রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে

ইন্সপেক্টর সাহেব, জানি, আপনি আমার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। তবু আমি আপনাকে বলব। সব বলব। তারপর আমাকে আপনি কী করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।

আলম ভাই ছোটবেলা থেকে আমাকে খুব পছন্দ করেন। আর সে জন্যই এত বছর পরে রংপুরে ফিরে সবার আগে আমাকেই ফোন দিয়েছিলেন। কত দিন ওনার সঙ্গে দেখা নেই, ওনার কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় পুরো পরিবার সেই যে ঢাকা চলে গেল, আর ফিরল না। অবশ্য ওনার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র কখনো ছিন্ন হয়নি, ফেসবুক জিনিসটা বাংলাদেশে একটু চালু হওয়ার পরই ফেসবুকে আলম ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছিলাম। তিনিই পাঠিয়েছিলেন বন্ধুত্বের অনুরোধ, অ্যাকসেপ্ট করতেই ইনবক্সে নক, ‘রূপু বাবু, কেমন আছিস!’ নিরস অক্ষরেও আন্তরিকতাটা যেন ধরা যায়। প্রোফাইল পিকচারের গোলগাল মানুষটা যেন আমাকে দেখেই খুশি হয়ে হাসছে।

তারপর থেকে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো মেসেঞ্জারে। তাঁর গ্র্যাজুয়েশন, করপোরেট কোম্পানির চাকরিতে ঢোকা, বিয়ে—সবকিছুর খবর পেতাম ফেসবুকে। আর তিনি নিতেন চকবাজারের খবর। ঢাকার নয়, রংপুরের চকবাজার পাড়া—যেখানে সেই ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি দুটো বাড়িতে বেড়ে উঠেছি আমরা। এই পাড়ার কাছাকাছি বয়সী আরও অনেকের সঙ্গেই ওঠাবসা ছিল আলম ভাইয়ের, কিন্তু আমার খোঁজখবর যে নিয়মিত নিতেন তিনি, তার একটা কারণ সম্ভবত আমার রংপুরেই থেকে যাওয়াটা। অন্য সবাই ঢাকা-রাজশাহী পড়তে গেলেও আমি বাড়ির পাশের কারমাইকেল কলেজেই ভর্তি হয়ে ঘরের ছেলে ঘরেই আছি।

আরেকটা কারণ, ছোটবেলা থেকে তাঁর আদরের পাত্র আমি। চকবাজার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে এই মানুষটাই আমাকে হাঁটা শিখিয়েছিলেন, তিনি নিজে তখন মাত্র পাঁচ বছরের বাচ্চা।

এবারে রংপুরে এসে যখন ফোন দিলেন, আমি যে কী খুশি হয়েছিলাম, বুঝতেই পারছেন। মেসেঞ্জারেই এত স্মৃতি রোমন্থন করতাম, আর বাস্তবের আড্ডা তো আরও জম্পেশ হবে। কিন্তু পার্কের মোড়ে তাঁকে যখন রিসিভ করলাম, তখন আমার হাসি মুছে গেছে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে। আলম ভাইয়ের চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি, ঠোঁটে যা লেগে আছে সেটা হাসি নয়, হাসির প্রেত। খালি ওই জড়িয়ে ধরে যখন বললেন, ‘রূপু বাবু, কত দিন পরে দেখা!’ তখনই শুধু মনে হলো, তিনি আমার ছোটবেলার প্রিয় মানুষটা।

মেসেঞ্জারে কত গল্প করেন মানুষটা, অথচ একটু পরে সাইফুলের দোকানের বিখ্যাত দুধ চা খেতে খেতে খেয়াল করলাম মাথা নিচু করে চুমুকই দিয়ে চলেছেন শুধু, মুখে রা নেই। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, ‘ভাই, সব ঠিকঠাক তো?’

চা খাওয়া শেষ আলম ভাইয়ের। খালি কাপটা দোকানের কাঠের পাটাতনের ওপরে রাখতে রাখতে হুট করে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, ‘রূপু, মনে আছে, বেলা তিনটার সময় বিটিভি খুলত আমাদের ছোটবেলায়? আটানব্বই-নিরানব্বই সালে?’

হঠাৎ এই প্রশ্ন? জবাব দিতে অবশ্য দেরি হলো না আমার, ‘জি ভাই। জাতীয় সংগীত বাজিয়ে পতাকা ওড়ানোর দৃশ্য দেখিয়ে বিটিভি চালু হতো। তারপরে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত, তরজমা এবং তাফসির। তারপর অন্য কোনো একটা ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ। ডিশ আসেনি চকবাজারে তখন, বিটিভিই দেখতাম। চ্যানেলটা অনেক ভালো ছিল সেই সময়।’

যেন ধা করে প্রাণ ফিরল আলম ভাইয়ের। চোখ তুলে তাকালেন যখন, দেখলাম কালি পড়া চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে ওনার। ‘তাই, না রে! আমাদের ছোটবেলার বিটিভি! আহা! নব্বইয়ের দশক যে কী একটা সেরা সময় ছিল!’

‘আসলেই ভাই’ বলে চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়েছি, কিন্তু আলম ভাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছেন। তড়িঘড়ি চায়ের দাম একটা দশ টাকার নোট ছুড়ে দিয়ে তাড়া লাগালেন আমাকে, ‘চল রূপু, একটা চক্কর মারি এলাকায়! আহা, আমার ছোটবেলার রংপুর—’

একটু পরেই দেখা গেল, এলাকার অলিগলি ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আলম ভাই, আমি তাঁর সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছি।

‘জায়গাটা কত বদলে গেছে, না রে রূপু?’ আলম ভাই এমনভাবে কথা বলছেন, যেন দম একটু খাটো হয়ে গেছে তাঁর, সেটা জোরে হাঁটার জন্য হতে পারে আবার উত্তেজনার জন্যও হতে পারে।

>আমি শিউরে উঠছি বারবার। এসব কী বলছেন আলম ভাই? চারপাশে চোখ চালালাম একবার। এত ঘুটঘুটে অন্ধকার কেন চারদিকে? দূরে পোলের গায়ে একটা মাত্র টিমটিমে আলো জ্বলছে কি জ্বলছে না। আরে, বাজারের থেকে না একটু দূরে ছিলাম আমরা?

‘জি ভাই’ বললাম আমি, কিন্তু আমার কথা শোনার অপেক্ষায় নেই আলম ভাই। তিনি বলে চলেছেন, ‘এই মসজিদ এখন দোতলা, আগে একতলা ছিল, ওটার পাকা ছাদের ওপরে আমার আমপারায় হাতেখড়ি, হুজুর সাহেবের কোলে বসে পড়তাম।’ আবার একটা পাকা মার্কেট দেখে বলছেন, ‘এখানে কালুর মুদির দোকান ছিল রে! আর রাস্তার এপাশে ছিল ইদু নাপিতের দোকান। শুক্রবারে চুল কাটাত আব্বু ধরেবেঁধে, আমি কাটাতে চাইতাম না।’

আমি একটু যোগ করলাম, ‘আর চৌরাস্তার এই দিকটাতে কসাইয়ের দোকান ছিল। পাশেই ভাতের হোটেলটা, পুরিও বেচত।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ!’ বললেন আলম ভাই, আমি অবাক হয়ে টের পেলাম তাঁর গলা কাঁপছে। ‘ঈদের দুদিন আগে থেকে এই মোড়ে টেবিল বসিয়ে আতর-টুপি-সুরমা বিক্রি করত, মনে আছে রে? আহা, আতরের ওই গন্ধ ছাড়া কি ঈদ হয়!’

পুরো পাড়া এত বদলে গেছে যে আমার ঠিকঠাক আর মনেও পড়ে না বিশ-বাইশ বছর আগের চকবাজার কেমন ছিল, কিন্তু আলম ভাই হাঁটছেন আর স্মৃতিচারণা করে বেড়াচ্ছেন পুরোদমে। দরদর করে ঘাম পড়ছে তার মুখে বেয়ে, মোছার চেষ্টা করতে দেখলাম না। সব কাহিনিতে একাধিক সমবয়সীর নাম আসছে কিন্তু তারা বর্তমানে কেমন আছে, সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না।

‘মনে আছে ওই পাড়ার পোলাপানের সঙ্গে সেই ভয়ানক ঢিল-যুদ্ধ? আমার তো মাথাই ফেটে গেল!’ আমাদের বাড়ির পাশটায় এসে বললেন আলম ভাই। আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে ভাইয়ের মেমোরি লেনে হাঁটা শুরু হওয়ার পর। এ-গলি ও-গলি ঘুরে ঘুরে ততক্ষণে হাঁপিয়ে গেছি একদম, কথা বলার সাধ্য নেই। কোনোমতে মাথাটা ওপর-নিচ করতে পারলাম খালি।

‘তারপর সেই ফাটা মাথা বেয়ে তো দরদর করে রক্ত ঝরছে! এই মাথা নিয়ে বাড়ি যাই কীভাবে! রক্তটা একটু কমার পরে জামাকাপড়সহ তোমাদের বাইরের বাথরুমটায় গোসল করে ফেললাম, রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলতে—হা হা হা...।’ হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন আলম ভাই, আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম তাঁর গায়ে। তাঁর চোখের দিকে নজর পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা স্রোত নেমে গেল, ঢোঁক গিললাম একটা। ডুবতে থাকা সূর্যের শেষ আলোয় চকচক করছে তাঁর চোখের তারা, ঠিক প্রকৃতিস্থ নয় ও দুটো। ব্যাপারটা কী? ভাইয়ের কী হয়েছে? হুট করে এভাবে রংপুর কেন এসেছেন তিনি? না, ঘুরতে নয়। তাহলে তো সকালবেলাই চলে আসতেন।
হঠাৎ আবার হাঁটা শুরু করলেন তিনি। স্মৃতিচারণাও ফের শুরু, ‘বাসায় ঘটনাটা লুকাতে পেরেছিলাম, কিন্তু পরের দিন বিকেলে শিউলি মজা করে যখন চুল ধরে টান দিয়েছে, তখন ঠিক ওখানটাতেই ব্যথা পেয়ে আবার রক্ত পড়তে শুরু করেছে। তাই দেখে ভয় পেয়ে শিউলির কী কান্না।’

আমার মনে পড়ল, হ্যাঁ, শিউলি আপুর সঙ্গে ভাইয়ের খুব খুনসুটি দেখতাম বটে। তখন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছি ওটাকে প্রেম বলা যায়। ওনাদের দুজনেরই প্রথম প্রেম।

‘শিউলি এখন কোথায়, রূপু?’ খুব বেশি সাদামাটা গলায় জিজ্ঞেস করলেন আলম ভাই।

আমি চমকালাম, কারণ এই প্রশ্নের উত্তর তাকে আগেও দিয়েছি আমি ম্যাসেঞ্জারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল কুড়িগ্রামের কোথায় যেন—আধা সরকারি চাকুরে, টাক মাথার বয়স্ক এক চরম বোরিং লোকের সঙ্গে। তার সংসারের ঘানি টানছেন এখন শিউলি আপা, একাধিক বাচ্চা হয়ে সোনার অঙ্গ কালি হয়েছে। এত কিছু জানার দরকার নেই আলম ভাইয়ের। বললাম, ‘ওনার বছর ছ-সাত বছর হলো বিয়ে হয়েছে। এখন কুড়িগ্রামে থাকেন।’

আলম ভাইকে দেখে এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো কিছু বলবেন, বুকটা ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসবে কয়েকটা শব্দ, কথা বললেনও বটে তিনি, কিন্তু তা শুনে আমি ভড়কে গেলাম, ‘রূপু, বিদেশি সিরিজগুলো যে দিত বিটিভিতে, মনে আছে?’

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজানের শব্দ ছাপিয়ে কোনোমতে বললাম হতভম্ব আমি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই। আমেরিকান “সিন্দবাদ” সিরিজ, “রোবোকপ”, “হারকিউলিস”, “আলিফ লায়লা”, “হাতেম তাই” আর স্পেশালি “এক্স ফাইলস”।’ আহা! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন আলম ভাই। ‘আমেরিকার ফক্স চ্যানেলের সঙ্গে একসঙ্গে প্রচারিত হতো বিটিভিতে, রাত ১০টার ইংরেজি খবরের পরে। এজেন্ট মোল্ডার আর এজেন্ট স্কালি কী অদ্ভুত সব রহস্য সমাধান করে বেড়াত!’

আলম ভাই বকবক করতে করতে একটা অন্ধকার গলিতে পা চালালেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে দ্রুত, আর একটু পরেই এসব গলির ভেতরে কিচ্ছু দেখা যাবে না। আমি ভাবছি, আপনার রহস্যটা তো আমি সমাধান করতে পারছি না, ভাই! এত নস্টালজিয়ায় ভুগছেন কেন আপনি? নস্টালজিয়ায় আমরা সবাই কমবেশি ভুগি, ঠিক আছে, কিন্তু আপনারটা তো পাগলামির পর্যায়ে চলে গেছে!

চকবাজার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে চলে এসেছি আমরা। পাশেই বাজার, আলো, কিন্তু আজ কেন যেন আঁধার হয়ে আছে এই জায়গাটা, লোকজনের হট্টগোলও কানে আসছে না। আজব। ভাইয়ের গল্প কিন্তু থামেনি। বকবক করছেন, ‘একদিন “এক্স ফাইল”-এ অসাধারণ মিউজিক শুরু হতে না হতেই কারেন্ট চলে গেল। কী আর করা, আব্বুর নিষেধ না শুনে বেরিয়ে এলাম বাইরে, এই স্কুলের মাঠে! ডেকে ডেকে বের করলাম নাহিদ, জিতু, শাকিল এদের। ফকফকে চাঁদের আলো ছিল সেদিন, মাঠে ঘাসের ওপর বসে একের পর এক ভূতের গল্প করে “এক্স ফাইলস”-এর নেশা মিটিয়েছিলাম আমরা প্রায় সাড়ে ১১টা অব্দি। তার মধ্যে একটা গল্প আমার এখনো মনে পড়ে রূপু...।’
আমি দুর্বল গলায় ডাকলাম, ‘ভাই।’

‘আরে শোনো না।’ মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন আলম ভাই। ‘ওই যে সেই ক্ল্যাসিক গল্প। তখন সবার মুখে মুখে ছিল। এই সামনের কামারের মোড় থেকে অনেক রাতে দুজন যাত্রী তোলে এই পাড়ারই এক রিকশাওয়ালা। অনেক ভাড়া দেবে তারা, কিন্তু একটাই শর্ত, রিকশা চালানোর সময় পেছনে তাকানো যাবে না। রিকশাওয়ালা রাজি। একটা বড়সড় বস্তা নিয়ে রিকশায় উঠল চাদর দিয়ে শরীর আগাগোড়া ঢাকা দুই যাত্রী। রিকশা চলছে। একটু পরে চপচপ ধরনের একটা শব্দ পেল রিকশাওয়ালা, কিন্তু শর্তের কথা ভেবে পেছনে তাকাল না। ওদিকে চপচপ শব্দের কিন্তু থামার নাম নেই। কৌতূহলের কাছে হার মেনে পেছনে তাকাল রিকশাওয়ালা। দেখে, বস্তা থেকে একটা বাচ্চার লাশ বের করে চপচপ করে চিবিয়ে খাচ্ছে দুই পিশাচ। ধোঁকার চাদর খসে পড়েছে শরীর থেকে, সারা গাভর্তি ছোট-বড় শত শত চোখ পিটপিট করছে তাদের। রিকশাওয়ালা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান। তিন দিন পরে রংপুর হাসপাতালে মৃত্যু। এবং এই-ই একমাত্র শিকার নয়। অনেকেই ওদের দেখে ঠিক তিন দিন পরে মারা গেছে। কী যে ভয় পেতাম এই গল্প শুনে...।’

আমি কোনোমতে গলায় জোর এনে বললাম, ‘আলম ভাই, আপনার কী হয়েছে?’
যে কণ্ঠে গল্পটা বলছিলেন, সেটা এমনকি পাল্টালেনও না আলম ভাই, ওভাবেই বললেন, ‘আমার চাকরিটা আর থাকবে না রে রূপু। বসের সঙ্গে অনেক বড় ঝামেলা করে ফেলেছি, চাকরি তো যাবেই, শুনেছি তহবিল তছরুপের এমন মামলা সাজাচ্ছে ওরা যে জেলেও যেতে হতে পারে আমাকে। আর রিয়া, তোর ভাবি, তাকে বাইরে অন্য একজনের সঙ্গে অনেকেই দেখেছে বলে কানে আসত, পাত্তা দিতাম না। কিন্তু একদিন অসময়ে অফিস থেকে ফিরে দেখি আমারই বেডরুমে তারা দুজন...।’

আলম ভাইয়ের কথা শুনে আমি থ। কী বলব? মানুষটা কেন ঢাকা থেকে এভাবে দৌড়ে এসেছেন ছোটবেলার শহরে, কেন এমন উদভ্রান্ত আচরণ করছেন, তা একটু-আধটু এখন বুঝতে শুরু করেছি বটে।

‘আমার এখন সারা দিনই মনে হয়, আমি রংপুরে থেকে গেলে বোধ হয় এমনটা হতো না,’ শান্ত গলায় কথা বলছেন ভাই, উদভ্রান্ত ভাবটা আর নেই। ‘সহজ, স্বাভাবিক একটা জীবন পেতাম। হয়তো শিউলিকে বিয়ে করতাম।’ শ্বাস টানার জন্য এক সেকেন্ড বিরতি নিলেন, ‘আর আমার এটাও মনে হয়, এখনো সম্ভব ওই জীবনটা পাওয়া।’

‘কীভাবে?’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন। যা-ও একটু পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল, আবার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।
‘আমি টের পাই,’ আলম ভাইয়ের কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে তিনি যা বলছেন তা বিশ্বাস করেই বলছেন, ‘যদি ঠিকমতো চাই, তাহলে আমি আবার ওই সময়টায় ফিরে যেতে পারব।’

‘কোন সময়টায়?’ কলের পুতুলের মতো আওড়ালাম আমি।

‘১৬ মে ১৯৯৯। ওই চাঁদের আলোয় বসে গল্প করার রাতটায়।’

‘মানে...সত্যি সত্যি?’ বুঝতে পারছি, চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে আমার।
‘হ্যাঁ, রূপু। আমি স্বপ্নে দেখি, সবাই আমাকে ডাকে। ১০ বছর বয়সের নাহিদ, জিতু, শাওন...লাইন ধরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ডাকে...বলে ওদের সঙ্গে মিশে যেতে, ১০ বছর বয়সের হয়ে মিশে যেতে...নিরানব্বই সালে ফিরে যেতে...।’ ভাইয়ের কণ্ঠে কাঁপুনিটা আবার ফিরছে।

আমি শিউরে উঠছি বারবার। এসব কী বলছেন আলম ভাই? চারপাশে চোখ চালালাম একবার। এত ঘুটঘুটে অন্ধকার কেন চারদিকে? দূরে পোলের গায়ে একটা মাত্র টিমটিমে আলো জ্বলছে কি জ্বলছে না। আরে, বাজারের থেকে না একটু দূরে ছিলাম আমরা?

‘আবার দশ বছরের হয়ে যাব আমি...স্কুলে পড়ব, খেলব শিউলির সাথে, হুমায়ূন আহমেদের “আজ রবিবার” নাটক দেখব...নতুন করে জীবনটা শুরু করব। তুই ভাবছিস, কীভাবে? স্রেফ চাইতে হবে রে! স্রেফ প্রচণ্ডভাবে চাইতে হবে। তাহলে ওরা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নিরানব্বই সালে, আবার ছোটবেলায় মিশে যাব আমি।’ ভাইয়ের গলার কাঁপুনিটা আমার গায়েও এখন টের পাচ্ছি আমি, আর দেখছি, আশপাশের ঘুটঘুটে আঁধার কেমন যেন পাতলা হয়ে আসছে, যেন ঘোলা পানি থিতিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে আবছা দেখতে পাচ্ছি স্কুলঘর, গাছ, একটু দূরে নির্জন রাস্তা।

নিজের ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। কী ভেবে আকাশের দিকে তাকাতেই ছ্যাঁত করে উঠল বুকের ভেতরটা। বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। কিন্তু কই, আজ তো পূর্ণিমা নয়, গত সপ্তাহেই না হয়ে গেল!

চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখছি, পাশের বাজারটা গায়েব হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে বেশির ভাগ লোকজনও। কেবল চারজন দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশে—এবারে তারা হাত তুলে ডাকছে আমাদের।

গোটা শরীর শিউরে উঠল আমার। মুখ দেখা যাচ্ছে না একজনেরও, কিন্তু আমি জানি ওরা ’৯৯ সালের নাহিদ, শাওন, জিতু, শাকিল। ‘আয়-আয়-আয়-চলে আয় আলম’ ওদের ডাকটা কেমন একঘেয়ে, প্রাণহীন, যেন তোতাপাখি বুলি আওড়াচ্ছে।
‘চল রূপু, চলে আয়’ বলে আমার হাতটা ধরলেন আলম ভাই। গলাটা এমন মিহি শোনাচ্ছে কেন ওনার, সেটা বুঝলাম একবার তাকিয়েই-সেই ১০ বছরের আলমে পরিণত হয়েছেন তিনি আবার, হাফপ্যান্ট পরা।

তখনো খানিকটা শক্তি বোধ হয় ছিল আমার ভেতরে কোথাও। ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আমি, ঘুরলাম বোঁ করে। প্রাণপণে দৌড়ে পালানোর জন্য ছটফট করছে ভেতরটা, কিন্তু পা ছেঁচড়ে কোনোমতে এগিয়ে চলার চেয়ে বেশি কিছু করা গেল না। কোথায় যাচ্ছি, আদৌ পালাতে পারব কি না, পালানো উচিত কি না, কিছুই জানা নেই। কেবল টের পাচ্ছি, যারা ডাকছে, তাদের মাঝখানে বড় কোনো গড়বড় আছে। খুব বড় কোনো গড়বড়।

ঘোরের মধ্যে পেছন থেকে শুনলাম আলম ভাইয়ের গলায় চব্বিশ ক্যারেট খাঁটি আনন্দের চিৎকার, ‘আসছি রে! আসছি!’ তারপর ধুপধাপ দৌড়ের শব্দ। আমার কথা ভুলে গিয়ে দৌড়াচ্ছেন তিনি, নিজের পচে যাওয়া জীবনটা পেছনের রেখে দৌড়াচ্ছেন প্রায়-স্বর্গ শৈশবের দিকে।

দৌড়ের শব্দ থামতে শুনলাম। যেন অনেক দূর থেকে বারো আনা বিস্ময় আর চার আনা আনন্দ মেশানো গলায় বলতে শুনলাম আলম ভাইকে, ‘কি রে জিতু! রিকশাটা কেন? আমরা কি ঘুরতে যাব কোথাও?’

এক সেকেন্ড নীরবতা। দুই সেকেন্ড। আমি কোনোমতে পালাচ্ছি। তিন সেকেন্ড...
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন ১০ বছর বয়সে ফিরে যাওয়া আলম ভাই। নিখাদ আতঙ্কের চিৎকার, গলা চিরে রক্ত বের হওয়া চিৎকার।
জানি, বিরাট ভুল করছি, জানি যে পস্তাতে হবে এটার জন্য, তবু ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়ে পারলাম না। দেখলাম চাঁদের আলোটার ঔজ্জ্বল সীমা ছাড়িয়ে গেছে, যেন থইথই করছে জোছনা। সেই আলোয় চকচক করছে ১০ বছরের ছেলের আকারের চার পিশাচের গা–ভর্তি ছোট বড় অজস্র ঘিনঘিনে চোখগুলো।

আলম ভাইকে টানতে টানতে একটা রিকশায় নিয়ে তুলছিল তারা।

পরের কাহিনি তো আপনি জানেন ইন্সপেক্টর সাহেব।সকালে হাঁটতে বের হওয়া বুড়োর দল আমাকে পায় স্কুলের মাঠে, অজ্ঞান। আলম ভাইয়ের ব্রিফকেসটা আমার পাশে পড়ে ছিল, কিন্তু তিনি নেই।

তাঁর খোঁজ দিতে বলছেন? এই ২০২০ সালে কোথাও পাবেন না ওনাকে। পিশাচগুলো ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৯৯-এ, ওখানেই ওনার লাশ খুঁজতে হবে আপনাদের। ওই সময়ের খবরের কাগজ পড়ে দেখুন, রংপুরের রাস্তার পাশে খুবলে খাওয়া বালকের লাশের খবর পেলেও পেতে পারেন। জানবেন, ওটাই আলম ভাই।

স্যার, আপনি আমাকে হাজতে ফেরত পাঠাবেন, জানি। কিন্তু একটু কি আমার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে দেবেন আজকে? প্লিজ?

কারণ পিশাচগুলোকে তো আমি দেখেছিলাম ঠিক তিনটা দিন আগে!

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]