আকর্ষণ

অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

১৯৪০ সালের শেষে অসহনীয় গরমের সময়ে অ্যাডিলেডের ওয়ারেন্ডেল সেনা ক্যাম্পের ২/৭ কজ্যাল্টি ক্লিয়ারিং স্টেশনে চিকিৎসা-প্রশিক্ষণের সমাপনী পর্ব শেষ করছিল ডরিগো ইভান্স। আর মনে মনে ভাবছিল, আসার আগে কে জানত এখানে এমন অসহ্য গরম! যাহোক, দিনটি ছিল ছুটির দিন—অর্ধদিবস ছুটি। করার মতো তেমন কিছুই ছিল না। টম সিডনি থেকে টেলিগ্রাম করেছে, কেইথ আংকেল ডরিগোকে দেখতে আগ্রহী—‘চিন্তার কোনো কারণ নেই, তোমার খোঁজখবর তিনি নেবেন বলে জানিয়েছেন।’ আংকেল কেইথ অ্যাডিলেড শহরের বাইরে অবস্থিত একটি শুঁড়িখানার মালিক। কেইথ ম্যুলভ্যানিকে আগে কখনো দেখেনি ডরিগো। তার সম্পর্কে কেবল এটুকু জানে, ডরিগোর বাবার সবচেয়ে ছোট বোনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বছর কয়েক আগে তার সেই স্ত্রী অটোমোবাইল দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে আবার বিয়ে করেন তিনি। তবে মৃত স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে এখনো কেইথের যোগাযোগ আছে। এই ছুটির ফাঁকে ডরিগো ভেবেছিল, আংকেলকে দেখতে যাবে কিন্তু যে গাড়িতে করে তার যাওয়ার কথা সেটি বিকল। তাই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় সে রাতে সহকর্মী কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করেছিল ডরিগো।
দিনটি ছিল মেলবোর্ন কাপের দিন; এবং একে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছিল রাস্তায়। খেলার ইভেন্ট শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে রাস্তায় হাঁটছিল ডরিগো। এ সময় হঠাৎ সে ঢুকল রান্ডেল স্ট্রিটের একটি পুরোনো বইয়ের দোকানে। পরনে লম্বা গলাবন্ধনী ও উষ্কখুষ্ক চুলের এক ভদ্রলোক একটা সাময়িকীপত্র থেকে পড়ছিলেন জোরে জোরে। এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না ডরিগো। তার মন পড়ে ছিল ভিক্টোরীয় ও প্রাচীন কবিদের জন্য।
দোকানে ক্রেতার সংখ্যা হাতে গোনা। একটু এগিয়ে দোকানের শেষ মাথায় জনশূন্য একটি জায়গায় গেল ডরিগো। পাশেই চোখে পড়ল কাঠের সিঁড়ি। বেঁয়ে ওপরে উঠে দেখল, একজন মানুষও নেই দোতলায়। চারপাশটা বইয়ে ঠাসা। যে দিকেই চোখ যায়, শুধু বই আর বই।
ওপরের এ ঘরে নিচের তুলনায় একটু গরম বেশি, কিন্তু নিচতলার ওই ভদ্রলোকের কবিতা আবৃত্তি শোনার চেয়ে এখানে ঘুরেঘুরে বই দেখাটা তো স্বস্তিকর। সে এমন কয়েকটি বইয়ের তাক খুঁজে পেল, যেগুলো ধ্রুপদি লেখকদের বইয়ে পরিপূর্ণ, তবে পুরোনো সংস্করণ। অল্প দামে ভার্জিলের ইনিড-এর কোনো পুরোনো সংস্করণ পাওয়া যায় কি না, খুঁজছিল সে! কারণ এটিই একমাত্র বই, যা সে অন্যজনের কাছ থেকে ধার করে পড়েছিল। কেবল প্রাচীনকালের এই বিখ্যাত কবিতার বইটি খুঁজে পাওয়ার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল না ডরিগো; বরং বইগুলোর আশপাশ থেকে যে সৌরভ ভেসে আসছিল তা কেবল ওই ঘরের ভেতরের পরিবেশকেই মোহনীয় করছিল, তা নয়; তার মনোজগতেও এমন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল, যা অব্যখ্যেয়। আর সেই সুবাস এও জানান দিচ্ছিল, ওই ঘরে একা নয় ডরিগো।
সিঁড়ির ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল কোলাহলের শব্দ। জনা কয়েক লোক চেঁচামেচি করছিল, পাশেই দাঁড়ানো ছিল দুই নারী—একজন দেখতে একটু লম্বাটে; লালচে চুল, পরনে কালো টুপিবিশেষ। অন্যজন খাটো, স্বর্ণকেশী, আর কানের ঠিক পেছনে গাঢ় লাল ফুল। আর লোকেরা রয়েছে নিজেদের নিজ নিজ চাকরির বিশেষ পোশাকে। তাদের পোশাকে লেখা—আরএএএফ, আরএএন ও এআইএফ। ডরিগোর আন্দাজ, এরা সবাই কিছুটা মাতাল অবস্থায় রয়েছে। আর এদের সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে নজরদারি করছিল অপেক্ষাকৃত খাটো নারীর ওপর; যদিও ব্যাপারটি নিয়ে ওই নারীর ভ্রুক্ষেপ ছিল না মোটেও।
নারী ও লোকগুলোকে যথেষ্ট বিরক্তিকর লাগছিল ডরিগোর। সে কানের পেছনে লাল ফুল গোঁজা খাটো নারীর ওই ক্ষমতাকে অপছন্দ করছিল, যা লোকগুলোকে পরিণত করেছিল তাঁর পোষা কুকুরে। নারীটির প্রতি এ কারণে ঘৃণা জন্মেছিল তার।
সে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল বইয়ের তাকের দিকে। হঠাৎ তার মনে পড়ল ইলার কথা। মেলবোর্নে শল্যবিদ্যার ওপর প্রশিক্ষণের সময় ইলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওর বাবা ছিলেন মেলবোর্নের প্রখ্যাত আইনজীবী; মাও জন্ম স্বনামধন্য পরিবার থেকে আসা; আর ইলা নিজে ছিল শিক্ষক। ডরিগোর মতে, ইলার জগতটি ছিল তার একান্ত নিজের—সে জগত খুবই নিরাপদ, আত্মপ্রত্যয়ী ও অপরিবর্তনীয়। ইলার পরিবার এতটাই উদার ছিল যে সেখানে সমাজের নিচু শ্রেণির উচ্চাশাপূর্ণ এক যুবকেরও প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু ওই প্রবেশই যা, এর বাইরে অন্য ভাবনা যেন মাথায় না আসে, সেটিও বুঝিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার।
অবশ্য এ ঘটনায় ডরিগো হতাশ হয়নি। তত দিনে পুরোদস্তুর সার্জন সে। একবার ভেবেছিল ইলাকে বিয়ে করার কথা। যদিও এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কখনো কোনো কথা হয়নি। সে ভেবেছিল ইলাকে বিয়ে করা মেডিকেল ডিগ্রি সম্পন্ন করার মতোই—জীবনযুদ্ধে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণের জন্য গোপনে লুকানো এক জগৎ যেন অধিকার করে নিয়েছিল ডরিগোকে।
এদিকে খাটো নারী ও তাকে ঘিরে থাকা পুরুষের দলটি এগিয়ে আসছিল ডরিগোর দিকে। তাদের দেখে মনে হয়, একঝাঁক মাছ কিংবা পাখি। তাকে কেউ অনুসরণ করছে, এই ভেবে বইয়ের তাক থেকে একটি বই নিয়ে তাতে আরও বেশি মনোনিবেশ করল ডরিগো। তবে কানের পেছনে লাল ফুল গোঁজা নারী পা বাড়াচ্ছিলেন তার দিকেই। একসময় আলো-আঁধারের আবছায়ায় ডরিগোর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
আগুন-শিখার নীল আলোর মতো জ্বলছিল তাঁর চোখজোড়া। ডরিগোর চেতনায় কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য ছিল সেই চোখগুলো। হিংস্র, সচেতন দৃষ্টি মেলে ডরিগোকে দেখছিলেন তিনি; নেহাত তাকিয়ে থাকা নয়, যেন গিলে খাচ্ছিলেন তাকে। ওই নারী ডরিগোর কী পরখ করছিলেন, তা সে জানে না। আর এই অনিশ্চয়তাই তাকে যেন আরও বিরক্ত করে তুলছিল।
হাসতে হাসতে ডরিগোকে নারীটি বললেন, আপনাকে আমি বইয়ের দোকানে ঢুকতে দেখেছি।
নারীকে দেখতে কেমন লাগছে, এর কোনো উত্তর ডরিগোর কাছে ছিল না। তাঁর চুলে গোঁজা বড় লাল ফুলটিই যেন ছিল তাঁর বড় পরিচয়।
আপনার চোখ, নারীর আকস্মিক উচ্চারণ।
বলার মতো তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না ডরিগো। চোখ? কিছু না বুঝেই ওই নারীকে গভীরভাবে দেখতে লাগল সে। একটা ব্যাখ্যাতীত হৃদ্যতা যেন খেলা করছিল দুজনের মধ্যে।
সেই নারীর ওপরের ঠোঁটের জন্মদাগটা তার অসৌন্দর্যকে কিছুটা ফুটিয়ে তুলেছিল। ডরিগো খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিল, নানা অসৌন্দর্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মূল সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্যই হয়তো নারীর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল একটা আত্মবিশ্বাস। তাই বলে এ আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট নয় ডরিগোকে পাওয়ার জন্য।
নারীটি হাসিমুখে বললেন, খুব কালো—এ কথাটা হয়তো আপনি আরও অনেকবার শুনে থাকবেন।
না, শুনিনি তো, ডরিগোর উত্তর।
কথাটি পুরোপুরি সত্য ছিল না, কিন্তু নারী যেভাবে বললেন, এভাবে আগে কেউ কখনো বলেননি।
আপনার ফুল? বলল ডরিগো ইভান্স।
চুরি হয়ে গেছে, নারীর উত্তর।
নারী মনে হয় সারাক্ষণই নানাভাবে যাচাই করে যাচ্ছিলেন তাকে, গড়ে নিচ্ছিলেন নিজের মতো করে, পৃথিবীর সব মুগ্ধতাও যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন ডরিগোর মধ্যে।
ফুলটি ভালো লেগেছিল? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
ডরিগোর উত্তর, খুব।
ক্যামেলিয়ার ঝোপ থেকে আনা, বলে আবারও হাসলেন। তারপর হঠাৎই চুপ। এগিয়ে এলেন ডরিগোর সামনে; একটা সুগন্ধ পেল ডরিগো, কিছুটা মদের গন্ধও। সে বুঝতে পেরেছিল, এ নারী তাকে তেমন পাত্তা না দিলেও অনিবার্য কিছু একটা ঘটছিল তাদের মধ্যে।
নিজের হাত দুটো পেছনে নিয়ে দাঁড়াল ডরিগো। তাদের মাঝবরাবর জানালা দিয়ে আসা আলোর চিকন একটা রেখা বয়ে যাচ্ছিল, সেই আলোকরশ্মিতে ধুলোর ছড়াছড়ি। ডরিগো হেসে কিছু একটা বলল, যার অর্থ সে নিজেই জানত না।
আপনি কোন ধরনের সৈনিক, নারীর প্রশ্ন।
ঠিক সে রকমটা নয়।
পরনের জ্যাকেটের গায়ে সেঁটে থাকা ত্রিকোনাকৃতির বাদামি অংশটার ভেতর সবুজ বৃত্তময় অংশটা চাপ দিয়ে দেখাল ডরিগো।
২/৭ কজাল্টি ক্লিয়ারিং স্টেশানের একজন চিকিৎসক আমি।
চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও এক নারীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব অপ্রস্তুত লাগছিল তার।
আপনি বইয়ের দোকানে এসেছেন কেন? ডরিগো হঠাৎ প্রশ্ন করল নারীকে।
বইয়ের দোকানের নিচতলায় আজ একটি সাময়িকীর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে আমি ও আমার বান্ধবী টিপি এখানে এসেছি। তা ছাড়া মোড়ক উন্মোচন শেষে এক কবি তাঁর কবিতা পড়বেন। আপনি শুনলে অবাক হবেন, এখানে আসার সময় টিপি ও তার বন্ধুরা পল রবসনের মতো করে গাইছিল ওল্ড হর্স রাউলি...।
ডরিগো ইতস্তত হয়ে বলল, আমি তাহলে এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছি।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে? না, না। এমন ভাবার কারণ নেই। আমার মনে হয়, একটু চিন্তাশীল সবাইকেই দোকান-কর্তৃপক্ষ স্বাগত জানায়। নারী এবার তার বান্ধবীকে দেখে হাত নেড়ে বললেন, টিপি বলছিল, আজ কবিতা পড়বেন যে কবি তিনি নাকি অস্ট্রেলীয় সাহিত্যে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছেন।
এ সময় দেখা মিলল টিপির। সবাইকে আসতে বলছিল সে। টিপি চাইছিল, আমরা যেন ম্যাক্সকে শুনতে যাই।
ম্যাক্স কে? জানতে চাইল ডরিগো।
কবি, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আর যে রাউলির কথা বললেন সে কে?
একটা ঘোড়া, এটাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ওই নারীর কথার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না—কবি ও ঘোড়া কোনোটিই যদি গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ আসলে কী? এ নারী কী চান? মনে মনে ডরিগো চাচ্ছিল, এখান থেকে তিনি যেন চলে যান।
হঠাৎ পুরুষের কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরল ডরিগো। দেখল, হালকা নীল পোশাকের এক আরএএএফ কর্মকর্তা তার সঙ্গে যেতে বলছে নারীকে। এতক্ষণ নারীর চোখেমুখের যে উৎফুল্লতা, কর্মকর্তার কথায় মুহূর্তেই ফিকে হয়ে গেল সেটি।
তবে যাওয়ার আগে তিনি বললেন, ডরিগোকে শেষ প্রশ্নটি এখনো করা হয়নি তাঁর।
কী প্রশ্ন?
কী প্রশ্ন তা আমি নিজেও এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
এ নারী কি তাকে নিয়ে খেলছে? ভয় পেল ডরিগো।
ডরিগোর হাতের বইটির দিকে তাকিয়ে নারী বললেন, কী বই?
ক্যাটুলাস, ডরিগো বলল।
সত্যি ক্যাটুলাস? হাসতে হাসতে বললেন তিনি।
ডরিগো ইভান্স এই নারীর হাত থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছিল, তবে কোনোভাবেই পারছিল না—সেই চোখ, লাল ফুল, হাসি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তাকে।
এর মধ্যে লুক্রেটিয়াস, হেরোডোটাস ও ওভিদ সম্পর্কে লেখা এমন একটি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ডরিগো। পেছন থেকে এসে তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন নারী, কার বই দেখছেন?
একজন রোমান কবির, মৃদু কণ্ঠে বলল ডরিগো।
সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী তাকে বললেন, আমাকে ওই কবির একটা কবিতা পড়ে শোনান তো। সে আবার খুলল বইটি, আপনি নিশ্চিত যে আপনি আমার কবিতা পড়া শুনতে আগ্রহী?
অবশ্যই।
বইয়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে পড়তে থাকল ডরিগো—আমার আলখাল্লা আর শরীর-ত্বকের মাঝখানে/ অনুভূত হলো প্রবল কম্পন।’
দুই লাইন পড়ার পরই নারী বললেন, ল্যাটিন ভাষা আমি কম বুঝি। ডরিগো বলল, আমিও। এ সময় মনে মনে সে ভেবেছিল, কবিতা শোনানোর সময় মৃদু অবজ্ঞা বা অপমান করবে নারীকে। কিন্তু কবিতার দু-লাইন পরই ওই নারীর আগ্রহ ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।
আবার হাসলেন নারী। ডরিগোর উদ্দেশে বললেন, আপনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছিল আপনি প্রেমের ভান করছিলেন। এ মন্তব্যে রীতিমতো বিস্মিত ডরিগো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কারও সাহায্যের আশায়। কিন্তু সেখানে কেউই নেই।
নারী তাকে বললেন, আবার পড়ুন।
সে পড়তে থাকল পুনরায়—আমাদের বাঁচতে ও ভালোবাসতে দিন/ এবং চল আমরা বুড়োদের বাড়াবাড়িকে মূল্য না দিই/ কারণ তারা কেবল অকারণ জ্ঞান দেন ও সবকিছুকে করেন অগ্রাহ্য।/ ডুবন্ত সূর্যও জেগে ওঠে আবার,/ কিন্তু আমরা—
মনে মনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল ডরিগোর। কেন সে অপরিচিত এক নারীকে কবিতা পড়ে শুনাচ্ছিল! এমন কী অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা বেঁধে রেখেছিল তাকে যে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারছিল না সে; বুঝতে পারছিল না কোন বাঁধায় আটকে ছিল তার কণ্ঠ!
নারী তার বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর সাহায্যে নিচ থেকে টেনে তুললেন তার ব্লাউজের ওপরের অংশ। তবে এ সময় ডরিগোর দিকে তাকিয়ে থাকা তাঁর চোখজোড়া বলে দিচ্ছিল, তিনি যেন ব্লাউজের ওই অংশটুকুর নিচে নেমে থাকাকেই পছন্দ করছিলেন বেশি।
বই বন্ধ করল ডরিগো। তার মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল অনেক কিছুই। সেসব চিন্তার আংশিক নিষ্পাপ, আংশিক পাশবিক। তবে এর মধ্যে কোনটির প্রকাশ ঘটানো উচিত তা জানা ছিল না তার। ডরিগোর অনেক চিন্তাই ছিল রূঢ় কিন্তু জরুরি।
এসবের কোনো কিছুই না বলে হঠাৎ নারীকে সে বলল, আপনার চোখগুলো...।
অকস্মাৎ শোনা গেল এক আগন্তুকের গলা, আমরা কথা বলছিলাম অর্থহীন ভালোবাসা কী, তা নিয়ে। ডরিগো একটু ঘুরে তাকিয়ে দেখল, আগন্তুক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগন্তুক বলল, বেশির ভাগ মানুষই ভালোবাসাহীন জীবনযাপন করে। ডরিগো, তুমি কি আমার সঙ্গে একমত?
আমি জানি না, উত্তর দিল ডরিগো। বন্ধুটি হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব শুনছিলেন নারী। ডরিগোর বন্ধুকে পাশ কাটানোর জন্য তিনি বললেন, আপনারা থাকুন, আমি এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি। তাঁর কথায় স্পষ্ট হলো, এক মিনিট পর যদি বন্ধুটি চলে যায় তবে আবার ডরিগোর সঙ্গ পাবেন তিনি।
তাঁর নীরব অথচ সুস্পষ্ট মনোভাব বুঝতে পেরেছিল ডরিগো; কিন্তু এতে তার বিন্দুমাত্র সায় ছিল না।
এদিকে ভালোবাসা নিয়ে বিরামহীনভাবে নিরর্থক কথা বলে যাচ্ছিল ডরিগোর বন্ধু, ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই, ভালো বিবাহের ভিত্তি হলো মানিয়ে চলা, এটা স্বাভাবিক যে দুটো বিপরীত লিঙ্গের মানুষ আকর্ষণ বোধ করে একে অন্যের প্রতি। তাই বলে এটি কিন্তু ভালোবাসা নয়।
তবে এটি কি? জিজ্ঞেস করল ডরিগো।
বন্ধুটি জানাল, আকর্ষণশক্তি।
রিচার্ড ফ্ল্যানাগানের উপন্যাস দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ডিপ নর্থ-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের অংশবিশেষের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ