শ্রাবণের মেঘ

রিকশা থেকে নামতে গিয়ে রুমুর মনে হলো, সে ঠিকানা ভুল করে ফেলেছে। এখানে একটা লন্ড্রির দোকান থাকার কথা ছিল। দোকানের নাম রাজধানীর ড্রাই ক্লিনার্স। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, লন্ড্রিটা কোথাও নেই। সেখানে নিরেট দেয়াল। ওপাশে সবজির দোকান। সবজির দোকানের রং উঠে যাওয়া সাইনবোর্ড, ‘আয়েশা বিউটি পারলার’।

আয়েশা বিউটি পারলার কী করে সবজির দোকান হয়ে গেল, রুমু জানে না। সে কেবল জানে, ঠিক এখানেই একটা নিমগাছ ছিল, নিমগাছটা উঠে গিয়েছিল বাড়ির দোতলার বারান্দা অবধি। মামুন থাকত ওই বাড়িতে। সে বলত, ‘এই বাড়িতে থাকার একটা মাত্র ভালো দিক কি জানো?’

‘কী?’

‘ব্রাশ–টুথপেস্টের খরচ বেঁচে যায়।’

‘মানে কী? তুমি দাঁত মাজো না!’ রুমু আঁতকে উঠত।

মামুন সরু চোখে তাকিয়ে হাসত, ‘এই যে রোজ চুমু খাও, কই কখনো কি মনে হয়েছে আমি দাঁত মাজি না?’

রুমু মামুনের মাথায় চাটি মেরে বলত, ‘সেই তো এক বাজে স্বভাব, মুখে কিচ্ছু আটকায় না!’

তা মামুনের স্বভাব এমনই। মুখে কিছু আটকাতও না। সে ব্যস্ত রাস্তা পার হতে হতে আচমকা হাত চেপে ধরত রুমুর। তারপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলত, ‘চলো রাস্তায় জ্যাম লাগিয়ে দিই।’

রুমু চোখ বড় বড় করে বলত, ‘জ্যাম লাগিয়ে দিই মানে?’

‘এই ধরো সিনেমায় যেমন হয়। চারপাশে নদীর স্রোতের মতন সাঁই সাঁই ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। আর ঠিক তখন, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীল শাড়ি পরা অপরূপ রূপবতী এই তরুণীর ঠোঁটে যদি দীর্ঘ...’

মামুন এমন কত–কী বলত! যেন দমবন্ধ এই শহরে একঝলক দমকা হাওয়া সে। এখানে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।

রাস্তার উল্টো পাশে সেলুন। আচ্ছা এমন হয়নি তো, বিউটি পারলার উঠে গিয়ে যেমন সবজির দোকান হয়েছে, তেমনি লন্ড্রি উঠে গিয়েও সেলুন হয়েছে! কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে সে এখানে আসে না! রুমু হিসাব করে সময় বের করার চেষ্টা করল। পারল না।

মামুনকে ফোন করতে গিয়ে রুমুর মনে হলো, তার কাছে মামুনের ফোন নম্বর নেই। এমনকি সে টাকার ব্যাগও নিয়ে আসেনি। রিকশাওয়ালা কী বুঝল কে জানে। সে বলল, ‘সেই সকাল থেইক্যা এই গলি ওই গলি ঘুইরা বেড়াইতেছেন। ঠিকানা-ফোন নম্বর না নিয়া কি ঢাকা শহরে মানুষ খুঁইজা পাওন যায়?’

কথা সত্য। কিন্তু এই কথা রুমুকে কে বোঝাবে! তার মামুনকে খুঁজতে ভালো লাগে। মামুন বলত, ‘আমাদের সবারই কখনো না কখনো খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় জানো?’

‘হু।’

‘কেন হয় তা জানো?’

‘কেন?’

‘কেউ খুঁজবে বলে আমরা হারিয়ে যেতে চাই।’

‘কী জানি!’ রুমু অনিশ্চিত উত্তর দিত।

মামুন বলত, ‘ধরো, তোমার খুব কাছে থাকা মানুষটাই যদি কখনো তোমার খোঁজ না নেয়, তাহলে?’

‘তাহলে কী?’

‘তাহলে তার চোখের সামনে থেকেও তুমি মূলত হারিয়েই আছ, তাই না?’

রুমু তাকিয়ে থাকত নিষ্পলক। মামুন নির্বিকার হাসত। তারপর দুহাতে আলতো করে রুমুর গাল চেপে ধরে গাঢ় গলায় বলত, ‘তুমি খুঁজবে ভেবেই হারিয়ে যেতে চাই...।’

দুই.

মামুনের সঙ্গে রুমুর বিয়ে হয়ে গেল মধ্য শ্রাবণের এক রাতে। তুমুল বৃষ্টির সেই রাতটা অদ্ভুত। সন্ধ্যার ঠিক আগেও রুমু জানত, যা পাওয়া হয় না তাই হয়তো আরও বেশি রয়ে যাবে চিরকাল। এই কথাটা খুব বলত মামুন। সে বলত, ‘এই যে আমরা এত পেতে চাই, কিন্তু কি জানো, পেয়ে যাওয়া মাত্রই আমরা মূলত একটু একটু করে হারাতে থাকি।’

‘কীভাবে?’

মামুন সেই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতেই হাসত, সালমান নামে এক কবি আছে। তার একটা লাইন আমার খুব পছন্দ, ‘সবটুকু জানা হয়ে গেলে, সব কথা পড়ে ফেলার পর, পঠিত মানুষ এক পুরনো কবর।’ কথাটা খুব সত্যি। পেয়ে গেলে সব জানা হয়ে যায়, পড়া হয়ে যায়, তখন নতুন করে পাওয়ার আগ্রহটা আর থাকে না। তাই না পাওয়াটাই পাওয়ার তীব্র তেষ্টা হয়ে থেকে যায় চিরকাল।’

>রুমু এত কিছু বোঝে না। সে কেবল বোঝে মামুনকে তার চাই-ই চাই। কিন্তু চাওয়াটা দুই তরফেই সমান হতে হয়। মামুন বোহেমিয়ান। তার চাকরিবাকরি নেই। সে সদা প্রগলভ, প্রফুল্ল। তাকে কিছুই বিচলিত করে না। সে ‘আগুনে বসিয়া হাসে পুষ্পের হাসি’র মতো মানুষ।

রুমু এত কিছু বোঝে না। সে কেবল বোঝে মামুনকে তার চাই-ই চাই। কিন্তু চাওয়াটা দুই তরফেই সমান হতে হয়। মামুন বোহেমিয়ান। তার চাকরিবাকরি নেই। সে সদা প্রগলভ, প্রফুল্ল। তাকে কিছুই বিচলিত করে না। সে ‘আগুনে বসিয়া হাসে পুষ্পের হাসি’র মতো মানুষ।

রুমুর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে রুমু শঙ্কিত। শুনে মামুন হাসে, ‘এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব। এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন, এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন, মনে থাকবে?’

রুমুর ভীষণ কান্না পায়। এমন অনুভূতিহীন, কুয়াশাচ্ছন্ন, অস্পষ্ট একটা মানুষকে সে কেন এত ভালোবাসতে গেল! কান্নাক্লান্ত কণ্ঠে সে বলে, ‘তুমি কখনো মানুষ হবে না?’

মামুন হাসে, আরণ্যক বসু তোমার এই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়ে দিয়েছেন, ‘এই জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে, পরের জন্মে মানুষ হব, তোমার ভালোবাসা পেলে, মানুষ হবই, মিলিয়ে নিয়ো...।’

রুমুর আর কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। সে ফোনের রিসিভারটা রেখে দেয়। মামুন উধাও হয়ে যায়। তার কোনো খোঁজ নেই। ফোন নম্বর নেই। রুমুর বুকে জমা অভিমানের সূক্ষ্ম আস্তরণ ক্রমেই দৃঢ় দেয়াল হতে থাকে। বাড়িতে বিয়ের কথা হয়। রুমু আর বাধা দেয় না। হ্যাঁ-না কিছুই বলে না। পাত্রপক্ষ এসে দেখে যায়। কাঠের পুতুল হয়ে বসে থাকে রুমু। নির্বাক, নিস্পন্দন।

তার বিয়ে ঠিক হয় শ্রাবণের তেরো তারিখে। ছেলে নিউইয়র্ক থাকে। বাড়িতে সাজসাজ রব। এ বংশে আর এমন পাত্র জোটেনি। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তোরণ সাজানো হতে থাকে। গাছে গাছে চুনকাম। আয়োজন দেখে পথচারীরা থমকায়। উচ্চ স্বরে গান বাজতে থাকে। আর আড়ালে বাজতে থাকে রুমুর কান্না। সেই কান্না কেউ শুনতে পায় না, হই–হুল্লোড়ে তার সুর ঢাকা পড়ে যায়। বিয়ের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় ফোনটা আসে। রুমুকে ডেকে দেয় তার মা। রুমু ফোন কানে চেপে ধরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, মামুন!

মামুন হড়বড় করে বলে, ‘আমি মিথ্যে বলেছিলাম’।

‘কী মিথ্যে?’

‘যা যা বলেছিলাম সব মিথ্যে, সব। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।’

রুমুর রাগ হয়, কান্না পেতে থাকে। মনে হয় চিৎকার করে মামুনকে খুব খারাপ কিছু বলে সে। কিন্তু বলা হয় না। কেবল বাইরের বৃষ্টির চেয়েও তীব্র কান্না পেতে থাকে তার। মামুন ভাঙা গলায় বলে, ‘আমি রাজধানী ড্রাই ক্লিনার্সের ফোন থেকে ফোন করেছি। তুমি এখন এই মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারবে? এই মুহূর্তে?’

রুমু জবাব দেয় না। সে ফোন রেখে দেয়। সন্ধ্যার পর শুরু হয় তুমুল ঝড়। রাজধানী ড্রাই ক্লিনার্স বন্ধ হয়ে যায়। মামুন অবশ্য কোথাও যায় না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা জবুথবু কাকের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। রুমু আসে ঠিক রাত দশটায়। সে রিকশার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকে। মামুন তখন ঘোরগ্রস্ত এক মানুষ। তার হাতের চামড়া ফ্যাকাশে, কোঁচকানো, অসাড়। তারপরও রুমুর উষ্ণ স্পর্শ টের পায় সে। ভেজা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোটুকু যেন মুহূর্তেই অপার্থিব হয়ে ওঠে। রুমু দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। মামুন কনকনে ঠান্ডায় কাঁপে। কাঁদেও। রিকশাওয়ালা বলে, ‘অহন কই যামু?’

রুমু জানে না। কিন্তু তার যে কী ভীষণ আনন্দ হয়! এই বৃষ্টি, এই ঝড়, এই নির্জন রাত, রাতের অন্ধকার, অনিশ্চিত গন্তব্য, পেছনে ফেলে আসা ছিন্ন শিকড় আর সুতীব্র শঙ্কা—এই সবকিছু ছাপিয়ে এক অদ্ভুত অপার্থিব ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হতে থাকে সে! এই যে মামুন কাঁদছে, সেই কান্নাটুকুও ক্রমেই আনন্দ হয়ে উঠতে থাকে!

তিন. 

‘কী হইলো, অহন কই যামু?’ রিকশাওয়ালার ডাকে সংবিৎ ফেরে রুমুর।

বাস্তব জগতে ফিরে আসে মেয়েটি। মধ্য শ্রাবণের মেঘলা আকাশজুড়ে বৃষ্টি নামে। রুমু নির্বিকার ভিজতে থাকে, আসলেই তো, এখন কই যাবে সে? সেই নিমগাছটা নেই, সেই বাড়িটা নেই, সেই রাজধানী ড্রাই ক্লিনার্স নেই। ঠিক তখনই গাড়িটা এসে থামে। বছর কুড়ি বয়সের এক তরুণী আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে, ‘মা’?

রুমু তাকায়। মেয়েটা বলে, ‘সেই ভোর থেকে তোমাকে সারা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজছি! প্রতিবছরই এই দিনে এমন করলে হয় মা?’

রুমু চুপচাপ গাড়িতে ওঠে। এই শহরটা কত বদলে গেছে এত বছরে! অথচ সে একটুও বদলাতে পারেনি! শ্রাবণ এলেই কেন এমন হয়ে ওঠে সে? এমন ওলট-পালট! মাত্র তো একটা মাস মামুন তার সঙ্গে ছিল। তারপর এক বিকেলে বাসায় ফিরে অস্থির ভঙ্গিতে বলল, ‘হলো তো এবার?’

রুমু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কী হলো?’

‘আমার মৃত্যু।’

‘বালাই ষাট। কী বলছ তুমি?’

‘ঠিকই বলছি। বিয়ে তো পুরুষ মানুষের জন্য মৃত্যুই। তার ওপর চাকরিটাও জুটে গেল। এ জীবনের আর বাকি থাকলটা কী!’

তার কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুমু। মানুষ যখন চাকরি পায় না, তখন সে চাকরি পেয়েছে। চাকরি পেয়ে এর আগে কাউকে এমন বিষণ্ণ হতে সে দেখেনি।

মামুন বলল, ‘জামাকাপড় গোছগাছ করে নাও। পুরোপুরি মরে যাওয়ার আগে খানিক বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আসি চলো।’

‘মানে?’

‘মানে আগামী মাসে জয়েনিং। তার আগে চলো হানিমুনটা সেরে হাসি। হা হা হা।’

মামুনের ওই হাসিতে কী ছিল রুমু জানে না। তবে আনন্দে তার চোখে পানি চলে এল। টিকিট আনতে বেরোল মামুন। আকাশে মেঘ করেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রুমু প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াল খানিকক্ষণ। তারপর শুরু করল গোছগাছ। দীর্ঘ সময় নিয়ে সাজল। কিন্তু মামুন আসছে না কেন! বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে, টিকটিক টিকটিক টিকটিক...।

তবে মামুন আর এল না। ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’ লেখা এক ট্রাকে থেঁতলে যাওয়া মামুন সে সময় হাসপাতালে। হাসপাতালের শীতল করিডর আর ফিনাইলের গন্ধ মাড়িয়ে তখন তার কাছে মৃত্যু ধেয়ে আসছে দ্রুতবেগে।

হয়তো রুমু খুঁজবে ভেবেই হারিয়ে গেল মামুন। আর ‘যা পাওয়া হয় না, তাই হয়তো রয়ে যায় চিরকাল’ এই কথাকে সত্য করে দিয়ে শ্রাবণের মেঘ আর রুমুর বুকের ভেতর চিরকালের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হয়ে রয়ে গেল সে, মামুন।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]