ক-তে কুজ্ঝটিকা

বাইরে যাব, জামা-প্যান্ট পরে জুতার ফিতা বাঁধব বলে মোড়া টেনে বসেছি, মিলা বলল, কই যাও? বললাম, শ্যামলীতে রতুর ওখানে, দেরি করব না। মিলা বলল, এই বৃষ্টিতে? গাড়িতে যাবা? মনে মনে বললাম, মারব এক থাপ্পড়। ভাবখানা যেন আমাকে প্রায়ই গাড়িতে চলতে ফিরতে দেখে। গাড়ি একটা থাকলে সুবিধা হতো, কিন্তু কোথায় পাব? আর বৃষ্টির কথা যে বলল, কোথায় বৃষ্টি?

জুতার ফিতা বাঁধা সারা, উঠতে যাব, মনে মনে হাসলাম। মিলা আমার তিন-সাড়ে তিন বছরের ছোট বোন। আজ কত বছর হবে...দশ বছরের কম না, ও নেই। কিন্তু ওলটপালট কথা বলা ছাড়েনি, আগেও খুব বলত, কথায় কথায় মিথ্যাও। মা বলতেন, বানিয়ে বানিয়ে বলে। মিথ্যা আর বানিয়ে বলা এক হলো? বানিয়ে বলাটা শুনতে খারাপ লাগে না, কাজটা যাকে বলে ক্রিয়েটিভ, সবাই বানিয়ে বলতে পারে না। মিলা মিথ্যাই বলত, ডাহা মিথ্যা। আমার ওয়াকম্যান নিয়ে বলত নেয়নি, মেট্রিকের সময় ছোট খালার দেওয়া আমার প্রিয় শেফার্স ফাউন্টেন পেন স্কুলে বন্ধুদের ঠাট দেখাতে নিয়ে হারিয়ে এসে বলেছে, নেয়নি। এসব মিথ্যায় বানিয়ে বলার বাহাদুরি নেই। এই যেমন বলল, বৃষ্টি।

হঠাৎ হঠাৎ উটকো কথাগুলো যে ও-ই বলে, আমি কল্পনা করি না, এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাল রাতে যেমন বলল, জানালা খোলা কেন, অন্ধকার ঢুকছে না? জানালা লাগাও, বেশি আলো পাবে, কম্পিউটারে কাজ করতে আরাম। উঠে জানালা আটকাতে আলোয় ভরে উঠেছিল ঘর। আমি গলা ছেড়ে তাকে থ্যাংকিউ বলেছিলাম।

কিন্তু এ কী, বৃষ্টি যে! মিলার কথাই ঠিক। বিকেলটা ঝকঝকে দেখেই না জামাকাপড় পরলাম, জুতার ফিতা বাঁধলাম। কী দেখলাম তবে? ঘুমিয়েছিলাম দুপুরে খেয়ে। তারপর চা বানালাম, খুঁজে পেতে অর্ধেকটা টোস্ট–বিস্কুট পেয়ে চায়ে চুবিয়ে খেলাম। বাইরে গেলে ওয়েল ফুডের এই টোস্টটা আনতে হবে, এত দূর পরিষ্কার মনে আছে। তারপর আড়মোড় ভেঙে ক্যাটস আইয়ের এই সরু লাল স্ট্রাইপ শার্টটা পরলাম, গ্যাবার্ডিনের অফ হোয়াইট প্যান্ট, আর জুতার ফিতা বাঁধব বলে মোড়ায় বসতেই, কই যাও?

বৃষ্টি বলতে ঝিরিঝিরি না, ঝমাঝম যাকে বলে। গলির রাস্তায় প্রায় হাঁটু পানি, অন্তত কয়েক ঘণ্টা আকাশভাঙা বৃষ্টির ফল। দুর, মিলা না, ঘুম থেকে উঠে কী না কী ভেবেছি! রতুকে বরং ফোন করে বলি ওর ওখানে যাব ভাবছিলাম, বৃষ্টিতে বেরোতে পারছি না। ব্যালকনি থেকে নিচে তাকাতে চোখ পড়ল ধুমবৃষ্টিতে একজন ভ্যানওয়ালা লেবুবোঝাই ভ্যান নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজছে, আর পা নেড়ে পানিতে কী খুঁজছে। ইচ্ছা হয় ওকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি, ওই মিয়া, কী খোঁজো? ভিজে ভিজে অবশ্য লেবুগুলো তাজা-টাটকা হচ্ছে, তবে ও যে কী আশায় কেবল পা-ই নাড়াচ্ছে আন্দাজ করতে পারি না। কিছু সময় অপেক্ষা করি, দেখা যাক, যা খুঁজছে পায় কি না। অল্প সময়ে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই লোকটা তার পায়ের টায়ারের চটি খুঁজছে না। খুঁজছে মোবাইল, ভ্যান ঠেলার সময় লুঙ্গির কোচড় থেকে পড়ে গেছে, যেখানে খুঁজছে সেখানেই পড়েছে। পানিতে চুপচুপে হওয়ার পর ওটা কোনো কাজে লাগবে? আশ্চর্য হয়ে তখনই দেখি পা চালানো থামিয়ে কোমর-পিঠ ভেঙে সে কনুই পর্যন্ত পানিতে হাত ডুবিয়ে একটা আচ্ছা সাইজের মাগুর মাছ পাকড়ে তুলছে। এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাতে দেখি অল্প বয়সী ছেলে, বৃষ্টিধোয়া হাসিতে তাকে চেনা চেনা লাগে। মাথা-প্যাঁচানো গামছা খুলে ফেলতে আরও চেনা লাগে। গলির মোড়ে তাকে দেখতাম ফুচকা বেচতে। মাছটাকে গামছার ঝুলে ছেড়ে সে গিঁট দেয়। চেয়ে চেয়ে ভাবি, এই ভ্যানে করেই কি ও ফুচকা বেচত? স্কুল, কোচিং সব বন্ধ বলে আজকাল কেউ ফুচকা খায় না, তাই লেবুর কারবার?

রতুকে ফোন করার কথা মনে হতে ঘরে ফিরি। একসময় ছিল রতু ফোন ধরতে সময় নিত, আট-দশটা রিং না হলে ধরার প্রয়োজন মনে করত না। ইদানীং একটা-দুটো রিং হতেই সে তার মিহি মেয়েলি গলায় ‘কী রে, কী অবস্থা’ বলবে। আজ একটা রিংও পুরো হলো না, রতু বলল, কই, তোর না আসার কথা?

রাগ হলো কথায়, ও যেন এ দুনিয়ায় থাকে না, বৃষ্টি হচ্ছে দেখছে না! আমি বলি, বৃষ্টি। আরও বলি, বৃষ্টি হচ্ছে, অথচ আমি টের পাইনি, জামাকাপড় পরে বেরোব, মিলা বলল বৃষ্টি। বাইরে চেয়ে দেখি, তাই তো, অথচ বৃষ্টি ছিল না, মানে আমি দেখিনি, তবে ছিল, গলিতে হাঁটু পানি, অন্তত চার-পাঁচ ঘণ্টার টানা বৃষ্টি।

বৃষ্টি ছিল কি ছিল না সেদিকে না গিয়ে রতু বলল, মিলা কেমন আছে?

থতমত খেয়ে বলি, মিলা...

বললি না তোকে বলেছে, বৃষ্টি। কেমন আছে?

ঠাট্টা কেন করিস। মিলা কবে আমাদের ছেড়ে গেছে!

হাসির আওয়াজ পাই ওপার থেকে। ফ্যাসফেসে আওয়াজহীন হাসি, কান পাতলে কেবল শোনা যায়। বলি, তুই তো সব জানিস, তারপরও কেন জানতে চাইলি, মিলা কেমন আছে। ভালো থাকতে পারে ও?

কেন পারবে না? তুই আছিস না ভালো? আমি আছি না?

তোর জন্য আমার কষ্ট হয়, মুখে তো বলেনি কোনো দিন, তবে জানতাম মিলা তোকে খুব ভালোবাসত।

ওপার থেকে ফোনে সাড়াশব্দ নেই। আজকাল রতু এই বদমায়েশিটা করে, বলা নাই কওয়া নাই, ফোন ছেড়ে চলে যায়।

শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় বদলে বাইরে তাকাই। বৃষ্টি ধরে এসেছে, সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টেবিলে একটা সবুজ মলাটের ডায়েরি। ওটা টেবিলে এল কী করে বুঝি না। হাসপাতালে থাকতে রতু একদিন বলেছিল, কিছু কাগজ এনে দিতে, কলমও। সময় কাটাতে কিছু লিখবে। ডায়েরিটা ওকে দিয়ে বলেছিলাম, যখন যা ইচ্ছা হয় যেন লেখে, মন থেকে চাপ কমবে। রতু মারা যাওয়ার পর কাউকে কিছু না বলে ওটা নিয়ে এসেছিলাম। ভেতরে কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে মিলা মিলা।

কাল রাতে মিলা বলেছিল জানালা লাগাতে। আলো জ্বলা ঘরে জানালা খোলা থাকলে অন্ধকার ঢুকে আলোর রোশনাই খেয়ে ফেলে। কিন্তু জানালা আটকে দিলে...জানালা যদি কাচেরও হয়...হাজার চেষ্টায়ও অন্ধকার ঢুকতে পারে না। কাল রাতে তো পরীক্ষা করে ওর কথার মিল পেয়েছিলাম। আবার করব, পরীক্ষা?

জনালাটা বন্ধ ছিল। দুই পাট চওড়া স্লাইডিং জানালা। ঘরের আলোটা খেয়াল করলাম, হ্যাঁ, দশ-বাই-দশ ফিট ঘরটা আলোয় ভরপুর। এবার একটা জানালা টেনে সরাতেই মনে হলো একটা ভারী পর্দা বুঝি নেমে এল। টেবিলের ওপরে রতুর ডায়েরিতে প্রথমেই চোখ গেল, সবুজ ডায়েরিটা কালচে দেখাচ্ছে, ঘরের কোণগুলো ছায়া-মোড়া, আর চোখের সামনে যা না দেখে পারলাম না...কুণ্ডলি পাকিয়ে নিকষ কালো কালো এগুলো কী, রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে ঢুকছে। পরপরই জানালাটা ঠেলে লাগিয়ে দিতে চার দেয়াল আলোয় আলোকময়।

নানা কথার ফাঁকে মিলা আমাকে নিয়ে খেলেও। দিন কয়েক আগে জিজ্ঞাসা করল, বলো তো ক-তে কী হয়? জবাব দিচ্ছি না দেখে পীড়াপীড়ি জুড়ে দিতে বললাম, ক-তে আর কী হবে, কলা হয়। বলল, আগে হতো, এখন না।

এখন কী?

কুজ্ঝটিকা।

একটা ভুল আজকাল খুব করি। বুঝি না, কেন ভাবি মিলা দশ বছর আগে মারা গেছে। গত এক মাসের ব্যবধানে, প্রথমে রতু, তার পর মিলা। একটা কাজের কাজ অবশ্য করেছিলাম, রতুকে যে কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই পাশাপাশি কবরে মিলাকে আমিই নামিয়েছিলাম।

ভুল আরও আছে। দিন-রাতের হিসাব-নিকাশে ওলটপালট করি। এখন এই ভরদুপুরে আলো জ্বলা ঘর কোথায় পেলাম আর অন্ধকারই-বা কোথায়...হুমড়ি খাওয়া নিকষ অন্ধকার!