১৮৫৭: 'সিপাহি বিদ্রোহের' কালে দিল্লির ঈদ

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের কোরবানি ঈদের সময় দিল্লিতে ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এই প্রহরে নতুন এক ত্যাগের মহিমা স্থাপন করল মানুষ। সেই অনালোচিত অধ্যায়ের উন্মোচন।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকাল। ১০ মে একদল সৈনিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। সর্বত্র রব উঠল, দিল্লি চলো, দিল্লি চলো। কেন? সেখানে আছেন মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ। তিনি কবিও বটেন। ‘জাফর’ নামে কবিতা লেখেন। তাঁকেই নিজেদের শাসক মানেন সৈনিকেরা। তাঁদের নেতা যাঁরা, তাঁরাও তা–ই মানেন। সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিল ভারতের উত্তরের বিভিন্ন প্রান্তের সৈনিকেরা। তাঁরা বাহাদুর শাহকে ভারতবর্ষের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করলেন। সেই সঙ্গে তিনি এই যুদ্ধের সর্বাধিনায়কও।

মোঘল রাজ সিংহাসন লাল কেল্লার মাটির নিচের ঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল ১৮৪২ সাল থেকে। সেই সিংহাসন উঠিয়ে নিয়ে আসা হলো এই ১৮৫৭-এর কালে। আবারও সরগরম হলো দীওয়ানে আম।

বাহাদুর শাহকে নেতা মেনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে যোগদান করল ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে মানুষ, ভারতীয়রা। উঠতি ধনী লোকেরা বাদে সেই মুক্তি কে চায়নি তখন? তাতিয়া টোপী, আজিমুল্লাহ, লক্ষ্মী বাই, হজরত মহল অবন্তিবাই, কুয়ার সিং, আহমদউল্লাহ—কত নাম, কত প্রান্তের মানুষ! এক হয়ে সবাই অবিচল ছিল একই লক্ষ্যে।

কেমন করে এত ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষার মানুষেরা এক হয়ে গেল? এর প্রেক্ষাপট কী? সেই কথা বলার আগে আরেকটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে; এবং পেছনে তাকালে আমরা দেখব যে ভারতবর্ষ একটা ধারণা। তবে এই ধারণা বাস্তবের ওপরেই গড়ে উঠেছে। এটা জানা বিষয় যে কোনো একটি অঞ্চলের বসবাসরত মানুষেরা, যাদের বলা যায় ভেতরের মানুষ, নিজেদের মধ্যে সব সময় অমিল খুঁজে পায়। তাদের নিজেদের মধ্যে কত রকমের পার্থক্য, তার হালহকিকত বয়ান করে তারা। অন্যদিকে সেই নিজেদের মধ্যে আবার কোথায় রয়েছে মিল, সাধারণত সেটা দেখে বাইরের চোখ।

ভারতবর্ষের মানুষদের পারস্যের লোকেরা প্রাচীনকালে জানত সিন্ধু নদের তীরের মানুষ বলে। সিন্ধুকে তারা বলত ‘হিন্দু’। সেই সিন্ধুপারের মানুষেরা হচ্ছেন ‘হিন্দু’। এখানে কোনো ধর্মের বয়ান নেই। এ নিতান্তই এক ভৌগোলিক ব্যাখ্যা। সাংস্কৃতিক বটে।

শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর
শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর

ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে বহু বৈচিত্র্য আছে। সেটা শুরু থেকেই ছিল। তবে এ-ও ঠিক, বাইরের শক্তি হয়ে যারা এখানে এসেছে, তারা সবাই কালে কালে এখানে নিজেদের এখানকার বাসিন্দারূপেই গড়ে তুলেছে, বিভিন্ন সূত্রে এ অঞ্চলের হয়ে উঠেছে। শক, কুশান থেকে মোঘল পর্যন্ত এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। খোদ গ্রিক সম্রাট মিনিন্ডাস হয়ে গেছেন বুদ্ধ অনুসারী। তাদের হাতে বৌদ্ধ শিল্পকলা পেয়েছে আজকের রূপ। ভারতবর্ষের মানুষও মেনে নিয়েছে এই বাস্তবতা। শাসকের উৎস বা তাঁর ধর্ম ও সংস্কৃতি এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এককালের বাইরের আগন্তুক যারা, পরে তারাই দেশি ভাষা সংস্কৃতির বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। বাংলা ভাষা তার ভালো নজির। তবে হাজার বছরের এই পরম্পরায় একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ইংরেজ শাসন। তারা এসেছে এক নতুন পৃথিবীর গড়ে ওঠার কালে। তখন বাস্তবে আর দেশের সীমারেখার কোনো মানে নেই। ভারতসহ সব উপনিবেশ কেবল মুনাফার কারখানা।

তাই ইংরেজ শাসনের শুরুতে ভারতবাসী আগে না দেখা এই মুনাফামূলক কারবারের সামনে হকচকিত হয়ে পড়েছিল। এর আগেই ভারতবর্ষজুড়ে প্রশাসনকাঠামো ভেঙে পড়েছিল। শেষ আঘাতটি ইংরেজরা করল ১৭৫৭ সালে। পলাশী–কাণ্ডের পরেই বণিকের দাড়িপাল্লা শাসকের দণ্ড তুলে নিল। একই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মুক্তির লড়াইও। বিভিন্ন সময়ে সন্যাসী ফকির থেকে কৃষক, সাঁওতালরা লড়েছে বেনিয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তবে ভারতবর্ষে সর্বাঙ্গীণভাবে ইংরেজদের হাত থেকে নিজ দেশকে স্বাধীন করার দাবিদার হতে পারে ১৮৫৭ সালের লড়াইটা। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। এটা যেন একটা সেনা–অভ্যুত্থান ছাড়া আর কিছু নয়। সিপাহি বিদ্রোহ নামে একে ডাকার চল এখনো আছে। তবে কার্ল মার্ক্স ঘটনাটাকে অভিহিত করেছেন ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন’ হিসেবে। পরে অনেকেই তাঁর সুরে সুর মিলিয়েছেন।

আজ সবাই-ই নিশ্চয় জানেন যে এই লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল দিল্লি থেকে ৪০ মাইল দূরে, মিরাটে কোম্পানির সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। অচিরেই সেখান থেকে বিদ্রোহটা ছড়িয়ে পড়ে গাঙ্গেয় সমতলের উপরিভাগে, মধ্য ভারতজুড়ে। তারপর তা উত্তর আর পূর্ব ভারতকেও স্পর্শ করে। এর পরম্পরায় বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষও। ভারতবর্ষের সমাজকাঠামোতে জোর নাড়া দেওয়া, নির্মম খাজনাব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের জীবনমানের পতন—সব মিলিয়ে ১৮৫৭ সালের এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি চাইছিল।

কূটকৌশলে নবাব সিরাজউদদৌলার পতন ঘটানোর পর সেই ১৭৫৭ সাল থেকে ইংরেজরা দুটি হাতিয়ার বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে—এক. বিভাজনের নীতি; দুই. লোভী ও ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে রাখা। এর এক শ বছর পর ১৮৫৭-এর যুদ্ধেও এর কোনো অন্যথা দেখা যায়নি।

১৮৫৭ সালের আগস্ট মাস। বিদ্রোহে ফুঁসছে সবাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে একজোট হয়ে ব্যারাকে রয়েছে ভারতীয় বিদ্রোহী সৈন্যরা। আর এখন যেখানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ক্যাম্পাস, সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে ইংরেজ বাহিনী। এর মধ্যে সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে আছে দিল্লিতে থাকা এক ইংরেজ চর গৌরী শংকর। সে ইংরেজ বাহিনীর কাছে লিখে পাঠাল যে ২ আগস্ট কোরবানি ঈদ। এই দিন যদি দিল্লি শহরের ভেতরে কয়েকটা গরু জবাই করা যায়, তাহলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগাতে কোনো রকম কষ্ট করতে হবে না। ফলাফল, বিনা আয়াসে যুদ্ধ জয়।

শিল্পীর তুলিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংগ্রাম। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পীর তুলিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংগ্রাম। ছবি: সংগৃহীত
১৮৫৭ সালের আগস্ট মাস। বিদ্রোহে ফুঁসছে সবাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে একজোট হয়ে ব্যারাকে রয়েছে ভারতীয় বিদ্রোহী সৈন্যরা। আর এখন যেখানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ক্যাম্পাস, সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে ইংরেজ বাহিনী। এর মধ্যে সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে আছে দিল্লিতে থাকা এক ইংরেজ চর গৌরী শংকর। সে ইংরেজ বাহিনীর কাছে লিখে পাঠাল যে ২ আগস্ট কোরবানি ঈদ।

কিন্তু বিচক্ষণ বাহাদুর শাহ জাফর তো আগে থেকেই গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছেন। ইংরেজ অনুগতরা বেশ কয়েকজনকে টাকা দিয়ে প্রস্তুত করল গরু জবাইয়ের জন্য। তাদের ভাবনা এমন, কোনো রকমে একটা দাঙ্গা বাধানো গেলেই দিল্লিতে হামলা চালানো শুরু করবে ইংরেজ বাহিনী।

সেই অশায় ইংরেজ সৈন্যরা অপেক্ষা করতে লাগল। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে যায়। কিন্তু ইংরেজদের প্রত্যাশিত খবর আর আসে না। পরে হতাশ গোরা বাহিনী খবর পেল, এমন ঘটনা ঘটতে পারে আন্দাজ করে অনেক আগেই বাহদুর শাহ কোতোয়ালকে নির্দেশ দিয়েছেন, দিল্লির সব গরু এক জায়গায় নিয়ে আসতে, যাতে কেউ দাঙ্গা লাগানোর সুযোগ না পায়। তবে কোতোয়াল তাঁকে বললেন, এই কম সময়ে এটা সম্ভব নয়।

সেই বাস্তবতায় বাহাদুর শাহ এবার দিলেন নতুন ফরমান, এই ঈদে কোনো পশু জবাই হবে না। মজার তথ্য হলো, এই ফরমানে সেই সময় মুসলিমরা কোনো প্রকার অনুযোগ করেনি। কারণ, ইংরেজদের নাগপাশ থেকে দেশ আর নিজেদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তখন সবার মধ্যেই ছিল প্রবলভাবে। সেই কোরবানির ঈদে বাহাদুর শাহ জাফর একটা কবিতা লিখলেন:

‘হে খোদা! দুশমনের সব সৈন্য হত হোক

গোর্খা, গোরা থেকে গুজ্জর সব হত হোক

আজকের দিনকে কোরবানির তখনই জানব আমি

হে জাফর! যখন ঘাতকেরা সব নিহত হবে।’

বলা বাহুল্য, বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে এই স্বাধীনতার যুদ্ধে শত্রু হনন করা ছিল সবচেয়ে বড় ‘কোরবানি’।

তখন ইংরেজ বাহিনীতে কিথ ইয়ং নামের এক কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সময়ের জলজ্যান্ত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর একটি চিঠিতে। হতাশ হয়ে কিথ ইয়ং নামের গোরা সৈন্য লিখেছেন, ‘নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা করার বদলে তারা সবাই একসঙ্গে হয়ে আমাদের ওপর ভয়ানক আক্রমণ করল। লক্ষ্য আমাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলা।’

বাহাদুর শাহ জাফরের সেই ফরমান
বাহাদুর শাহ জাফরের সেই ফরমান

আবার ওই একই সময়ে ফরেস্ট নামের আরেক ইংরেজ সৈন্য লক্ষ করলেন, দিল্লির জামা মসজিদ বিশ্বাসীদের প্রার্থনায় মুখর হয়ে উঠেছে। অন্যপক্ষে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও বিষ্ণুর অনুসারীদের নিয়ে এক হলেন। ফরেস্টের ভাষ্য, ‘...বারবার হিন্দু-মুসলিম হামলাকারীরা আমাদের অস্থায়ী প্রতিরোধে হামলা চালাতে লাগল।’

তবে এত কিছু সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা জিতে গিয়েছিল ওই যুদ্ধে। কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস যেভাবে একরৈখিক করে লেখা হয় বা হয়েছে, তার একটা নজির রয়ে গেল এর মধ্য দিয়ে।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের কোরবানি ঈদের সময় ত্যাগের মহিমার ভিন্ন এক অর্থ দাঁড় করাতে পেরেছিলেন শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তবে তাঁকে কেবল আত্মমগ্ন পরাজিত রাজনীতিবিমুখ এক মানুষ হিসেবে দাঁড় করেছেন ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা এবং ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত এ অঞ্চলের ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ।

ভারতবাসীর সেই মুক্তির লড়াইয়ের পরে বাঙালি–অধ্যুষিত কলকাতার ডায়মন্ড হারবার থেকে রেঙ্গুনগামী (বর্তমান মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন) জাহাজে তোলা হলো বাহাদুর শাহকে। কিন্তু আফসোস এই যে বদলে যাওয়া ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার কেউ তখন সেটি খেয়াল করল না!

সূত্র: সৈয়দ ওয়াজারাত আলির বই ‘দুররে খুশ আব’, আসলাম পারভেজের বই ‘বাহাদুর শাহ জাফর’ ও প্রফেসর কপিল কুমারের লেখা ‘১৮৫৭ কি বকরি ঈদ’।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]