ঈদের উৎসব: আমাদের কালে

ছেলেবেলার ঈদগুলো ছিল বড় মধুর। ছবি কৃতজ্ঞতা: ওয়াজির সাত্তার
ছেলেবেলার ঈদগুলো ছিল বড় মধুর। ছবি কৃতজ্ঞতা: ওয়াজির সাত্তার
গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক। কেমন ছিল সেই সময়কার শহুরে মানুষের ঈদ? তার একটি টুকরো ছবি ধরা পড়েছে এই লেখায়।

এ লেখার থাম্বনেইলে যে ছবিটি আছে, সেটি দেখে চোখ ফেরাতে পারিনি। আমার বন্ধু ওয়াজির সাত্তারদের তিন ভাইয়ের ছবি। ষাটের দশকে, চট্টগ্রামে কোনো এক ঈদের সকালে, চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রয়াত ও আর নিজাম সাহেবের বাড়ির সামনে। তিন ভাই একই রকমের সফেদ-সাদা পাঞ্জাবি আর কালো চটি পরে সম্ভবত তাদের বাবার জন্য অপেক্ষা করছে, ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য। কী নিষ্পাপ সুনন্দ একটি ছবি। দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল—ঈদের সকাল, সারা দিন, রাত্রি।

খুব ভোরে উঠে যেতাম ঈদের দিন। চোখ বন্ধ রেখেই টের পেতাম ঈদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে সারা বাড়িতে। দূর থেকে দুধ জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। আহ্, সেমাই বানানো শুরু হয়ে গেছে। বাবা ঝট করে বাজার সেরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, টের পাচ্ছি। রহিমন বু সারা ঘর তাঁর ভাষায় ‘ধোয়া-পাখলা’ শুরু করে দিয়েছেন। আমার ঘরের সামনেটা মুছতে মুছতে বসতেন, ‘উইঠ্যা পড় বাজান। ঈদের দিন সক্কাল সক্কাল উঠলে নেকি অনেক বেশি।’ নেকির লোভে নয়, চারদিকে যত কিছু হচ্ছে, তার কিছুই যেন বাদ না যায়, তা নিশ্চিত করতে ঝট করে উঠে পড়তাম। উঠতে উঠতেই দেখতাম, রাতে কখন যেন মা খলিফা চাচার সেলাই করা নতুন কাপড় বালিশের পাশে রেখে দিয়েছেন।

উঠেই রান্না ঘরে মায়ের কাছে, পুডিং হচ্ছে কি না নিশ্চিত করতে। মা তখন সেমাই সামলাতে ব্যস্ত, আগুনের গনগনে আঁচে ফরসা মুখ তাঁর তেতে লাল। আমার প্রশ্নে রেগে গিয়ে বলতেন, ‘এ ছেলে তো পুডিং পুডিং করে পাগল হয়ে যাবে।’ বলেই হয়তো তাঁর খারাপ লাগত। গলাটা অদ্ভুত নরম করে মুচকি হেসে বলতেন, ‘হচ্ছে পুডিং। পাউরুটিও দিয়েছি তাতে একটু।’ এরপর আমাকে আর পায় কে? তিন লাফে বসার ঘরে—ওটা সাজানোর ভার আমার। দেখতাম, মধ্য টেবিলে রহম আলী ভাইয়ের সাজানো ফুলের তোড়া, তার পাশে বাবা আতরদানি নামিয়ে রেখেছেন।

বসার ঘর সাজানো শেষ করতে করতে শুনতাম, বাবা স্নানের তাড়া দিচ্ছেন। স্নান সেরে নতুন জামাকাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমরা তিন ভাই তৈরি, তৈরি বাবাও। একটু টুকরো তুলোয় আতর লাগিয়ে কানের ভেতরে গুঁজে দিতেন বাবা, ঘষে দিতেন কবজিতেও। তারপর খাবার টেবিলে গরম সেমাই, যার সোয়াদই অনন্য। তারপর সবাই মিলে ঈদগাহের দিকে রওনা হওয়া। আমরা বেরোনোর মুখে মা বারান্দায় এস দাঁড়াতেন। আমরা চারজন তাঁকে বলে যাত্রা শুরু করতাম। সে সময়ে এক অদ্ভুত তৃপ্তি খেলা করত তাঁর মুখে।

পথে পথে চেনা-অচেনা কত লোক—সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর টুপিতে পরিবৃত। রঙিন পাঞ্জাবির চল তখনো শুরু হয়নি। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পথচলা। চলতে চলতে চোখে পড়ত, বাবার হাত ধরে আমার বন্ধু নওশাদরা দুই ভাই চলছে। ওদের মুখে কোনো হাসি নেই। মনে পড়ত, গত বছরই তো আসমা খালা চলে গেছেন। ভাবতাম, আজ নওশাদরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কেউ ওদের বিদায় জানায়নি। নামাজ শেষে ওরা যখন ফিরে যাবে, তখন মাকে ওরা সালাম করতে পারবে না। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠত।

নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে যেতাম যথারীতি। আমার পাশে এসে দাঁড়াত আমার বন্ধু নাজিম। সেজদায় গিয়ে দেখতাম, নাজিম চোখ খোলা রেখে চারদিক হাতড়াচ্ছে। ‘কোনো কোনো মানুষেরই নাকি সেজদার সময়ে পকেট থেকে পয়সা পড়ে যায়’—এই ‘নাজিম-তত্ত্বের’ সূত্র ধরে সে সেজদার সময়ে পয়সা খুঁজে বেড়াত। আমার এ মজার বন্ধুটি বহুকাল আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নামাজ শেষে কোলাকুলি যেন শেষ হতেই চায় না। সেই সঙ্গে সবার বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ।

সারা দিনে কত মানুষ যে আসত! বাবার সহকর্মীরা, বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা, আমার বন্ধুবান্ধব। আসতেন নিরামিষাশী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন। তবে একজন মানুষের খাওয়ার সময় শত কাজের মধ্যেও মা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন, খাবার তদারকি করতেন—তিনি নারাণদা।

বাড়ি ফিরে এক আশ্চর্য বিস্ময় অপেক্ষা করত আমাদের জন্য। আমাদের সদ্যস্নাতা মা সুন্দর ঈদের শাড়ি পরে, হালকা প্রসাধন করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কী সুন্দর যে লাগত তাঁকে! তাঁকে সালাম করার সময়ে পদ্মের মতো তাঁর সুন্দর পা’টাই নজরে পড়ত আমার। সালাম শেষে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে তিনি কিছু বলতেন, কী বলতেন, জানি না, কোনো আশীর্বাণীই হবে হয়তো। মনটা ভারি প্রশান্ত হয়ে যেত। ওই সালাম সেরেই ‘পথে এবার নামো সাথি’ বলে পাড়া বেড়ানো। বাড়ি বাড়ি ঘোরা, ভালো-মন্দ খেয়ে পেট ভরানো, শেষে এমন হতো অনেক সুখাদ্যও বাদ যেত।

আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু বরিশালে ‘ঈদি’র প্রচলন দেখিনি। হয়তো ছিল, কিন্তু আমাদের বলয়ে তা ছিল অনুপস্থিত।

সারা দিনে কত মানুষ যে আসত! বাবার সহকর্মীরা, বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা, আমার বন্ধুবান্ধব। আসতেন নিরামিষাশী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন। তবে একজন মানুষের খাওয়ার সময় শত কাজের মধ্যেও মা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন, খাবার তদারকি করতেন—তিনি নারাণদা (নারায়ণ ধাঙ্গড়) সারা কলেজপাড়ার সব রকমের ময়লা-জঞ্জাল সাফ করতেন।

ভারী সুপুরুষ ছিলেন নারাণদা। মেহগনির মতো কুচকুচে গায়ের রং, পেটানো শরীর, রামকিঙ্করীয় চুল আর আশুতোষ মার্কা গোঁফে তাঁকে এক দেবপুরুষ মনে হতো আমার। সুন্দর ধুতি আর রঙিন ফতুয়ায় সজ্জিত হয়ে মাদুরে আসনপিঁড়ি হয়ে খেতেন তিনি। খাওয়া শেষে গড় হয়ে প্রণাম করতেন মাকে। মা তাঁর হাতে এক প্রস্থ কাপড় তুলে দিতেন এবং সেই উপহার মাথা পেতে নিতেন তিনি। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি, মা নারাণদাকে ভিন্নভাবে সমাদর করতেন, যাতে তাঁর কিছুতেই যেন মনে না হয় যে তিনি আলাদা।

অতঃপর একসময় রাত নেমে আসত। মা-বাবা সেজেগুজে পাড়ায় ঈদ-বেড়ানোতে বেরোতেন। কী যে সুন্দর লাগত দুজনকে। বাবার হাতে জোরালো টর্চ আর মায়ের হাতে নকশা করা থলে। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। তবে খাব কী? সারা দিনের বড় রকমের পেটপুজোর জের তখনো যে চলছে। সেই সঙ্গে দিনভর টইটই করে ঘোরার ক্লান্তিও তো কম নয়। ঘুমে তাই চোখ বুঁজে আসত। বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আচ্ছন্নতায় মনে পড়ে যেত, হায় হায়, সারা দিনের উত্তেজনায় পুডিংটাই তো খাওয়া হয়নি! গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে অস্ফুট স্বরে বলতাম, ‘আমার পুডিং...!’

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]