বাংলা গান সমসাময়িক ভাবনা এবং ফিরে দেখা দিন

>আমাদের বাংলা গান এবং গানের ইন্ডাস্ট্রির বদলে যাওয়া হালহকিকত এবং কোনো গান কেন এখন আর মানুষের মনে সেভাবে স্থায়িত্ব পাচ্ছে না, এর কারণগুলো কী? এসব নিয়েই এই লেখা। লিখেছেন গীতিকার শেখ রানা।

পঁয়ত্রিশ টাকা।

আমরা যখন ক্যাসেট কিনতাম, কিনতাম মানে গোগ্রাসে কিনতাম, তখন দাম নির্ধারিত ছিল পঁয়ত্রিশ টাকা। এপিঠ-ওপিঠ মিলে বারোটা গান। আশি দশকের শেষভাগ থেকে নব্বইয়ের পুরো সময়টা এ দামেই কিনেছি। বারো গানের ক্যাসেটের দাম পঁয়ত্রিশ টাকাও সে সময় অনেক মনে হতো। হওয়ারই কথা। তখন তো টাকার এত অবমূল্যায়ন হয়নি। পাঁচ-দশ টাকারও ওজন ছিল বেশ।

কিন্তু এখন ফিরে তাকালে মনে হয় বারোটা গানের মূল্যমান কখনোই এত কম হতে পারে না।

দুই.
বাংলা গানের এই মূল্যমান কারা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, আমার জানা নেই। কিন্তু বারোটা মৌলিক গান লেখা-সুর-সংগীত-কণ্ঠ দেওয়া শেষে মিক্স মাস্টারিং করে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে যে পথপরিক্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তার তুলনায় এই মূল্যমান নিতান্ত কম ছিল সে সময়টায়। তখন সবকিছুর দাম বিত্ত বিবেচনায় মোটামুটিভাবে সবার কাছেই অনুকূল ছিল, জানি। শিল্প নিয়ে, শিল্পী নিয়ে কথা তো আমরা কম বলিনি। অথচ শিল্পের মান নির্ধারিত করে রেখেছিলাম হাইকোর্ট টু মিরপুর স্কুটার যাত্রার সমতুল্য।

দীর্ঘকাল পেরিয়েও খুব বেশি পরিবর্তন কি এসেছে? এখন একটা জিনস প্যান্টের দাম আকাশচুম্বী। দেড়-দুই হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায় না। এক বেলা রেস্টুরেন্টের খাবারের বিল প্রায় হাজারখানেক হয়ে যায় কিন্তু গানের সম্মানী (নির্দিষ্ট করে বললে ক্যাসেট বা সিডির গান) সেই অনুপাতে তেমন একটা বাড়েনি। বিলেতে দেখেছি একটা মোটামুটি দামের জিনস প্রাইমার্কে দশ–বারো পাউন্ডে কিনতে পারি। একটা সিডিও কিন্তু বিলেতে সেই দামেই কিনতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ব্যবধানটা আগের মতো রয়ে গেছে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেড়েছে।

সিডি বিক্রি বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই কমে গেছে জানি। দোকানই তো উঠে গেছে। এখন তো সিডি শোনার ডিভাসই প্রায় নেই। এবারও ঢাকায় ফিরে দেখলাম নিউমার্কেটের সেই সারি বাঁধা ক্যাসেটের দোকান প্রায় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, এলিফ্যান্ট রোড ধরে স্টেডিয়াম মার্কেটের অগুনতি দোকানের একটিও অবশিষ্ট নেই।

গান কিন্তু থেমে নেই! গান হচ্ছে, হবে।

তবে?

গানে ফিরি তাই। গানের কথা নিয়ে কিছু আলোকপাত হোক বরং।

তিন.
আমাদের গানের কথা কী খুব বদলে গেছে?
বাংলা ব্যান্ডের গানের কথায় আরও বেশি রকম অদল-বদল আশা করেছিলাম আমি। বিলক্ষণ জানি, একজোড়া চোখ দিয়ে বাংলা ব্যান্ডের গানের বিশাল পরিসরটা এক বসায় ধরা সম্ভব নয়। সে চেষ্টাও আমি করছি না।

নব্বইয়ের শুরুর দিকে কলকাতার বাংলা গানে যে জোয়ার এসেছিল, তা খুব সহজে এবং কালক্ষেপণ না করে আমাদের কানে পৌঁছে গেছে। মনে আছে, নিউমার্কেট বা ‘গীতাঞ্জলি’র দোকানে এইচএমভির ক্যাসেট পাওয়া যেত তখন। সুমন, অঞ্জন, কিছু পরেই নচিকেতার গানে কথার যে দ্রোহ, অথবা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের শান্ত স্বরে তন্ত্রে তন্ত্রে যে কোমল জাগরণ, সব মিলে একটা গভীর আর গম্ভীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে কানায় কানায়।

আমাদের বাংলা ব্যান্ডের গানে কি বিষয়ভিত্তিক গান হয়নি এর আগে? বিস্তর হয়েছে। সেই সমসাময়িক কথার গানে সাহসের সঙ্গে উঠে এসেছে সময়। শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথায় ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বা ‘আজ যে শিশু’, মাকসুদুল হকের কথায় একের পর এক বারুদ, স্বৈরাচারী সরকারের শাসনকাল পরবর্তী সময়ে মিলনের রক্ত নিয়ে প্রমিথিউস, রাজাকারের তালিকা চেয়ে নোভা, স্বাধীনতা নিয়ে হাহাকার করে বাপ্পী খানের ‘হায়! স্বাধীনতা’। একদম ঝিমঝিম অনুভূতি নিয়ে দেহলভীর ‘হারাগাছির নুরজাহান’, লতিফুল ইসলাম শিবলীর ‘মান্নান মিঞার তিতাস মলম’, সঞ্জীব চৌধুরীর গীতিকবিতায় ‘ইয়াসমিন’—অসংখ্য গান হয়েছে আশির দশকের সময় ধরে আর নব্বইয়ের পুরোটা জুড়ে।

সেই ধারা কিন্তু থেমে নেই। ভালোবাসা-প্রেম-প্রকৃতির গীতিকবিতার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক গান এখনো হচ্ছে। কিন্তু চোখে বা কানে লাগছে কম। কেন?

তার একটা মূল কারণ হলো, প্ল্যাটফর্ম বদলে যাওয়া। ইউটিউবে গান ছেড়ে আমরা ফেসবুকিং করছি, ইনবক্সে কথা বলছি। ফাঁকে ফাঁকে হয়তো বই পড়ছি। অনেক কিছু করছি কিন্তু কান ফেলে গান শুনছি না আগের মতন করে। একাগ্র হয়ে ক্যাসেটটা ধরে আদর করে ফিতা বের করে ক্যাসেট প্লেয়ারে ঢুকিয়ে ইনলের লিরিক পড়তে পড়তে গান শোনার দিন বিগত। গানের সঙ্গে যে একাত্মতা হতো আগে, এখনকার শ্রোতা গানের সঙ্গে, গীতিকবিতার সঙ্গে, গায়কের সঙ্গে, সুরের সঙ্গে নিজেকে সেই বন্ধনে প্রত্থিত করতে পারছে না। গানের একটা অন্তরা শুনে ভালো না লাগলে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পরের গান বা অন্যকিছুতে চলে যেতে পারছি। এই দ্রুত বদলে ফেলা বা সুইচিং মুড শ্রোতাকে ক্রমেই অস্থিরতায় গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই স্থির, শান্ত সময় ফিরে আসছে না কোনোভাবেই।

অনেক গান হওয়ার পাশাপাশি অনেক ভালো গান তাই চোখের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে অনেক ভালো গান রং–চকচকে ভিডিও, মুহুর্মুহু প্রচারণা, গিমিক আর ভিউ গোনার সোচ্চারে চাপা পড়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। আমরা জানতেও পারছি না। অথবা জেনেও না জানার ভান করে সেই গিমিকেই সমর্পিত হচ্ছি।

পাটুয়াটুলী রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটে একসময় প্রায় সব দোকান ছিল অডিও ক্যাসেট ও সিডির পাইকারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ঘড়ির দোকান। ছবি: প্রথম আলো
পাটুয়াটুলী রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটে একসময় প্রায় সব দোকান ছিল অডিও ক্যাসেট ও সিডির পাইকারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ঘড়ির দোকান। ছবি: প্রথম আলো

চার.
আমাদের বাংলা ব্যান্ডের গান বা বাংলা গানে, যা–ই বলি না কেন, একটা ক্ষতিকর পঙ্গপাল বরাবর রয়ে গিয়েছিল। সেটা হলো, ‘পাবলিক খায়’। শুধু গান নয়, আমাদের সাহিত্য, যেকোনো সৃষ্টিশীল কর্মে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকারক এক দুষ্ট শব্দের নাম ‘পাবলিক খায়’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো নাগরিক জার্নাল’ বইতে এই নিয়ে ছোট্ট করে লিখেছিলাম আমি। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পাঠকের জন্য তা তুলে দিচ্ছি।

‘পাবলিক খায় বলেই অসাধারণ নাগরিক গীতিকবি একসময় প্রিয় শব্দচয়ন ছেড়ে লিখতে শুরু করেন সস্তা কথার গান, কারণ সে গানই জনপ্রিয়তার তকমা পাচ্ছে ইদানীং আর জনপ্রিয় গানই পাবলিক খায়। পাবলিকে খায় বলে একসময় ভাবনার গভীরে টংকার দেওয়া গানের গায়ক অনেক বেশি শ্রোতাকে নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে আনতে গাইতে শুরু করেন এমন সব গান, যে গানের মুণ্ডুপাত একসময় নিজেই বসে করেন আর অবাক হয়ে ভাবেন, এসব গান কেন গাইতে গেলাম আমি। পাবলিকে খায় বলেই ক্যাসেট কোম্পানিগুলো একসময় হিন্দি আর ইংরেজি গানের বাংলা করে বাজার সয়লাব করে ফেলেছিল।

‘জনপ্রিয়তাকে অগ্রাহ্য করা খুব কঠিন কাজ। আমাদের দেশের অডিও ইন্ড্রাস্ট্রির নিরিখে এ এক দুঃসাধ্য কাজই বটে। একেবারেই অপেশাদার বনিয়াদে বেড়ে ওঠা এখানে অর্থনির্ভরতার পাকেচক্রে পড়ে একসময় অনেক ভালো গায়ক, ভালো গীতিকার, ভালো সুরকারের অপমৃত্যু ঘটে। বেশি পাবলিক ধরার জন্য শুধু সময়কে পুঁজি করে সৃষ্টি করতে যেয়ে সেই সময় চলে গেলে আর সাধন হয় না তাঁর। একসময় যে পাবলিকের কথা মাথায় রেখে গান বানানো শুরু করেছিলেন একজন, অবাক হয়ে দেখেন, সেসব পাবলিকই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। তখন হা-হতোস্মি করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।’

কিন্তু এই কথাগুলো বলা যতটা সহজ, আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর বিপরীতে হাঁটা রীতিমতো বিপৎসংকুল। গায়ক বলি বা গীতিকার—শুধু গানকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিজের সামর্থ্য এবং স্বপ্নের ইচ্ছেপূরণের গল্প একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না বোধ করি। কখনো না কখনো এই স্রোতেই গা ভাসাতে হবে কমবেশি।