গুজবের মহামারি, মহামারির গুজব

করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের কাছে মানুষ একরকম অসহায়। তার চেয়েও বেশি অসহায় এই মহামারি ঘিরে বেড়ে ওঠা অসংখ্য গুজবের কাছে। এ পৃথিবী আগেও মুখোমুখি হয়েছে প্লেগ, কলেরা, টাইফয়েড, গুটিবসন্ত ইত্যাদি মহামারির। অসুখ যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, তার চেয়েও দ্রুত ছড়িয়েছে একে কেন্দ্র করে গুজব। অন্তর্জাল ঘেঁটে তেমন কিছু মহামারিকেন্দ্রিক গুজব নিয়ে এই লেখা।

1.q7+6=13—এই সূত্র দিয়ে শুরু করা যাক। অন্তত বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা ইউটিউবে নিয়মিত, এমন একটি মানুষ বোধ হয় পাওয়া যাবে না, যাঁরা এই সূত্রের সঙ্গে পরিচিত নন। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ‘অতি বিখ্যাত’ এই সূত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন ইসলামি বক্তা মুফতি কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম। ইতালিপ্রবাসী কোনো এক বাঙালি যুবক স্বপ্নের মাধ্যমে এই সূত্র পেয়ে সেটা জানিয়েছিলেন কাজী ইব্রাহীমকে। শুরুতে মুফতি ইব্রাহীম দাবি করেছিলেন যে এর ব্যাখ্যাও তিনি জানেন, কিন্তু বলবেন না। অবশ্য পরে এর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তিনি।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক তত্ত্ব ও তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যে কতটা সঠিক আর কতটা ঠিক নয়, সেটা বোঝাই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। শুরুর দিকে তো একটি তথ্যই মহামারি আকারে ঘুরছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে—প্রতি শতাব্দীর ২০ সালে একটি বড় মহামারি আসে। বলা হয় ১৭২০, ১৮২০ ও ১৯২০ সালে তিনটি মহামারি এসেছে প্লেগ, কলেরা, ফ্লুর রূপ ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে এই করোনা মহামারি। এতটা নিখুঁতভাবে কি সত্যিই মহামারি এসেছিল পৃথিবীতে? খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এই তথ্য পুরোপুরি সঠিক নয়।

ডাইনিবৃত্তির অভিযোগে নারীদের ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
ডাইনিবৃত্তির অভিযোগে নারীদের ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় প্রারম্ভিক ইতিহাস থেকে শুরু করা যাক। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে গ্রিকরা মহামারি হিসেবে প্লেগের সঙ্গে পরিচিত হয়, যেটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য প্লেগ অব এথেন্স’। অবশ্য অনেক ইতিহাসবিদের মতে, মহামারিটিছিল ইবোলা, টাইফয়েড, টাইফাস জ্বর, গুটিবসন্ত কিংবা অ্যানথ্রাক্স। ১৬৫-১৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পৃথিবীতে হানা দেয় ‘এন্টোনাইন প্লেগ’। ৫৪০-৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মিসর আক্রান্ত হয়েছিল ভয়াবহ এক মহামারি দ্বারা, যার নাম ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’, যেটি চক্রাকারে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং মোট আড়াই কোটির বেশি মানুষ মারা যায় এতে। ধারণা করা হয়, ইউরোপের অর্ধেক মানুষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এ সময়। এরপর ১৩৩৪ সালেও প্লেগেই ইউরোপজুড়ে মৃত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আড়াই কোটি। ১৩৪৭-৫১ খ্রিষ্টাব্দ সময়ে ‘ব্ল্যাক ডেথ’, যা মূলত একধরনের প্লেগ, ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপজুড়ে। পরবর্তী ২০০ বছরে ব্ল্যাক ডেথের থাবায় মারা যায় অন্তত ১০ কোটি মানুষ। ১৫১৯ সালে মেক্সিকোতে স্মলপক্স, ১৬৩৩ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্মলপক্স, ১৭৯৩ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ‘ইয়েলো ফিভার’, ১৮৬০ সালে চীনে উৎপত্তি হয়ে প্রায় দুই দশক স্থায়ী প্লেগ, ১৯১০ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়ায় প্লেগ, ১৯১৬ সালে নিউইয়র্কে পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে পোলিও, ১৯১৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ১৯৭০ সালে ভারতে ছড়িয়ে পড়া গুটিবসন্ত, ১৯৮৪ সালে এইচআইভি ভাইরাস, ২০০৩ সালে সার্স, ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১০ সালে কলেরা এপিডেমিক অব হাইতি, ২০১২ সালে হাম, ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা জ্বর—নানান ভয়ংকর অসুখ মহামারি হিসেবে আক্রমণ করেছে। নানাভাবে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। এসব অসুখে হাজার থেকে শুরু করে কোটির অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সব শেষে আজকের ‘বিখ্যাত’ করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালে চীনের উহান শহরে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছেন সাড়ে ছয় লক্ষাধিক মানুষ। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই যে প্রতি ১০০ বছরে মহামারি ছড়িয়ে যাওয়ার একটা তথ্য যে দিনের পর দিন ঘুরেছে ফেসবুকের নিউজ ফিডজুড়ে, পত্রিকার পাতায়, অনলাইন পত্রিকায়, সেটা স্রেফ গুজব বৈ কিছুই নয়। অন্তত অনেকটাই রং চড়ানো।

করোনা-আতঙ্কের শুরুর দিকে এই ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
করোনা-আতঙ্কের শুরুর দিকে এই ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

এই ‘শতাব্দী’-তত্ত্বের মতোই নানান ভুয়া খবর, ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব ও গুজব ছড়িয়েছে ‘ঋতু’-ভিত্তিক। স্বপ্নের মাধ্যমে পাওয়া প্রতিষেধক তো আছেই, এর বাইরেও অনেকগুলো ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব ও গুজব ডালপালা মেলেছে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে। বগুড়ায় জন্মের ১০ মিনিটের মাথায় মারা যাওয়া এক শিশু জন্ম নেওয়ার পরপরই বলে গিয়েছিল করোনার মহৌষধের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই গুজব। মধ্যরাতে হেলিকপ্টার থেকে রাসায়নিক ছিটানোর তথ্যও ছড়িয়েছিল খুব। বাংলাদেশি এক চিকিৎসক দাবি করেছিলেন, ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনা ছড়ায় না। সেটি পশ্চিমবঙ্গে ভালোই ছড়িয়েছিল। টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত কিছু যুবক প্লেট চেটে খাচ্ছে এবং করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে—ভিডিওসহ এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। এমন আরেকটি ছবিও ছড়িয়েছিল যে খাবার পরিবেশনের আগে তাতে থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছেন মুসলিম এক তরুণ। দুটিই করোনার আবির্ভাবের আগের ভিডিও বা স্থিরচিত্র। এর সঙ্গে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব ছিল একদমই ভিত্তিহীন। এ ছাড়া হালকা গরম পানিতে লেবুর শরবত খাওয়া, মিথানল পান, গরম পানিতে গোসল, ত্বকে অ্যালকোহল কিংবা ক্লোরিন স্প্রে, গোমূত্র পান, স্যালাইন দিয়ে নাক ধোয়া ইত্যাদি পালনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব; কিংবা বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলেই করোনা কমবে, কেবল বৃদ্ধ ও কম বয়সীরাই এর ঝুঁকিতে আছে, বাচ্চারা করোনায় আক্রান্ত হয় না—এমন অজস্র তত্ত্ব ছড়িয়েছে ক্রমাগতভাবে। সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল যে গুজব, সেটি হলো চীনের লোকজন বাদুড়ের স্যুপ খায়, সে কারণেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। এ ছাড়া ছিল জোড়ে-বিজোড়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব: যেমন চীনের এক ল্যাবরেটরিতে এই ভাইরাস কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন করা হয়েছে, কিংবা চীনকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে এসব আসলে আমেরিকার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। আমেরিকার ওপরে এর আগেও ভিত্তিহীন, তথ্য-প্রমাণহীন কিছু অভিযোগ এসেছে। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইডস ছড়িয়ে পড়ার পর ১৯৮৩ সালে গুজব ছড়ায় সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবি। বলা হয় ফোর্ট ড্রেট্রিকে জীবাণু অস্ত্র হিসেবে মার্কিনরা এইচআইভি উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীকালে প্রয়োগ করা হয় বন্দী, সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় ও সমকামীদের ওপর। আবার নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকায় ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার পরও অনেকে আমেরিকা আর ব্রিটেনকে দায়ী করল।

উনিশ শতকের শেষভাগে কলকাতায় প্লেগ মহামারির সময় করপোরেশন থেকে সবাইকে গৃহবন্দিত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। শহরবাসী তাতে রাজি হলো না। বরং গুজব ছড়াতে লাগল, ভদ্রলোকেরা নয়, পাপীরাই কেবল প্লেগে মরবে। প্লেগ হবে শুধু ছোটলোকের। প্লেগ যখন ছড়াতে শুরু করল, আবার গুজব ছড়াল, টিকা নেওয়ার ১০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। বলা হলো, এটা সাহেবদের ষড়যন্ত্র।

১৯১৮-২০ সালে আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কার করে—অনেকেই বিশ্বাস করতেন এই তত্ত্ব। ২০১৫ সালে ভ্যাংকুভারে টেড কনফারেন্সে বিল গেটস বলেছিলেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি কোনো কারণে এক কোটি মানুষ মারা যায়, সেটি কোনো সংক্রামক ভাইরাসের কারণেই হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু পাঁচ বছরের মাথাতেই সেটা ঘটেছে, তাই একদল দাবি করছে যে বিল গেটসই করোনাভাইরাস তৈরি করেছেন, পরবর্তী সময়ে এর ভ্যাকসিন বিক্রি করে টাকা কামানোর জন্য।

ভিডিও ছড়িয়েছিল, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা করোনার ভয় থেকে মুক্ত, তাদের আসলে কিছুই হবে না, তাই করোনা প্রাদুর্ভাবের পর অনেক চীনা নাগরিক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। সেটিও করোনা মহামারি ছড়ানোর আগের ভিডিও। মসজিদে গিয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের প্রার্থনা করার একটি ছবি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল, যদিও তাতে যাঁকে দেখা গেছে, তিনি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আহমেদ বাদাই। ভিডিওটি ২০০৪ সালের মে মাসের।

অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ব্ল্যাক ডেথের থাবায়। ছবি: সংগৃহীত
অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ব্ল্যাক ডেথের থাবায়। ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কাজয়ী ওরহান পামুক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, মহামারির সময় সবচেয়ে প্রচলিত দুটি গুজব হলো: কে এই অসুখ বহন করে এনেছে এবং কোথা থেকে এসেছে এটি? এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করা যায়, সেটি হলো এই মহামারি থেকে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যায়। ফলে বেড়ে যায় নানান চর্চা, হোক সেটা হাস্যকর, ছেলেমানুষি বা নিষ্ঠুরতায় ভরা। ওপরে যে গুজবগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগই হয় মহামারি থেকে মুক্তির একটি পথ খোঁজা অথবা ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো, কিংবা সুযোগ নেওয়া। এগুলোর প্রভাব খুব ভয়াবহ ছিল না। কিন্তু ভয়ংকর প্রভাব পড়েছে, এমন অজস্র গুজবও ছড়িয়েছে মহামারিকে কেন্দ্র করে, যার রেশ টানতে হয়েছে নিরীহ মানুষকে, এমনকি বিশেষ কোনো জাতিকে পর্যন্ত। অসংখ্য উদাহরণ আছে এমন। একটু নজর বোলানো যাক:

উনিশ শতকের শেষভাগে কলকাতায় প্লেগ মহামারির সময় করপোরেশন থেকে সবাইকে গৃহবন্দিত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। শহরবাসী তাতে রাজি হলো না। বরং গুজব ছড়াতে লাগল, ভদ্রলোকেরা নয়, পাপীরাই কেবল প্লেগে মরবে। প্লেগ হবে শুধু ছোটলোকের। প্লেগ যখন ছড়াতে শুরু করল, আবার গুজব ছড়াল, টিকা নেওয়ার ১০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। বলা হলো, এটা সাহেবদের ষড়যন্ত্র। পেট থেকে এক পয়সা মাপের মাংসখণ্ড তুলে নিয়ে তার মধ্যে প্লেগের জীবাণু পুরে দেওয়া হয়, যাতে রোগী জীবিত থাকলেও মরে যায়।

স্লাভোয় জিজেকের ‘প্যানডেমিক: কোভিড ১৯ শেকস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ের প্রচ্ছদ
স্লাভোয় জিজেকের ‘প্যানডেমিক: কোভিড ১৯ শেকস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ের প্রচ্ছদ

মধ্যযুগে গুজব ছড়িয়েছিল রোগমুক্তির আশায় ইহুদিরা খ্রিষ্টান শিশুদের রক্তে গোসল করে, যার ফলে বহু দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৩২১ সালে ফ্রান্সে গুজব রটে যে শরীরের মাংস পচে যাওয়া বা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ইহুদি রোগীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কুয়ার পানিতে এই রোগের জীবাণু মিশিয়ে দিচ্ছে। আরও বলা হয় যে মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ইহুদিদের অর্থায়নে কুষ্ঠ রোগীরা পানিতে এই রোগের জীবাণুর বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এ কাজে স্বয়ং শয়তান জড়িত বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। এই গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়। জনতার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বহিরাগত, বিদেশি, ভিক্ষুক, তীর্থযাত্রী, জিপসি, কুষ্ঠ ও সোরিয়াসিসের রোগীর ওপর। এদের মেরে ফেলা হয়েছিল অকাতরে। একাধারে মুসলমান, ইহুদি, কুষ্ঠরোগী, অপরিচিত ব্যক্তিসহ অসংখ্য মানুষকে নানা কায়দায়, বিশেষ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কুষ্ঠরোগী ও ইহুদিদের বেশ কিছু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ধনসম্পদ, বাড়িঘর দখল করে নেওয়া হয়।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কাজয়ী ওরহান পামুক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, মহামারির সময় সবচেয়ে প্রচলিত দুটি গুজব হলো: কে এই অসুখ বহন করে এনেছে এবং কোথা থেকে এসেছে এটি?

স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্লাভোয় জিজেক তাঁর ‘প্যানডেমিক: কোভিড ১৯ শেকস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে সুইস-মার্কিন মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ কুবলা-রসের ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডায়িং’ বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, বাঁচার আশা নেই এমন অসুখের কথা জানার পর আমাদের পাঁচটি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হয়। যখনই কোনো সমাজ ভীতিকর ছন্দপতনের মুখোমুখি হয়, তখন যেকোনো বোধশক্তিসম্পন্ন লোকই ওই পাঁচ পর্যায়কে উপলব্ধি করতে পারে। এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিক্রিয়াটি হলো ক্রুদ্ধভাব (যখন আর সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তখন ক্রোধে ফেটে পড়া)। মহামারির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। একপর্যায়ে লোকজন পাপপূর্ণ জীবনের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়। ভাবে, ওই পাপের কারণেই এমন শাস্তি। ক্ষোভ প্রকাশের জন্য তখন ছায়া কাউকে তৈরি করা হয়, যে বা যিনি এই মড়কের জন্য দায়ী। এই ক্ষোভের বলি হয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ।

১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগ মহামারি ইউরোপকে গ্রাস করলে একে কেন্দ্র করে শুরু হয় অদ্ভুত একটি ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের পেছনেও মাধ্যম ছিল সেই গুজব, যার প্রভাবেই ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শুরু হয় উইচ-হান্টিং বা ডাইনি নিধনযজ্ঞ। চিকিত্সকেরা সে সময় কিছুতেই এ রোগের প্রধান কারণ ধরতে পারছিলেন না। স্বল্প সময়ের মধ্যে অজস্র ভয়ংকর মৃত্যুকে মানুষ কোনো অবস্থায়ই মেনে নিতে পারেনি। তাদের মন ছেয়ে যেতে থাকে কুসংস্কারের কুয়াশায়। তারা ধারণা করতে শুরু করে যে এটি নিশ্চয়ই শয়তানের কাজ। শুরু হয় শয়তানের প্রতিনিধিদের খুঁজে বের করে নৃশংসভাবে হত্যা করা।

তৎকালীন বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) এক রোগীকে প্লেগের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
তৎকালীন বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) এক রোগীকে প্লেগের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

সমাজের শাসকশ্রেণিরাও দায়ী করে দুর্বল বা প্রান্তিক শ্রেণির মানুষকে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইহুদি সম্প্রদায়। তখন সমাজ তাদের বিশেষ সুনজরে দেখত না। ফলে, শাসকশ্রেণির দেখাদেখি সাধারণ মানুষও তৈরি করে নিজস্ব উইচহান্টারের দল। এরা তদন্তের নামে ইচ্ছেমতো অত্যাচার, লুটতরাজ ও মানুষ হত্যা শুরু করে। ১৩৪৮ সালের ‘পাম-সানডে’র দিন টুলন শহরে ৪০ জন ঘুমন্ত ইহুদিকে পুড়িয়ে মারা হয়; একই বছর মে মাসে কার্কাসন্নে ও নারবন্নে শহরের সব ইহুদিকে মেরে ফেলা হয়; ১৩৪৯ সালের জানুয়ারিতে বাজেল শহরে ২০০ ইহুদিকে একটা গোলাঘরে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়; স্ট্রাসবুর্গে পুড়িয়ে মারা হয় ৯০০ জন ইহুদিকে। বাকিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ইহুদিদের কাছ থেকে অনেকেই প্রচুর টাকা ধার নিত। ইহুদিদের হত্যা করলে বা তাড়িয়ে দিলে ধার শোধ করতে হবে না বলেই এ নৃশংস কর্মকাণ্ডে সেসব মানুষ যোগ দেয়, যারা মূলত ইহুদিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল।

অবস্থা হাতের বাইরে চলে যেতে থাকায় খ্রিষ্টান ধর্মগুরু পোপ ষষ্ঠ ক্লেমেন্ট একটি ধর্মীয় আদেশে বলেছিলেন, ‘প্লেগ এনেছে ঈশ্বরের ক্রোধ, যার সৃষ্টি খ্রিষ্টানদের পাপের কারণে,’ যদিও তাতে মানুষ হত্যা খুব একটা কমেনি।

মহামারি তার ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের সামনে মানুষকে একরকম অসহায় করে দেয়। কিন্তু দেখা যায়, মানুষ একসময় তার চেয়েও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে মহামারি ঘিরে বেড়ে ওঠা অসংখ্য গুজবের গুল্মে। অসুখ যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে, তার চেয়েও দ্রুত ছড়ায় একে কেন্দ্র করে গুজব। সেসব গুজবের প্রতিক্রিয়া হয় সুদূরপ্রসারী।

পাঁচ বছর আগেই বিল গেটস আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ভয়াবহ ভাইরাস আক্রমণের। ছবি: সংগৃহীত
পাঁচ বছর আগেই বিল গেটস আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ভয়াবহ ভাইরাস আক্রমণের। ছবি: সংগৃহীত

মানুষ মূলত আতঙ্ক থেকে মুক্তি চায়, নিজের ওপর থেকে দায় সরাতে চায় সব সময়। আর কেউ কেউ এই আতঙ্ককে পুঁজি করে গড়ে তুলতে চায় নিজের আখের। যদি কোনো গুজব ছড়ায় যে লবণ খেলে বিশেষ কোনো মহামারি অসুখ নিমেষেই সেরে যায়, তবে বুঝতে হবে যে এই গুজবের পেছনে নিশ্চয়ই হাত আছে কোনো লবণ ব্যবসায়ীর। নানান কুসংস্কার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট জায়গা থেকেই শুরু হয় এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও গুজবের মহামারি। আর মানুষ পা দেয় ফাঁদে। নিজেকে নিয়ে যায় বোকার কাতারে; কখনো কখনো সেটা গিয়ে পৌঁছায় অপরাধের পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তও হয় মানুষই। আলবেয়ার কাম্যু যেমন বলেছিলেন, ‘মহামারির জীবাণুরা মরে না, লুকিয়ে থাকে কেবল আমাদের চোখের আড়ালে, ওত পেতে থাকে সুযোগ পেলে আবার ফিরে ফিরে হানা দেওয়ার জন্য’, এই গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়াও তেমনি নিশ্চিহ্ন হয় না, লুকিয়ে থাকে কেবল আমাদের মনের আড়ালে, ওত পেতে থাকে সুযোগ পেলে আবার ফিরে ফিরে হানা দেওয়ার জন্য।

সূত্র:
১. ‘মহামারির ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন’: ড. মো. জহুরুল ইসলাম (দ্য ডেইলি স্টার)

২. ‘মহামারি মহাকাল’: শাহাদুজ্জামান; ‘করোনাভাইরাস: সংক্রমণের পাশাপাশি গুজব থেকে সতর্ক থাকুন’: ফজলুল কবির; ‘দুনিয়া কাঁপানো কোভিড-১৯: প্যানডেমিক!’: স্লাভোয় জিজেক, অনুবাদ: বিধান রিবেরু (প্রথম আলো)

৩. ‘প্লেগ থেকে করোনা: রোগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’; ‘মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মকে কেন্দ্র করে করোনার গুজব; গুজব এবং ভুল খবর থেকে সাবধান’ (ডয়চে ভেলে ডট কম)

৪. ‘করোনা ভাইরাস: কোভিডের টিকা ও বিল গেটসকে নিয়ে এত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নেপথ্যে কী?’ (বিবিসি নিউজ বাংলা)

৫. ‘ইতিহাসের আলোচিত কয়েকটি গুজব’: পরাগ মাঝি (দেশ রূপান্তর)

৬. ‘প্লেগ ও ইউরোপের উইচ-হান্টিং’: মণিদীপা দে (বণিক বার্তা)

৭. ‘ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্যানডেমিক জন্ম দিয়েছিল “কোয়ারেন্টাইন” শব্দটির, সাড়ে ছ’শো বছর আগে’: রূপাঞ্জন গোস্বামী (দ্য ওয়াল ডট ইন)

৮. ‘করোনাভাইরাস ইজ নট ম্যান-মেড, অনলি দ্য রিউমারস আর’: টিভি ভেঙ্কাটেশ্বরণ (দ্য ফেডারেল ডট কম)

৯. ‘দেশকে করোনা-মুক্ত করতে মসজিদে প্রার্থনা চীনা প্রেসিডেন্টের!’ ঘটনা কি তা-ই: সুমন বিশ্বাস (এইসময় ডট কম)

১০. ‘দ্য প্লেগ অ্যাট এথেন্স, ৪৩০-৪২৭ বিসি’: জন হরগ্যান (অ্যানসিয়েন্ট ডট এইউ)

১১. ‘ফ্যাক্ট চেক: ভাইরাল হোয়াটসঅ্যাপ ক্লেইমিং মুসলিম ওউনড রেস্টুরেন্ট স্পাইটিং ইন ফুড টু স্প্রেড নভেল করোনাভাইরাস আর ওল্ড’: অদিতি চট্টোপাধ্যায় (দ্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ান ডট কম)

১২. ‘আমি প্লেগদেবী’: তরুণ গোস্বামী (ফোর্থ পিলার্স ডট কম)

১৩. ‘প্লেগ থেকে করোনা, মহামারির যত ইতিহাস’: ডা. হিমেল ঘোষ (জাগোনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কম)

১৪. ‘করোনাভাইরাস নিয়ে যত গুজব’: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক; ‘করোনার মতো লড়াইটা অদৃশ্য গুজবের বিরুদ্ধেও’: সূচয়ন শামস (রোর মিডিয়া বাংলা)

১৫. ‘মহামারীকালীন সার্বজনীন প্রতিক্রিয়া গুজব-ভুল তথ্য ছড়ানো’ (সময় নিউজ ডট টিভি)


অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]