বাংলার বিশ্ব-চিত্রশিল্পী

এস এম সুলতানের আত্মপ্রতিকৃতি। এটি এঁকে ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি
এস এম সুলতানের আত্মপ্রতিকৃতি। এটি এঁকে ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি

চিত্রশিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে যত লেখা, সমীক্ষা, আলোচনা দেশ-বিদেশে হয়েছে এবং যে ধরনের সপ্রশংস মূল্যায়ন তিনি পেয়েছেন, মনে হয় না এ উপমহাদেশে অন্য কোনো চিত্রশিল্পীর বেলায় তা হয়েছে। সুলতানের সৃষ্টির বলিষ্ঠ আহ্বান দেশ ও কালের ব্যবধান অনায়াসেই ছাড়িয়ে গিয়ে একটি সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে।

চিত্রশিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে যত লেখা, সমীক্ষা, আলোচনা দেশে-বিদেশে হয়েছে এবং যে ধরনের সপ্রশংস মূল্যায়ন তিনি পেয়েছেন, মনে হয় না এ উপমহাদেশে অন্য কোনো চিত্রশিল্পীর বেলায় তা হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে উপন্যাস রচিত হয়েছে, স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হয়েছে, বই বেরিয়েছে, তিনি হয়ে উঠেছেন এক কিংবদন্তি। সুলতানের সৃষ্টির বলিষ্ঠ আহ্বান দেশ ও কালের ব্যবধান অনায়াসেই ছাড়িয়ে গিয়ে একটি সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে।

জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক সুলতান সম্পর্কে বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমমতাই সুলতানের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুলতান বাংলা ও বাঙালি বিষয়বস্তু নিয়ে যেসব ছবি এঁকেছেন, সেগুলো দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে সব মানুষের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে।’

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী একটি নিবন্ধে সুলতানের আঁকা ছবির অভাবনীয় বৈচিত্র্যের উল্লেখ করতে গিয়ে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটের এককালীন পরিচালক পিটার জেভিটসের উদ্ধৃতি দেন, ‘এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক অসামান্য শিল্পীর মধ্যে সবচাইতে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর।’ বস্তুত তাঁর সৃষ্টিতে আমরা দেখি উপনিবেশ-উত্তর এশিয়ার, না, সারা পৃথিবীর প্রত্যয়ী ও সংগ্রামী মানুষ। এমনকি আমরা দেখি বৈচিত্র্যময় নিসর্গের অনুভূতির বিস্ফোরণ।

বহু বছর আগে করাচির ‘ডন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিভিউয়ে আমি লিখেছিলাম, ‘In Sultan’s paintings feelings speak up loud and clear. They explode.’

প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই সুলতান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে Albert Aurrier-এর ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ-এর বর্ণনার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, ‘This robust and true artist, with the brutal hands of a giant,with the nerves of a hysterical woman, with the soul of a mystic, so orignal and so alone.’

অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর ‘দেশজ আধুনিকতা, সুলতানের কাজ (শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত) বইটিতে লিখেছেন, ‘সুলতান তাহলে কী?একজন লুকানো পিকাসো?একজন গোপন ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ? সুলতান দুই-ই। খুব সম্ভব, আরও।’ আমার কাছে মনে হয়, এই ‘আরও’ হচ্ছে চিত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সুলতানের গভীর এবং নিবিড় মমত্ববোধ, একাত্মতা, যা তাঁর সৃষ্টিকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছে। তদুপরি, তাঁর ছবিগুলোয় প্রায়ই একটি বাণী রয়েছে, যার জন্য পিটার জেভিটস তাঁকে ‘এশিয়ার কণ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছেন। ছবিতে সংগ্রামী, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের মর্মবেদনা নিয়েছে এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী আশাবাদী রূপ।

প্রাজ্ঞ আহমদ ছফা, যিনি সুলতানের গভীরে গিয়ে তাঁর অনুভূত উপলব্ধির অতুলনীয় অভিব্যক্তি দিয়েছেন, বলেন, ‘সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশিশক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে।’ কাশ্মীরের অপরূপ নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের পটভূমের মুষ্টিবদ্ধ বলিষ্ঠ হাত যেন রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে উন্মুখ।

আহমদ ছফা বলেন, ‘এইখানেই সুলতানের অনন্যতা। এইখানেই বাংলার কোনো শিল্পীর সঙ্গে, ভারতবর্ষের কোনো শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল আবেদিন, আবদুর রহমান চুঘতাই, নাগী, ওই সব দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সবার মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পাদর্শের যে ব্যাপক সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি, একজন সুলতান ছাড়া।’ আহমদ ছফা আরও বলেন, ‘ম্যাক্সিম গোর্কির সেই বাক্যটা কী দর্পিত, কী ব্যঞ্জনাময় এই ‘মানুষ’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই নিসর্গের অন্তরে কী ব্যাকুল সাড়া ও কানাকানি পড়ে যায়। সুলতানের আঁকা ছবির মানুষ দেখলে দর্শকের মনে হবে ম্যাক্সিম গোর্কির মানুষ সম্পর্কিত মন্তব্য কত সার্থক ও যথার্থ হয়েছে।’ ঢাকার ইতালির সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, যিনি নিজেও একজন আর্ট-ক্রিটিক, একাধিকবার আমাদের বাড়িতে এসে সুলতানের কয়েকটি আঁকা ছবি দেখে সুলতানের এই সর্বজনীন আবেদনময় অপরূপ প্রকাশের বিশেষ উল্লেখ করেছেন। আহমদ ছফার মতো তিনিও ‘শেখ সুলতানের মধ্যে দা ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকাণ্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠতার ছাপ’ লক্ষ করেন। রাষ্ট্রদূত ও আর্ট-ক্রিটিক মারিও পালমা তাঁর ইতালিয়ান ভাষায় রচিত L‟arte che non dorme এবং ইংরেজি Tales of an Art-lover বই দুটিতে সুলতানের বিস্তৃত প্রশস্তি করেছেন। আর্টের জগতে তাঁর বিশ্ব পরিক্রমার ফলস্বরূপ ইংরেজি ১৭৮ পৃষ্ঠার বইটির ১৭ পৃষ্ঠাজুড়েই সুলতানের বর্ণনা ও প্রশংসা। তিনি ইতালিয়ান রেনেসাঁ পিরিয়ডের মহান আর্টিস্টদের সঙ্গে, বিশেষ করে, মিকেলেঞ্জেলোর সঙ্গে সুলতানের প্রচুর সাদৃশ্য খুঁজে পান, কিন্তু তাই বলে তাঁকে অনুকরণকারী কেউ বলতে পারে না।

সুলতানের সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল এবং ভিন্নতর উপলব্ধি ছিল। মারিও পালমা বরং প্রথম জীবনে সুলতানের পেশোয়ার-উদ্ভূত ‘খাকসার’ (বিভাগ-পূর্ব ভারতের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য গঠিত আল্লামা মাশরেকির একটি অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলন)-এর আদর্শ এবং তাঁর সঙ্গে সুলতানের সংশ্লিষ্টতাকে তাঁর বলিষ্ঠ মানবপ্রেমের উৎস বলে মনে করেন।

কুমিল্লা গ্রামোন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনের উদ্যোক্তা এবং বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় আখতার হামিদ খান, যিনি আইসিএস থেকে পদত্যাগ করে বাংলার দরিদ্র জনগণের আত্মনির্ভরশীল ভাগ্যোন্নয়নের প্রচেষ্টায় আত্মনিবেদন করেন, তিনি ছিলেন আল্লামা মাশরেকির জামাতা এবং সুলতানের অতীব শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর প্রভাব সুলতানের চিন্তাধারায় ছিল। সুলতানের কোনো রাজনৈতিক দল বা আদর্শের প্রতি আনুগত্য ছিল না। তরুণ জীবনে তিনি অনেক প্রখ্যাত বামপন্থী কবি, লেখক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীর সান্নিধ্য ও সখ্য লাভ করেন। তবে তা মূলত তাঁদের মানববাদী উদার চিন্তাধারার জন্য। কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বা কোনো বিভাজক নীতির অনেক ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর বিচরণ। মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেই তিনি করেছেন মানবমূর্তির অবলোকন এবং সেটাই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর চিত্রায়ণে। আপন অভিনবত্বে।

মারিও পালমার মতে, The figures of Sultan are truly fascinating and unique in the contemporary art scen। বিশ্বের আর্টজগতের পটভূমেই তাঁর এই উক্তি। শুধু বাংলার জেলে-কৃষক বা কাশ্মীরের তরুণী বা সংগ্রামী সাধারণ মানুষেই সুলতানের ‘ফোকাস’ সীমিত ছিল না, যেখানে তিনি অত্যাচারিত, বঞ্চিত, জীবনপ্রত্যাশী মানুষ দেখেছেন, তাদেরই তিনি তার রংতুলিতে নিয়ে এসেছেন। মারিও পালমার ভাষায়, And yet it was the unattractive features of the malnourished, hungry Mohajir (immigrants from pre-partioned India, 1947) that he would choose to portray in large canvases rather than those of the well-groomed rich people around him.

সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কোনো রাজনৈতিক মানচিত্রে সীমিত ছিল না। সে অর্থে, তিনি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক ছিলেন। মারিও পালমা আরও বলেন, In my humble opinion SM Sultan is the greast interpreter of the soil and sprit of Bangladesh। এস এম সুলতান স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শিল্পবোদ্ধা সুবীর চৌধুরীর ভাষায়, ‘সুলতানের চিত্রকলা একটি নতুন প্রকাশভঙ্গি দিয়েছে বাংলাদেশের চিত্রকলার জগতে এবং একই সঙ্গে একটি নতুন শিল্পচিন্তা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজ ও রাজনীতি এবং বাস্তবের ও ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ। এই অর্জন সুলতানকে অমর করেছে এবং এ জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।’ তাঁদের এই মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে মারিও পালমার উক্তিকে বিশদ করে বলতে চাই, যে কারণে তিনি সুলতানকে বাংলার মাটি ও আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার বা ভাষ্যকার বলেছেন, তাঁর সেই সূত্র ধরেই বলব, এই মাটি ও আত্মা শুধু বাংলার মানুষের নয়, শুধু এশিয়ারও নয় (পিটার জেভিটস-এশিয়ার কণ্ঠ) পৃথিবীর মাটিতে অধিকার ও জীবিকার অর্জনে সংগ্রামী সব প্রত্যয়দীপ্ত হার না-মানা মানুষের। আর্টের জগতে আত্মবিকাশের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বকীয়ত্ব নিয়েই সুলতান এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

সেই ১৯৫২ সালে (সুলতানের বয়স যখন মাত্র ২৯) উপমহাদেশের একজন খ্যাতনামা আর্ট-ক্রিটিক এস আমজাদ আলি (পাকিস্তান কোয়ার্টিলি জানুয়ারি ১৯৫২) সুলতানের চিত্রকর্মের ওপর বিস্তৃত এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘একজন দর্শককে যা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে তাঁর স্টাইলের বিস্ময়কর বৈচিত্র্য। প্রথমত জলরঙে করা বাংলার নিসর্গ দৃশ্যের নরম, অনুচ্চারিত বর্ণবিন্যাস, যেখানে আকাশ ও পানির অবাধ বিস্তার, অদৃশ্য হতে থাকা দিগন্ত, নারকেলগাছ এবং নৌকা, জেলে এবং ছবির মতো কুটির—এক শান্তশ্রী গ্রামীণ পরিবেশকে ফুটিয়ে তোলে। এরপর আছে কাশ্মীরের নিসর্গ চিত্রায়ণ, যার অধিকাংশ তেল রং করা, এবং সবই খুব রঙিন বলা যায় উচ্চকিত বর্ণিল।...এসব কাজে তিনি প্রদর্শন করেন এক অসামান্য উদ্দীপনা। কারণ, এই বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার শুধু দক্ষতা ও শিল্প কুশলতা এবং একের পর এক ওয়াশ চরানোর সাবলীলতা থাকলেই চলবে না, তার সঙ্গে থাকা চাই ব্যঞ্জনাধর্মী নানা কুশলী স্পর্শে ছবিকে সঞ্জীবিত করার সামর্থ্য, যা জীবন ও গতিময়তার সব কম্পমান তীব্রতা নিয়ে বাস্তবতাকে পুনর্নির্মাণ করতে মনকে সাহায্য করবে।’ আমজাদ আলি সুলতানের আঁকা আখরোট গাছের নিচে কাশ্মীরি মেয়েদের একটি চমৎকার ছবির বর্ণনা করে বলেছেন, ‘গাছটির পল্লব কিছুটা রীতিবদ্ধ...কিন্তু গুঁড়িটি তার ঘন বলিষ্ঠতার জন্য একধরনের স্থাপত্যধর্মিতা লাভ করেছে।...’ ‘এসব ছবিতে’ আমজাদ আলি বলেন, ‘রঙের নানা মাত্রা সংবেদনশীলতার সঙ্গে পাশাপাশি বিন্যস্ত হয়েছে, যাতে একটি সজীবতার আবহ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন রং চড়িয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য কাঠামো, এবং একই সঙ্গে ত্রুটিহীন একটি সাংগীতিক সুষমাও তৈরি করেছেন শিল্পী। সেজান যেমন বলেন, ‘রং যখন তার সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, কর্মও তখন তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে।’

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর নিবন্ধে সৈয়দ আমজাদ আলির ওই যুগের ছবিগুলোর মূল্যায়নের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘তবে সুলতান শুধু ল্যান্ডস্কেপ চিত্রকরই নন। সম্প্রতি তিনি দুটি বিরাট প্যানেলে উদ্বাস্তু ও দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর ছবি এঁকেছেন। মানবমূর্তির রেখায়নে কঠিন নির্বাচন, বিরাটত্ব ও দৃপ্ত ভাবারোপ এবং সর্বোপরি মানবিক মমত্ববোধ ও ট্র্যাজেডির আভাস তাঁর বিকাশমান দক্ষÿহাতের জাগতিক স্বাক্ষর বহন করছে।

‘সুলতান শুধু চারুশিল্পীই ছিলেন না, পৃথিবীর মানুষের জীবনের সব সুন্দর বৃত্তি ও আত্মবিশ্বাসের প্রকাশকে তিনি আত্মস্থ করেন। তিনি মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসে ছিলেন। উৎকর্ষ অর্জনের প্রবৃত্তি ছিল তাঁর এক জন্মগত গুণ। আশ্চর্য ছিল তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। তিনি একজন চমৎকার বংশীবাদক ছিলেন, দর্শন সাহিত্য ও সংগীতে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে তিনি অত্যন্ত পরিশীলিত কথোপকথন করতেন। এমনকি চমৎকার ভাষণও দিতে পারতেন।’

ইংরেজি ও উর্দু তিনি রপ্ত করেন অধ্যাপক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সান্নিধ্যে। সাহিত্যে ও দর্শনে তাঁর সৃষ্টিধর্মী অনুরক্তির সূতিকাগার ছিল তাই। কবিতা হয়ে দাঁড়াত তাঁর উদ্দীপনার উৎস।

প্রথিতযশা শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদ, যিনি সুলতানকে খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছেন, তাঁর ‘আমার স্মৃতিতে সুলতান’ নিবন্ধে বর্ণনা করেছেন—কবিতা-আবৃত্তি ও দর্শন আলোচনা সুলতানের সৃষ্টিধর্মী চিন্তাপ্রবাহে কি গভীর রেখাপাত করত। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন আমার রবীন্দ্রনাথের “পৃথিবী” কবিতার আবৃত্তি শুনে তিনি (সুলতান) চটপট এক ছবি এঁকে বসলেন।’ শাহাবুদ্দিন আহমদ আরও লিখেছেন, ‘তিনি (সুলতান) যেমন মধুসূদনের ভক্ত ছিলেন, তেমনি ছিলেন নজরুল ও ইকবালের ভক্ত। ইকবালের “খুদি-দর্শন” তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাবণের “শক্তিমত্তা”, নজরুলের “বিদ্রোহী” আর ইকবালের “খুদি-দর্শন” তাঁর চিত্তে অপরিমেয় মানবশক্তির প্রেরণা জাগাতে সাহায্য করেছিল বলে আমার ধারণা। মানুষের মানসের অন্তস্তলে এই ইচ্ছাশক্তির অবদান আছে বলে মানুষ পৃথিবীর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে আজও বেঁচে আছে।...তাঁর উত্তাল-তরঙ্গায়িত পেশির ফুঁসে ওঠার মধ্য দিয়ে মানুষের অভ্যন্তরীণ ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে দেখাতে হবে মানুষ অজেয়।’ সুলতানের আঁকা অনেক ছবির পেছনে এই দর্শন কাজ করেছে। ইকবালের ‘খুদি’ থেকে সুলতান আবৃত্তি করতেন ‘খুদিকো কর বুলন্দ এত্নাকে।’ আত্মশক্তি যেন এত বিকাশিত হয় যে খোদা বান্দার ইচ্ছা অনুযায়ীই তকদির (ভাগ্য) নির্ধারণ করবেন।

সুলতানকে আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি তো সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন। বাংলার কথা তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার সৃষ্টিধর্মী উদ্দীপনায় ‘কাশ্মীর’ এত প্রধান কেন? তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ শুধু পাকিস্তান-ভারত নয়, ইউরোপ-আমেরিকাও ঘুরেছি, ছবি এঁকেছি। প্রদর্শনী হয়েছে। তবে কাশ্মীরকে নিয়ে আমি প্রথম উদ্দীপিত হই কাশ্মীর ভ্রমণের আগেই। সুকান্তের ‘কাশ্মীর’ কবিতা দুটি আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। ‘ছাড়পত্র’ গ্রন্থে প্রকাশিত সুকান্তের ছন্দমুক্ত কাশ্মীর কবিতার আবৃত্তি তিনি নিজেই করলেন:
‘...হঠাৎ জেগে উঠেছে,
সূর্যের ছোঁয়ার চমকে উঠেছে ভূ-স্বর্গ।
...কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হলো। প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে।
গলে গলে পড়ছে বরফ—
ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দন।
দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুল;
আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে।
ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি।
কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়,
সূর্য করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে
হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত।
তাই আজ কালবৈশাখীর পতাকা উড়ছে—
ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়...।’

আবৃত্তি করতে করতে সুলতান আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি তখন শ্রীনগরে। (১৯৪৭ সালের শেষ দিকে বোধ করি) দাঙ্গা শুরু হলে আমি আঁকা অনেক ছবি আর সামান্য যা কিছু পার্থিব অবলম্বন ছিল, পাঞ্জাবের মুসলিম হোটেলে ফেলে রেখে মাত্র দু-তিনটে ছবি হাতে নিয়ে পালিয়ে উদ্বাস্তু এক ট্রাকে উঠে পড়লাম। তারপর সোজা শিয়ালকোট, লাহোর।...কাশ্মীর থেকে তো আমি আসতে চাইনি, বাধ্য হয়েই ছাড়তে হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্মৃতি থেকেই আমি কাশ্মীরের ছবি এঁকেছি।’ বাংলায় প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত বাংলার ছবিও স্মৃতি থেকে আঁকা।

কবি শামসুর রাহমান সুলতানের প্রশস্তি করে একটি নিবন্ধে (‘সুলতান তাঁর সালতানাত ত্যাগ করেননি।)’ বলেছেন, ‘তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে সকলের অবশ্য-পাঠ্য আমাদের অন্যতম কৃতী কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা উপন্যাস “সুলতান”।’ এই গবেষণানির্ভর জীবনীভিত্তিক বইটিতে ‘বিশিষ্ট রূপদক্ষতায়’ (কবি শামসুর রাহমান) হাসনাত আবদুল হাই সুলতানকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

ব্যক্তিগতভাবে ১৯৫৪ সাল থেকে আমৃত্যু ছিল সুলতানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ-ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে। তিনি ছিলেন একজন খুব কাছের মানুষ। দুই প্রজন্মের পরিচয়। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বই লেখাকালীন আলাপচারিতায় সুলতান নিজেকে হাসনাতের কাছে উজাড় করেই দিয়েছিলেন, এবং কুশলী হাতে অতীব দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গেই হাসনাত আবদুল হাই তা পাঠকের কাছে চমৎকার উপস্থাপন করেছেন।

নিজে একজন প্রায়-উদ্বাস্তু হিসেবেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় সুলতান লাহোরে পা রেখেছিলেন। অবশ্য আগে পাঞ্জাবের কামালবাগ আর তালবন্দে ওখানকার বিরাট জমিদার আমির হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন ছয় বছর। পরে আমির সাহেবের শ্বশুর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অম্বের নবাব তালেহ মোহাম্মদ খানের প্রাসাদে থাকেন বহুদিন। তাঁর কাগান ভ্যালির চিত্রগুলো ছিল ওই সময়ের আঁকা।

লাহোরে তিনি খাকছার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মাশরেকির সঙ্গেও দেখা করেন। লাহোরে তাই তার কিছু যোগসূত্র ছিল। আর সৌভাগ্যক্রমে শিয়ালকোটে এসেই তাঁর সঙ্গে আকস্মিকভাবেই দেখা হয়েছিল সৈয়দ আমজাদ আলির। তিনি ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আর্ট-ক্রিটিক এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আমজাদ আলিই সুলতানের স্কেচ এবং সঙ্গে থাকা দু-তিনটে ছবি দেখে বুঝে নিয়েছিলেন সুলতানের প্রতিভার উচ্চতা। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সঙ্গে—আবদুর রহমান চুঘতাই। অনুজ-প্রতিম স্নেহে চুঘতাই করলেন সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা। কাশ্মীর ও বাংলার স্মৃতি থেকে ছবি আঁকলেন অনেক। লাহোর তখন বিভিন্ন দিকে উপমহাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র। এই লাহোরেই কয়েক মাসের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনী হলো। উদ্বোধন করলেন স্যার ফিরোজ খান নূন। পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী। (ব্রিটিশ ভারতের কয়েকটি প্রদেশে, পাকিস্তান যুগের প্রথম দিকে পূর্ববঙ্গেও, প্রধানমন্ত্রী বলা হতো, মুখ্যমন্ত্রী নয়)। তুমুল সফল হয় প্রদর্শনীটি। উদ্বোধনের দিন হঠাৎ করেই দেখা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে, যাঁদের অতি ফলপ্রসূ পারিবারিক আতিথ্য তিনি কলকাতায় পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নূন এবং সোহরাওয়ার্দী দুজনই সুলতানের ছবি কেনেন। প্রায় সব ছবিই বিক্রি হয়ে যায় উদ্বোধনের দিনই। স্যার ফিরোজ খান এবং তাঁর স্ত্রী ভিকারুননিসা নূন শিল্পবোদ্ধা ছিলেন। ঢাকায় যখন পরে ফিরোজ খান নূন গভর্নর হিসেবে এসেছিলেন, তখন তিনি সুলতানের সঙ্গে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ঢাকার বিখ্যাত ভিকারুননিসা নূন স্কুলটি বেগম নূনের নাম ধারণ করছে। তাঁরই উদ্যোগে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং সুলতানের পরামর্শেই ‘পেইন্টিং’ প্রশিক্ষণ ওই স্কুলে শুরু হয়। যাহোক, লাহোর সমাজে সুলতান অনায়াসে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন। বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ গুণীজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। কবি আহমদ দানেশের বাড়িতে আড্ডায় যেতেন সুলতান। যেখানে প্রায় নিয়মিতই আসতেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, কথাশিল্পী সাদাত হাসান মান্টো , হাবিব উদ্দীন বীনকার প্রমুখ। সাধারণভাবে উদার বামপন্থী বলেই এঁদের খ্যাতি ছিল। গানের মাহফিল, কবিতার মোশায়েরা, চারুশিল্প নিয়ে আলোচনা—এসব হতো। সুলতান এসবে সাগ্রহে অংশ নিতেন। লাহোরেই ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার․সৌভাগ্য সুলতানের হয়। ১৯৫৭ সালে ভারতে পাড়ি দেওয়ার আগে বড়ে গোলাম আলি খান লাহোরেই থাকতেন।

করাচি তখন দেশের রাজধানী। এস আমজাদ আলি এবং শিল্পী আবদুর রহমান চুঘতাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯-এর শেষের দিকে একটি বড় ধরনের প্রদর্শনী করার মানসে সুলতান চলে এলেন করাচি। চুঘতাই তখন উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে সুবিখ্যাত। এটা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা যে একজন শিল্পী হয়েও অত্যন্ত দরাজ-দিলে এই মহান শিল্পী তরুণ সুলতানকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন এবং প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন।

করাচিতে সুলতানের প্রদর্শনী একটি বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এর উদ্বোধন করেন মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ। লাহোর থেকে অনেকে আসেন—চুঘতাই, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, আর অবশ্যই এস আমজাদ আলি। করাচির শিল্পী শাকির আলি, শেখ আহমদ একান্ত সহায়তা করেন। বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতিও এলেন। চড়া দামে তাঁর প্রায় সব ছবিই এবারও উদ্বোধনের দিনই বিক্রি হয়ে গেল। এটা ছিল সুলতানের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী। প্রথমটা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে শিমলায়। উদ্বোধন করেন কাপূরতলার মহারাজা, শিমলা আর জলন্ধরে বেশ কিছুকাল যার আতিথ্য সুলতান গ্রহণ করেছিলেন।

করাচিতে সুলতান বেশ কয়েকজনকে ছবি শেখান। প্রশিক্ষণের একটি আকাঙ্ক্ষা তাঁর মধ্যে সব সময়ই প্রবল ছিল। মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে তাঁর ছবি কিনে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে নিখিল পাকিস্তান একটি প্রতিযোগিতায় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে সুলতান যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আয়োজনে এক দীর্ঘ সফরে আমেরিকা যান। পরে বিলেতেও অনেক দিনব্যাপী ভ্রমণ করেন। আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে বিশ্বশান্তির ওপর বক্তৃতা দেন। পছন্দমতো শিক্ষায়তন ও দ্রষ্টব্য স্থানগুলোও দেখেন। আর ছবি আঁকেন। ওই সময়কার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সৈয়দ আমজাদ আলির কথার (১৯৫২ সালের) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় সুলতান কারিগরি কৌশলের দিক থেকে তাঁর সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন দরকার মহৎ আইডিয়া আর জীবনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাবলি, যার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন চিত্রকলার “মাস্টারপিসসমূহ”। ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন আমজাদ আলি। পঞ্চাশের দশকেই সুলতান যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি এবং বিলেতে চারটি প্রদর্শনী করেন। এর মধ্যে একটিতে পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাক ও ক্লির মতো বিশ্বনন্দিত আধুনিক সেরা শিল্পীদের চিত্রকর্মের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় শেখ মুহাম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম।’

এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই সম্ভবত সুলতানকে পুরোপুরি বিশ্বধর্মী করে তোলে। সুলতানের চিত্রকর্মের যেসব রিভিউ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর্ট বিভাগে বেরিয়েছিল, তার কয়েকটি আমি দেখতে পেরেছিলাম। নিউইয়র্ক-লন্ডনের পত্রিকা ছাড়াও পারির ‘ল্যা-মঁদ’ পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছিল। আর্টের জগতে যেন এক নতুন বিস্ময়কর আবিষ্কার। কবীর চৌধুরীর কথায় আমজাদ আলির ভবিষ্যদ্বাণীরই যথার্থ বাস্তবায়ন। এসব রিপোর্ট সম্পর্কে শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর ‘আমার স্মৃতিতে সুলতান’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সুলতানের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকা। “নিউইয়র্ক টাইমস”, “হেরাল্ড ট্রিবিউন”, “ডেইলি টেলিগ্রাফ”প্রভৃতি। সেখানে শেরওয়ানি পরা চুল-দাড়ি ও বাবরি চুলের সুলতানের ছাপানো ছবির সঙ্গে সুলতানের আঁকা পেইন্টিংয়ের ওপর রিপোর্ট দেখলাম। বুঝলাম সুলতান পাগল নয়, প্রতিভা।” কিন্তু ওই সব নিয়ে প্রায় পাগলের মতোই আচরণ করেছেন সুলতান। এই মহামূল্যবান “রিভিউ”গুলোর কিংবা ওগুলোর কোনো কপিই রাখেননি। আমি যত্নে রাখার জন্য বিশেষ অনুরোধও করেছিলাম।’ তিনি বলতেন, ‘ওইগুলো রেখে আর কী হবে?’ দুঃখের বিষয় সবই নষ্ট হয়ে গেছে। অবহেলায়, অযত্নে হারিয়ে গেছে।

এককথায় বলতে পারি, এই রিভিউগুলো থাকলে বাংলার আর্টজগতের এক মহাসম্পদ হতো। বিদেশের বোদ্ধা-মহলে আর্ট-ক্রিটিকদের কাছ থেকে এ ধরনের স্তুতি এশিয়ার কোনো শিল্পী পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

শিল্পী সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে। সুলতানের বয়স যখন ত্রিশ-একত্রিশ, বাবা (গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী) তখন যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর। তখন আমি ছাত্র। ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে দেখি বাবা একজন স্থানীয় শিল্পীকে নিয়ে খুব উৎসাহ বোধ করছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এক তরুণ প্রতিভা। বিশ্বজুড়ে ওর নাম। কিন্তু দেশে প্রায় অপরিচিত। খুবই ভালো ছবি আঁকে।’ তাঁর অনেক ছবি দেখলাম। একটি ছবির কথা মনে পড়ে, সুন্দর বনের গহিনারণ্যে ক্রীড়ারত হরিণ যুগল। সুলতানের তখনকার ছবিগুলো ছিল কিছুটা ভিন্নধর্মী।

বাবা নড়াইলে সুলতানের বাড়িতে একটি ছবি আঁকা শেখার স্কুল প্রতিষ্ঠাকল্পে সহায়তা এবং সেখানে গিয়ে সেটির উদ্বোধন করেন। এক অর্থে সুলতানকে বাংলাতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রথম উদ্যোগ নেন। এম এম কলেজেও একটি পরিচিতি-আলোচনা সভার আয়োজন করেন। হাসনাত আবদুল হাইয়ের বইটিতে বাবার (এবং পরবর্তী সময়ে আমার) সঙ্গে সুলতানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিশদ বিবরণ আছে। বইটিতে উল্লেখ আছে, বাবার সম্পর্কে কথোপকথনে সুলতান বলেন, ‘মহাপুরুষের মতো মানুষ, খুব বিবেচক, খুব ভালো মানুষ ছিলেন। পুরোনো মুরব্বিরা জানতেন কখন কার সঙ্গে কী করতে হয়। জাতপাত, ধনী-গরিবের পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না বলতে বলতে তিনি উদাস হয়ে যান।’ বাবা বদলি হয়ে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি আর ‘নন্দনকানন’ হিসেবে স্থায়ী হয়ে যেতে পারেনি। তবে তাঁর জীবদ্দশায় বাবা সব সময়ই সুলতানের সঙ্গে তাঁর সস্নেহ সম্পর্ক রেখে চলেছেন।
১৯৬৭ সালে আমি যশোরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যাই এবং অবিলম্বে সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করি। তখন নড়াইলে সুলতানের নেতৃত্বাধীন ‘ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ প্রতিষ্ঠা করি এবং ১৯৬৮ সালে ওটা উদ্বোধন করি। সুলতানের উৎসাহে তখন শিশুদের শিল্পশিক্ষার একটি বিশেষ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এসব ঘটনার কিছু কিছু বিবরণ হাসনাত আবদুল হাইয়ের বইতে এবং ‘এস এম সুলতান স্মারকগ্রন্থ’তে প্রকাশিত কাজী মতিউর রহমানের নিবন্ধে রয়েছে।
যশোর থেকে আমি খুলনায় (বৃহত্তর) ডেপুটি কমিশনার হিসেবে যাই।
সেখানে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে খুলনা ক্লাবে সুলতানের একটি একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করি, ৩৪টি ছবি নিয়ে। এটাই ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) সুলতানের সর্বপ্রথম চিত্র প্রদর্শনী। অনেকেই ভুল করে ১৯৭৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সুলতানের চিত্র প্রদর্শনীকে ‘প্রথম’ বলে উল্লেখ করেন। আসলে খুলনা তখন ছিল পুরোপুরি মফস্বল, তদুপরি তখন মিডিয়ার অত বিস্তৃতিও ছিল না। তাই এই প্রদর্শনীর কথা ভালোভাবে হয়তো প্রচারিত হয়নি। তবে সেই প্রদর্শনীতে সুলতানের ছবি খুব ভালোভাবেই বিক্রি হয়, সম্ভবত প্রদর্শিত প্রতিটিই।
তখন ঘটনাক্রমে প্রিন্স করিম আগা খান তাঁর নববিবাহিত বধূ প্রিন্সেস সেরিনাকে (খুব সম্ভবত এই নামই ছিল) নিয়ে খুলনা আসেন। শুনেছিলাম তাঁদের আর্টে খুব উৎসাহ। একটি প্রোগ্রাম ছিল, তাঁরা ডিসির বাংলোতে বৈকালিক চা খাবেন এবং পরে সংলগ্ন নদীতে স্বল্পকালীন নৌবিহার করবেন। খুলনা ক্লাবে তখনই সুলতানের চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। নিরাপত্তার কারণে তাঁদের পেইন্টিংগুলো দেখাতে ক্লাবে না নিয়ে সন্নিকটবর্তী আমার বাংলোতেই ছবিগুলো নিয়ে এলাম। চা-চক্রে এসে প্রিন্স ও প্রিন্সেস গভীর আগ্রহ নিয়ে ছবিগুলো দেখলেন। একসময় প্রিন্সের সেক্রেটারি আমার কাছে এসে বললেন, ‘আর্টিস্ট মেহেরবানি করলে প্রিন্সেস দুটো ছবি নিতে চান, দাম কাকে জিজ্ঞেস করব এবং কীভাবে দেব?’ আমি বললাম, আর্টিস্ট তো এখানেই আছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করে তাঁর নামেই চেক দিয়ে দিতে পারেন। তখন কিন্তু পেইন্টিংয়ের দাম খুব বেশি ধরা হতো না। এখনকার হিসাবে ৫০০, ৭০০, বড়জোর হাজার। প্রদর্শনীতে কোনো ছবিতেই দাম চিহ্নিত ছিল না। আমি সুলতানকে আড়ালে নিয়ে বললাম, দাম শুধোলে একটু বাড়িয়েই বলবেন। দুটো বড় ক্যানভাসের ছবিই তাঁরা নিলেন। প্রস্তাবিত নৌবিহার বাদ দিয়েই তাঁরা ছবি দেখলেন। লনে বসে চা-চক্রে সুলতানের সঙ্গে প্রিন্সেস অনেক আলোচনা করলেন। তাঁদের বিদায় দেওয়ার পরে সুলতানকে ঔৎসুক্যবশতই জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকার চেক দিয়েছেন? তিনি ঝুলি ও পকেট হাতড়ে দুটো চেক বের করলেন। বললেন, ঠিক খেয়াল করিনি। নিয়ে দেখি পাঁচ লাখÿটাকার দুটো চেক। মোট দশ লাখ। আমরা হতবাক। সুলতান বললেন, ‘সেক্রেটারি দাম জিজ্ঞেস করলে। আমি ভেবেছিলাম পাঁচ হাজার বলব। কিন্তু “পাঁচ” বলেই আটকে গেলাম। সেক্রেটারি তখনই বলল “আই সি। থ্যাকংস।” তারপর এসে দুটো চেক দিলেন। আমি পকেটে রেখে দিলাম। তারপর তো এই দেখি।’ সুলতান আরও ছবির মূল্য বাবদ আরও টাকা পেয়েছিলেন এই প্রদর্শনীতে। সুলতানের অযথা ব্যয় করার অভ্যাস আছে জেনে আমি নড়াইলের এসডিও শেখ শওকত আলীর সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু কিছুদিন পরেই শওকতের আকুল আবেদনে ওই ব্যবস্থার অবসান করতে হলো। শেখ শওকত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। খুব চুপচাপ নিরুপদ্রব ভদ্রলোক। সে বলল, ‘স্যার আর পারা গেল না। আর্টিস্ট সাহেব দিন নেই রাত নেই—হাজার হাজার টাকার চেক লিখে স্বাক্ষরের জন্য পাঠান বা নিয়ে আসেন। রাত দুপুরেও পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ হাজার, ঠিক নেই। সবই সাহায্য করার জন্য।’ যাহোক এসডিওকে নিষ্কৃতি দিলে পুরোপুরি সুলতানের আওতায়ই পরে চেকের অপারেশন চলে গেল। আর কিছুকালের মধ্যেই ‘হাতেম তাই’ এস এম সুলতান সব সঞ্চয় সম্ভবত নিঃশেষ করে দেন। সব খরচই অবশ্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, রোগীর চিকিৎসা, দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষা—এসবের জন্যই ছিল। নিজের জন্য কিছুই না। কাজী মতিয়ুরের নিবন্ধে সুলতানের এসব খরচাদি এবং প্রদর্শনীর উল্লেখ আছে।
১৯৭৩ সালে আমি যখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, তখন খবর পেলাম প্যারিস থেকে আগা খান এন্টারপ্রাইজের একটি দুই সদস্যের ডেলিগেশন আসবে। আমরা ভাবলাম, সম্ভবত তখন আগা খানের বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ছিল, ওগুলো নিয়েই আলোচনা করতে আসছেন তাঁরা। কিন্তু আসলে তা নয়। তাঁরা অবশ্য সরকারকে ও শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে শুভেচ্ছা জানালেন। কিন্তু তাঁরা আসল উদ্দেশ্য জানালেন আমার সঙ্গে দেখা করে। প্রিন্স করিম আগা খান এবং প্রিন্সেসের খুলনায় কেনা দুটো সুলতানের ছবি উদ্ধার করতে তাঁরা এসেছেন। ছবি দুটো খুলনা-যশোর সীমান্তে আগা খানদের নওয়াপাড়া জুট মিলে রক্ষিত ছিল। আমি অবিলম্বে খুলনা-যশোরের ডিসিদের ফোন করে ছবি দুটির সন্ধান বের করতে বললাম। তাঁরা অনেক খোঁজ করে জানালেন, ছবিগুলো নেই। খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবি দুটি লুট বা অপহৃত হয়ে গেছে। ডেলিগেশনের লোক দুজন ব্যক্তিগতভাবে যশোর-খুলনা গিয়েও খোঁজ করলেন। কিন্তু আর পেলেনই না। ঘটনাটির আমি উল্লেখ করলাম এটাই বোঝাতে যে প্রিন্স ও প্রিন্সেস সুলতানের ছবিকে কী মহাগুরুত্ব দিতেন।
ডেলিগেশন মোটেই কোনো মিলকারখানা পুনরুদ্ধার করতে আসেননি। আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল।
১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি জাতীয় প্রদর্শনীতে সুলতান অংশগ্রহণ করেন। অব্যবহিত পরেই ইরানি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কাউন্সিলর জনাব সুলতানির উদ্যোগে ১৯৭৬ সালে একটি একক চিত্র প্রদর্শনী করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
জনাব সুলতানির বাড়িতে থেকেও সুলতান বেশ কটি ছবি আঁকেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের শিল্পকলা একাডেমি ওটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, সেপ্টেম্বর মাসে। ঢাকায় ওটাই সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী। ১৯৮৭ সালে গ্যেটে ইনস্টিটিউট ও জার্মান দূতাবাসের উদ্যোগে আরেকটি অত্যন্ত সফল একক প্রদর্শনী হয়, যা সুলতানকে বাংলাদেশে সুপরিচিত করে তোলে।
একটা বিষয় আমি সব সময় লক্ষ করেছি, সুলতানের ছবির আবেদন বিদেশিদের কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে আমরা বর্ণনা করেছি, সুলতানের সৃষ্ট ফিগারে-বাঙালি কৃষক হোক বা জেলে হোক বা গ্রামীণ মহিলা হোক—সবার মধ্যেই বাঙালিত্ব ছাড়িয়ে একটি সর্বজনীন আবেদনমুখর আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সুলতান যে মানবদেহ আঁকতেন, তা কিন্তু তার গভীর ‘স্টাডি’রই ফলাফল। ব্যাখ্যার সূত্রে সুলতান বলেছেন, তিনি যখন ভারত ভ্রমণে আগ্রায় ছিলেন, তখন ক্যান্টনমেন্টের অনেক গোরা সৈন্যের মুখাবয়ব বা মূর্তি তিনি কম সময়ই আঁকতেন ও বিক্রি করতেন। অবিকল না হলে ওরা কখনোবা গুলি করার ভয় দেখাত। তখন একজন ডাক্তার সুলতানের ছবি আঁকা দেখে তাঁকে (সুলতানকে) তাঁর সহায়তার জন্য নিতে চান, শবব্যবচ্ছেদ করার সময় দেহের বিভিন্ন অংশের ছবি কম সময়ের মধ্যে আঁকার জন্য। তিনি ছিলেন একজন মর্গের ডাক্তার। বিশেষ করে তখন মর্গে অনেক লাশ আসছিল। তিনি সামাল দিতে পারছিলেন না। তখন আগ্রায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল। ডাক্তারের নির্দেশে তখন সুলতান একটি হিন্দু নাম গ্রহণ করেন। এবং ওই নামেই বেশ কিছু দিন পরিচিত থাকেন। ওই ডাক্তারের ওখানে কাজ করতে করতেই সুলতান হিউম্যান অ্যানাটমি সম্পর্কে ভালো বাস্তব জ্ঞান লাভ করেন।
ডাক্তার শবব্যবচ্ছেদ করে চলে গেলে তিনি একা ঘরে থেকে দেহের বিভিন্ন অংশের ছবি আঁকতেন। তিনি শুধু ছবি আঁকতেন না, তাঁর নিজস্ব বয়ানে, ভালোবেসে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। শরীরের বিভিন্ন অংশ আর পেশি, শিরা, উপশিরা। পরবর্তীকালে সুলতানের সৃষ্টিতে আমরা মানবদেহ প্রত্যক্ষ করেছি। ‘কি সুডৌল সুষম পেশিবহুল সুঠাম কান্তি কিষান’। আর আহমদ ছফার ভাষায়, ‘গুরুভার নিতম্ববিশিষ্ট পীনস্তনী চমৎকার স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠ লীলা চঞ্চলা নারী’। তবে সুলতানের আঁকা এই মানুষেরা বা বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ ‘যেখানেই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে...তারা মিসরের ছিল, ভারতে, বেবিলনে, গ্রিসে, রোমে সবখানে।’ তাঁর আঁকা সবকিছুরই যেন তিনি অন্তর-বাহির জানতেন।
যশোরে ডিসির ৭০ বিঘাসংবলিত বাংলোতে ছিল তিনটি পুকুর। সেখানে দীর্ঘকালীন আতিথ্য গ্রহণকালে আমি দেখেছি, কখনোবা তিনি কোনো পুকুরে মাটির সোপানে বসে আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, একা একা বসে কার জন্য বাজাচ্ছেন? তিনি বলেছিলেন, ‘কেন মাছ আছে না। অনেক মাছ। আর গাছগাছালি।’ একবার দেখেছিলাম, অতিথিকক্ষের কোলঘেঁষে একটি কাঁঠালচাঁপার গাছকে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষ এবং প্রকৃতিকে যে এত গভীরভাবে, নিবিড় অন্তরঙ্গতায় ভালোবাসা যায়, সুলতানের সঙ্গে পরিচয় না হলে তা আমার কখনো জানা হতো না।
সুলতানের কত রকমের কত ছবি যে কত দিকে ছড়িয়ে আছে তার ঠিকঠিকানা নেই। তিনি ছিলেন একজন অমিত-শক্তিধর শিল্পী। কম সময়ে এত পরিপূর্ণ ছবি আঁকা খুব কম শিল্পীর জন্যই সম্ভব। একবার আমি সরকারি কর্মে ব্যপদেশে ওয়েলিংটন গিয়েছিলাম। আশির দশকে। একদিন একটি আলোচনা শেষে নিউজিল্যান্ডের একজন উপমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘শুনেছি আপনি আর্ট পছন্দ করেন। গ্যালারিতে যেতে চান। তবে এখানে একজনের কাছে তিনটি পেইন্টিং আছে। যার চিত্রকারকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আপনাকে ওই বাড়িতে গৃহকর্তা একটু ড্রিংকসে আমন্ত্রণ জানাতে চান, দেখার জন্য। আমাদের জানামতো আর্টিস্ট বেঙ্গলের। আপনি গিয়ে দেখলে খুশি হব।’ আমি সোৎসাহে রাজি হলাম। গিয়ে দেখেই বুঝতে পারি তিনটি ছবিই সুলতানের আঁকা। সুলতান প্রথম দিকে মাঝে মাঝে ছবিতে স্বাক্ষর করতেন না। কখনো ছবির পেছনে করতেন। দুটো ছবিতে তাঁর স্বাক্ষর খুঁজে পেলাম না। একটিতে স্বাক্ষর রয়েছে, তবে কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সত্যিই অপূর্ব ছিল ছবিগুলো। ওদের অনুরোধে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি সার্টিফিকেট লিখে দিলাম। এই মর্মে যে ছবিগুলো এস এম সুলতানেরই আঁকা।
গৃহকর্তা ছবিগুলো সংগ্রহ করেছিলেন মহাযুদ্ধ শেষে ইন্ডিয়া থেকে নিউজিল্যান্ডে আসা একজন অভিবাসীর কাছ থেকে। বললেন, এগুলো আমার ‘ট্রেজার’, সম্পদ। খুব যত্ন করেই তিনি ছবিগুলো রেখেছিলেন।
হাতীতভাবেই বলা যায়, চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সত্যিই সম্পদশালী। আমাদের বেশ কয়েকজন অত্যন্ত উঁচু মানের শিল্পী রয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানের। তবে এটা লক্ষণীয় যে সুলতানের একটি অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক আবেদন রয়েছে। আর্টের জগতে তিনি এখনো সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপিত হতে পারেননি। আমার কাছে মনে হয় আমাদের উদ্যোগী শিল্পকলা একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুগপৎভাবে সুলতানের শিল্পকর্ম চতুর্দিক থেকে সংগ্রহ করে সুলতানের একটি পূর্ণাঙ্গ একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারেন। ঢাকায় আবুল খায়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে (যার মহাপরিচালক হচ্ছেন দক্ষ সংগঠক লুভা নাহিদ চৌধুরী) প্রায়ই চিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান করে থাকেন। আবুল খায়েরের ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে প্রচুর চিত্রকর্ম। শিল্পীকলা, সংগীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে তাঁর অভূতপূর্ব অবদান। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাস মারফত ছবি ধার করে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। দেশের ভেতরেও আবেদন করা যেতে পারে। যাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে সুলতানের ছবি আছে, তাঁদের সহযোগিতা করার জন্য। অন্তত সুলতানের ছবিগুলোর যত দূর সম্ভব একটি পূর্ণাঙ্গ সচিত্র তালিকা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। পাকিস্তান ও ভারতেও তাঁর আঁকা ছবি সম্ভবত পাওয়া যেতে পারে। বিলেত-আমেরিকায়ও খোঁজ করা যায়। মনে পড়ে পিআইএ একবার সুলতানের আঁকা ছবি মুদ্রিত করে বর্ষপঞ্জি তৈরি করেছিলেন।
আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবীর কাছে সমগ্র সুলতানের একটি সর্বাঙ্গসুন্দর উপস্থাপনা আমাদের একটি দায়িত্ব। জাতির জন্যও এটা হবে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।