসেন, তাই না?

জাফর: হ্যাঁ, আমাদের পরে আসেন। আমাদের সময় এবিইউ আহমেদ ছিলেন প্রথমে, আজিমপুরে থাকতেন, সাইক্রিয়াট্রিক; তারপর আসেন জালাল উদ্দিন। জালাল উদ্দিন তো খুব স্ট্রং লোক ছিলেন। শেখ শহীদকে বেরই করে দিলেন। বললেন যে এখানে পলেট্রিকস করা চলবে না, পড়াশোনা করতে হবে। সব নামকরা নামকরা শিক্ষকেরা ছিলেন তখন—শওকত ওসমান, জিল্লুর রহমান খান। ড. আলী আহমদ ছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের, আমাদের কোর্স করাতেন; ড. করিম ছিলেন হিস্ট্রির, আশরাফ সিদ্দিকীও ছিলেন।মোটকথা, একেবারে টপ টপ সব লোকজন।

তো জালাল উদ্দিন সাহেব খুব কড়া লোক ছিলেন। ক্লাসে আমাদের ইংলিশ পড়াতেন। তখন তো আইভি রহমানেরা ছোট। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে কি দেয়নি। জালাল সাহেব হলে টিচিং রুমে থাকতেন, দুটো রুম নিয়ে।আর ক্লাসে তিনি আমাদের বলতেন, এই, তোমরা কেউ আমার মেয়ের দিকে নজর দেবে না, দুষ্টামি করতেন। স্যার খুব সিগারেট খেতেন, তাস খেলতেন।আসলে তিনি ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ফাস্ট ক্লাস।

এহ্সান: গত শতকের ষাট, সত্তর কি আশির দশক—এই সময়গুলোতে বিভিন্ন সংকটে লেখকেরা দারুণভাবে সরব হয়েছেন। এখন তো সেই প্রতিবাদী সাহিত্যও আমরা পাচ্ছি না।

জাফর: না। এখন প্রতিবাদী সাহিত্য করতে গেলে একটা সংকট হয়। সেটা আমি বলি। যেমন ধর, আমি ‘ইত্তেফাক’-এ ২০০৬ সালে কলাম লিখতাম। আমি তো রিটায়ার্ড পারসন, রিটায়ার্ড করেছি ২০০১ সালে, এখন চৌদ্দ বছর হতে চলল। ইত্তেফাকে আমার ছবি দিয়ে কলাম বেরিয়েছে। আমি বলেছি, দেশের দুটি বৃহৎ দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই, আর সেখানে অবস্থা এমন, বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার। এতে প্রেসক্লাবে সবাই আমার পিঠ চাপড়েছে—বলেছে, আরে জাফর ভাই, তোমার সাহস আছে। আমি বলেছি, আমি ভাই রিটায়ার্ড হয়ে গেছি, আমার আর কী হবে। আমি বলছি, মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

ধরা যাক, আমি লিখলাম, প্রতিবাদ করলাম। আমাকে প্রোটেকশন কে দেবে? আমাকে টেলিফোনে হুমকি দেবে, বাসায় আক্রমণ করবে। হোয়াট ইজ দিস! ‘আনন্দবাজার’-এ বিভিন্ন সময়ে জ্যোতি বসুকে ছিলে ফেলা হয়েছে। যখন এমন ঘটেছে তখন অনেকেই জ্যোতি বসুকে বলেছেন, স্যার, আপনাকে নিয়ে এইভাবে লিখছে! তিনি বলেছেন, আরে লিখতে দাও। ওরা ওখানে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবে না, বাসায় কোনো গ্যাঞ্জাম করবে না। কলামের জবাব দেবে কলাম লিখে। তারপর ওখানে ‘বর্তমান’ নামে একটা পত্রিকা আছে, পত্রিকা বের করা হয় লোন করে, জ্যোতি বসুর সরকারের কাছ থেকেই লোন নিয়ে। তো সেই পত্রিকা পরে জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে লিখছে। পত্রিকার কাজই তো এই।

এহ্সান: আমরা এবার উঠতে চাই।

জাফর: ঠিক আছে ভাই, এসো, যোগাযোগ রেখো। আংকেল (হুমায়ূনকে ইঙ্গিত করে), আসবেন, যোগাযোগ থাকবে।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]