পিতৃপুরুষের ভিটেয়

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অবসরের পর আমি পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে পুনরায় বসবাস শুরু করি। এগারো বছর পর দেশে ফিরে এসে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকি। এই সময় একদিন আমার বিশেষ বন্ধু বাংলাদেশের প্রফেসর আবদুল হকের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয় । হক সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯০ সালে, নাইজেরিয়ার মাইদুগুরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার এ জীবনে এমন সুন্দর, সরল ও উদার মনের মানুষের সংস্পর্শে আমি খুব কমই এসেছি। ২০১৩ সালে তিনি নাইজেরিয়া থেকে ফিরে এসে ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) সঙ্গে যুক্ত হন। তো, হক সাহেব আমাকে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সেই সঙ্গে বরিশাল জেলার রায়েরকাঠিতে আমার পূর্বপুরুষের ভিটে ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন।
আমার মনে হলো, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা, বাংলাদেশ ঘোরা এবং অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে রায়েরকাঠির বাড়িতে যাওয়ার এ তো এক মোক্ষম সুযোগ। সেই সঙ্গে হক সাহেব আমাকে ইউল্যাবে একটা সেমিনারের কথাও বললেন। অর্থাৎ এক ঢিলে চার পাখি। ফলে প্রস্তাবটা লুফে নিলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমার মা–বাবা ও ঠাকুমার কাছে আমাদের বাংলাদেশের রায়েরকাঠির বাড়ির অনেক কথা শুনেছি। তখন থেকেই মনের মধ্যে বাড়িটি দেখার আগ্রহ তৈরি হয়। হক সাহেবের এক অনুরোধেই আমি রাজি হয়ে যাই। আমার আরেক বন্ধু সবুজ ভাই ওরফে আমিনউল্লাহ চৌধুরী থাকেন ময়মনসিংহ শহরে। আর তাঁর দেশের বাড়ি ভালুকা গ্রামে। তাঁদের আমি হক সাহেবের আমন্ত্রণের কথা জানাই। তাঁরা যারপরনাই খুশি হন। সবুজ ভাই ও তাঁর স্ত্রী নিলুফার পারভীনের মতো দিলখোলা মানুষের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বহুদিনের, তাঁদের মেয়ে, আমাদের স্নেহভাজন তন্বী, তানিয়া শুকরানার পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনা করার সুবাদে। সে সময় থেকেই তাঁরা আমাদের বহুবার বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ি ও রায়েরকাঠি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
আমার বাবা ‌হরিদাস বসু (১৯০২-১৯৮১) খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে পাস করে ১৯২২ সালে ভারতীয় রেলওয়ের চাকরিতে নিয়োজিত হন। মা রেণুকণা বসু (১৯১১-১৯৯৬) ও ঠাকুরমা সুহাসিনী বসু (১৮৮৫-১৯৭৪)—এঁরা সবাই ১৯৩১ সালে আমার দাদুর মৃত্যুর পর রায়েরকাঠি থেকে বাবার কাছে রেলের কোয়ার্টারে বসবাস করতে চলে আসেন। তাঁরা বিহারের কুসুমডায় কয়েক বছর থাকার পর পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে আসেন। তারপর থেকে ওখানেই বসবাস করতে থাকেন এবং মাঝেমধ্যেই রায়েরকাঠির বাড়িতে যেতেন। কিন্তু দেশভাগের পর ১৯৫০ সাল অর্থাৎ যে বছর আমার জন্ম, সেই বছরে আমার কাকা ও তাঁর পরিবার বাড়ির চাবি ও দলিলপত্র ওখানকার বাড়ির কর্মচারী আরব আলী খানের কাছে রেখে আসানসোলে চলে আসেন। এরপর আর কোনো দিনই আমাদের পরিবারের কেউই সেখানে যাননি। তাঁদের কাছে ওখানকার সম্বন্ধে আমি অনেক কথা শুনেছি। যে কারণে মনের মধ্যে একটা ছবি আঁকা হয়ে গেছে। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল, একবার রায়েরকাঠি যাওয়ার, নিজের বাড়ি দেখার। কিন্তু তাঁর আর সে সুযোগ হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পশ্চিম বাংলার অনেকে সেখানে ঘুরতে যান এবং নিজেদের বাড়ি দেখে আসেন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে একদিন জানতে পারি দাঁইহাট (জেলা বর্ধমান)-এ আমার বন্ধু অরুণ ভট্টাচার্য খুলনাতে তার বাড়ি দেখতে যাচ্ছে, সে সেখানে পড়াশোনা করেছে। আমার বাবা তাকে অনুরোধ করেন, যদি সম্ভব হয়, একবার যেন রায়েরকাঠিতে আমাদের বাড়ি দেখে আসে। অরুণ ফিরে এসে জানায়, ওই বাড়িতে আরব খানের পরিবার বসবাস করে। আমার বাবা তার কাছে সে বাড়ির খুঁটিনাটি অনেক কথা জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছিলেন। কিন্তু তাঁর সে বাড়ি দেখতে যাওয়ার সুযোগ আর হয়নি। তিনি বলতেন, মরণের পর যদি সত্যিই কিছু থাকে তাহলে তাঁর মৃত্যুর পর প্রথমেই তিনি রায়েরকাঠির বাড়িটি দেখতে যেতে চান, এমনই ছিল তাঁর অন্তরের টান।
হক সাহেব একদিন ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের একটা প্রোগ্রাম করে পাঠালেন। সেই অনুযায়ী আমি আমার ও আমার স্ত্রী মালা বসুর জন্য দুটো আসা-যাওয়ার টিকিট কাটলাম, কলকাতা-ঢাকা- কলকাতা। ভিসার জন্য একদিন সকালে কলকাতায় পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিসে তিন-চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর যাবতীয় নথিপত্র জমা দিলাম এবং তাদের কথামতো সাত দিন পর সন্ধ্যা ছয়টার সময় ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে এলাম। নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ৯ অক্টোবর ২০১৭ সন্ধ্যাবেলায় আমরা ৪০ মিনিটের আকাশ যাত্রার পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম, বহুদিনের ইচ্ছা পূর্ণ হলো। ঢাকা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
বাংলাদেশে এসে আমি তো অভিভূত। বাইরে এসে হক সাহেব ও তাঁর বড় মেয়ে সাফওয়ানার সঙ্গে দেখা হলো—২৪ বছর পর, সে এক অনন্য অনুভূতি। উত্তরাতে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট, খুব সুন্দর সাজানো–গোছানো। অনেক দিন পর বন্ধু, বন্ধুর স্ত্রী শেরিফা (পম্পা) ভাবি ও তাঁদের দুই উচ্চশিক্ষিতা কন্যা সাফওয়ানা ও ফারহানাকে দেখে আমরা খুব খুশি হলাম। দুই কন্যাই ঢাকায় ভিন্ন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। পম্পা ভাবির বিভিন্ন পদের রান্নার তুলনা হয় না, বিশেষত বিভিন্ন প্রকার আচার। তাঁদের পরিবার সব রকম কর্মব্যস্ততার মধ্যেই সময় করে অত্যন্ত নিপুণভাবে কয়েক দিন ধরে ঢাকা শহর ও তার আশপাশের সব দ্রষ্টব্য আমাদের ঘুরে দেখিয়ে দিলেন। এরপর আমরা গেলাম সবুজ ভাইয়ের বাড়িতে, ময়মনসিংহের ভালুকায়।

>আক্ষেপ করে সেলিম ভাই বললেন যে এখনো ওই জমি-বাড়ি ওনাদের নামে হয়নি। জমির দলিল দেখালেন। সেই পর্চায় এখনো আমাদের পরিবারের সবারই নাম রয়েছে। বললাম, জমি হস্তান্তরের ব্যাপারে আমাদের কিছু করণীয় থাকলে নিশ্চয়ই করব। বিকেলে ফেরার সময় দুই ব্যাগভর্তি গাছের ফল দিয়ে আমাকে সেলিম ভাইয়ের স্ত্রী বললেন, ‘আপনাদের গাছের ফল।’ ‘আমাদের গাছের ফল’! কানে কেমন যেন বাজল—সত্তর বছর পরেও?

সবুজ ভাইয়ের বাড়িতে নীলুফার ভাবির আন্তরিক আতিথেয়তায় কয়েক দিন সুখবাসের পর আমরা নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা থেকে লঞ্চে করে বরিশাল যাত্রা করলাম। সঙ্গী, অভিভাবক ও গাইড সবুজ ভাইয়ের কন্যা তানিয়া শুকরানা, আমাদের অতি আদরের তন্বী। লঞ্চের নাম ‘সুন্দরবন–১০’, সুন্দর সাজানো কেবিন। কেবিনে থাকলাম কম। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা তিনজন রেলিংয়ের ধারে পাতা চেয়ারে বসে চাঁদের আলোয় রাতের জলযাত্রা উপভোগ করলাম । বুড়িগঙ্গা থেকে মেঘনা হয়ে কীর্তনখোলায় পড়লাম, খবর দিল জিপিএস। অবশেষে ভোর পাঁচটায় পৌঁছালাম বরিশাল নদীবন্দরে।
হোটেলে স্নান ও প্রাতরাশ সেরে পূর্ণোদ্যমে গাড়িতে রওনা হলাম রায়েরকাঠির উদ্দেশে। কবি জীবনানন্দের বাসস্থান পার হয়ে, ধানসিঁড়ি নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে, গাবখান সেতু, ঝালকাঠি পেরিয়ে ডান দিকে কীর্তিপাশা যাওয়ার রাস্তাকে রেখে আরও এগিয়ে চললাম। মনে পড়ল এই সেই কীর্তিপাশা, যেখানে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ পদ্মভূষণ তপন রায়চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি। বেকুটিয়া ফেরিঘাটে আমরা গাড়িসমেত নৌকার ওপর উঠে নদী পার হলাম, নদীর নাম কচা নদী। আরও এগিয়ে গেলে পিরোজপুর। এই নামগুলোর সঙ্গে খুবই পরিচিত ছিলাম ছোটবেলা থেকেই। তারপর বহু প্রতীক্ষিত রায়েরকাঠিতে পৌঁছালাম। খোঁজ করলাম বসুবাড়ির। কিন্তু কেউ বলতে পারলেন না। আমার বড়দা সুব্রত বসুর জন্ম রায়েরকাঠিতে ১৯৩১-এ। তাঁর কাছে শুনেছিলাম আমাদের বাড়ির কাছেই একটা প্রাইমারি স্কুল ছিল। সেই স্কুলও খুঁজে পেলাম। সেখানে গিয়ে শিক্ষক মহাশয়দের কাছে বসুবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলেন না। তারপর এক শিক্ষয়িত্রী আমাদের জানালেন, ওখানকার জমিদার অমরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী ওরফে কুট্টি চৌধুরীর বাড়ি কাছেই। সেখানে তাঁর ছোট ছেলে গৌর কুমার রায়চৌধুরী থাকেন, তিনি সম্ভবত সাহায্য করতে পারেন। কুট্টি চৌধুরীর নাম আমি আগে অনেক শুনেছি। তাঁর এক ছেলে অবনী রায়চৌধুরী কলকাতায় স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন। আর এক ছেলে পরিমল রায় চৌধুরী গান অ্যান্ড সেল ফ্যাক্টরিতে উচ্চপদে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, এখন কলকাতায় বসবাস করছেন।
জমিদার বাড়িতে পৌঁছলাম। বাগান ও বড় বড় গাছপালা দিয়ে ঘেরা বিস্তৃত বাড়িটির বিভিন্ন ছড়ানো-ছিটানো অংশের ভগ্নাবশেষ দেখে অতীতের আড়ম্বরপূর্ণ গৌরবের দিনগুলোর কথা অনুমান করা যায়। বাড়ির উঠানের মাঝখানে দুর্গা মণ্ডপ, সেখানে প্রতিষ্ঠিত দুর্গামূর্তি। বাড়িটি পরবর্তীকালে হেরিটেজের সম্মান লাভ করেছে।
গৌর রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো। আমার দাদু যদুনাথ বসু, বাবা হরিদাস বসু ও কাকা প্রফুল্ল বসুর কথা বলে বসুবাড়ির হদিস জানতে চাইলাম। সব শুনে তিনি জানতে চাইলেন আমি ‘ভানুদা’র ভাইপো কি না। চমৎকৃত হলাম। আমি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও আমার কাকার ডাকনাম ‘ভানু’ তাঁর মুখে শুনে আমি নিশ্চিত হলাম যে তিনি আমাদের পরিবারের সঠিক পরিচয় ধরতে পেরেছেন এবং তিনিই পারবেন আমাদের পৈতৃক ভিটের হদিস দিতে। আমরা উদ্‌গ্রীব হয়ে তখনই বাড়ি দেখতে যেতে চাইলাম। কিন্তু ওনার স্ত্রী পূর্ণিমা কর রায়চৌধুরী। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, অত্যন্ত অমায়িক। আমাদের চা-মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়লেন না। চা খেতে খেতে গৌর রায়চৌধুরী আমাদের পরিবার সম্বন্ধে অনেক গল্প করলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাদের পরিবারের সবার ডাকনাম উল্লেখ করে অনেক কথা ও ঘটনা বললেন, যার কিছু কিছু আমি ছোটবেলায় বড়দের কাছে শুনেছিলাম।

উৎসাহিত আমরা তিনজন এরপর গৌরবাবুর সঙ্গে হাঁটাপথে রওনা হলাম। পথে যেতে যেতে চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বেশ খানিকটা দূরে দূরে কয়েকটি বাড়ি দেখতে পেলাম। জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে ডান দিকে ভারতের ভূতপূর্ব আর্মি জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর মামাবাড়ি দেখলাম, একটু এগিয়ে বাঁ দিকে কলকাতার স্টার থিয়েটারের মালিক সলিল মিত্রের বাড়ি, আরও একটু এগিয়ে ভারতীয় রেলের প্রথম ভারতীয় চিফ ইঞ্জিনিয়ার এন কে মিত্রের বাড়ি। এবং আরও অনেকের বাড়ি দেখলাম, যাঁদের কথা আমি আমার ঠাকুমা, মা-বাবার কাছে অনেক শুনেছি। তারপর বহু প্রতীক্ষিত আমাদের বাড়িতে পৌঁছালাম।

পিতৃপুরুষের ভিটে রায়েরকাঠি গ্রামে পরিবারসহ লেখক। ছবি: লেখক
পিতৃপুরুষের ভিটে রায়েরকাঠি গ্রামে পরিবারসহ লেখক। ছবি: লেখক

ঢোকার আগেই বাড়ির পাশে খালের ধারে আমার দাদুর সমাধিতে প্রণাম করলাম। বাড়িতে গিয়ে পরিচয় হলো আরব খানের নাতি সেলিম খান, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে। মনের মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি হলো। তাঁদের আতিথেয়তা ভোলার নয়। অনেক কথাবার্তা হলো। বাবার কাছে শুনেছিলাম আমাদের বাড়ির মাথায় দুটো সিংহের মূর্তি ছিল, ওই দুটো না থাকায় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভেঙে ফেলেছেন। কারণ খানসেনারা দেখে হিন্দু বাড়ি মনে করে গুলি চালাতে পারত। সেলিম ভাই জানালেন, তাঁর দাদু আরব খান আমার বাবা ও কাকার অনেক খোঁজ করেছেন, কিন্তু পাননি। জানতে চাইলেন, কেন আমার বাবা–কাকারা আর কখনো নিজেদের ভিটেমাটি দেখতে এলেন না। বাড়িটি পুরোনো হওয়ায় অনেকখানিই ভেঙে গেছে। ঘুরে ঘুরে দেখার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, এ বাড়িতে একসময় আমার দাদু-ঠাকুমা ও তাঁদের পূর্বপুরুষেরা থাকতেন, আমার বাবার জন্ম এখানে, আমার মা এগারো বছর বয়সে এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন। সবার পায়ের ধুলো পড়েছে এ বাড়ির মাটিতে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে গেল—‘সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া’। ভিটের ধুলো নিয়ে মাথায় ছোঁয়ালাম।
এরপর ঘুরে দেখলাম ঠাকুরবাড়ি, শিবমন্দির ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে স্থাপিত সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। শিবমন্দিরগুলোর অদ্ভুত সুন্দর স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হলাম। এখানে আমার ঠাকুরমা, মা, কাকিমারা পুজো দিতেন। ছবি তুললাম। চারদিক গাছগাছালিতে সবুজ, বিরাট লম্বা লম্বা গাছ। তার মধ্য থেকে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। মেটাল রোড। পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট খাল বয়ে গেছে এবং তার ওপারে হাইওয়ে। মনে হলো কত যেন পরিচিত জায়গা।
পরিশেষে আক্ষেপ করে সেলিম ভাই বললেন যে এখনো ওই জমি-বাড়ি ওনাদের নামে হয়নি। জমির দলিল দেখালেন। সেই পর্চায় এখনো আমাদের পরিবারের সবার নামই রয়েছে। বললাম, জমি হস্তান্তরের ব্যাপারে আমাদের কিছু করণীয় থাকলে নিশ্চয়ই করব। বিকেলে ফেরার সময় দুই ব্যাগভর্তি গাছের ফল দিয়ে আমাকে সেলিম ভাইয়ের স্ত্রী বললেন, ‘আপনাদের গাছের ফল।’ ‘আমাদের গাছের ফল’! কানে কেমন যেন বাজল—সত্তর বছর পরেও? বললাম, এগুলো নিয়ে যেতে অনেক খরচ লাগবে। পরক্ষণেই মনে হলো, আমার ছোট পিসি বেলা নিয়োগীর বয়স ৯১ বছর। কল্যাণীর খুব কাছেই হালিশহরে থাকেন। এ বাড়িতে জন্মেছেন এমন মানুষদের মধ্যে একমাত্র তিনিই জীবিত। এ বাড়ি থেকেই একুশ বছর বয়সে ১৯৪৬ সালে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। ফিরে আসার পর ওখানে তোলা সব ফটো ও বাগানের ফল নিয়ে পিসির কাছে গেলাম। তিনি ভীষণ খুশি এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন। আমার পূর্বপুরুষের ভিটেয় যাওয়া সার্থক হলো। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা সর্বজনবিদিত। সবুজ ভাই, হক সাহেব, গৌর বাবু ও সেলিম ভাইয়ের বাড়ির আতিথেয়তা আবার তা প্রমাণ করল।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]