ফিকশন লেখা মানে পাঠককে নিজের গণ্ডি থেকে অন্যের জীবনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া

অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সি উপন্যাসটির জন্য এ বছর ফিকশন বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকান লেখক অ্যান্টনি ডুয়ার। ভিন্নধর্মী গঠনশৈলীর জন্য উপন্যাসটি আলোচনায় এসেছিল গত বছরই। এ উপন্যাস প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা দ্য রাম্পাস-এর জন্য ন্যান্সি স্মিথের নেওয়া অ্যান্টনি ডুয়ারের এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন তুষার তালুকদার

অ্যান্টনি ডুয়ার
অ্যান্টনি ডুয়ার

ন্যান্সি স্মিথ: আগের যেকোনো লেখার চেয়ে আপনার অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সি আলাদা। এ উপন্যাসের আঙ্গিককাঠামো সত্যিই চমকপ্রদ। উপন্যাসটির ভিন্নধর্মী গঠনশৈলী সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
অ্যান্টনি ডুয়ার: প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। মাসের পর মাস অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সির গঠনশৈলী নিয়ে ভেবেছি আমি। ছোট ছোট বিষয়কে একত্র করার চেষ্টা করেছি। ২০০৫ সালে ‘ভিলেজ ১১৩’ নামের একটি ছোটগল্প লেখার সময় এমনটি করেছিলাম—একটি ছোটগল্পের ভেতর কয়েকটি ভাগ ও প্রতিটি ভাগের একটি করে শিরোনাম। পরবর্তী সময়ে মেমোরি ওয়াল উপন্যাস লেখার সময়ও অনুসরণ করি এ ধরনটি। অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সি উপন্যাসটিও আমি একই ধারায় বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। বলতে পারেন নিজের সুবিধার্থে উপন্যাসটিকে ভাগ করেছি ছোট ছোট অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায় আবার বারবার পড়ে পরিমার্জনা করেছি। বুকপকেটের মতো এই অধ্যায়গুলো আমাকে লাইনচ্যুত হতে দেয়নি। নিজের ইচ্ছেমতো আমি এসব ছোট অধ্যায়ের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংক্ষেপণ করতাম, যা টানা গদ্যে লেখা কিংবা অধ্যায়হীন একটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। এককথায়, আমি কোনো গতানুগতিক বর্ণনাকৌশল অনুসরণ করতে চাইনি।
অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সিতে দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র—ম্যারি ও ওয়ের্নার। একেকটি অধ্যায়ে গল্প বলেছে একেকজন। গতানুগতিক উপন্যাসে একজনের গল্প বলা শুনতে শুনতে পাঠক একঘেয়ে বোধ করেন। তাই আমি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন জনের মুখে গল্প শোনাতে, যাতে পাঠক বিরক্ত বোধ না করেন।

.
.

স্মিথ: যদি ভুল শুনে না থাকি, তবে জানি অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সি লিখতে আপনার ১০ বছর সময় লেগেছিল। এ দীর্ঘ সময়ে কখনো কি মনে হয়েছে উপন্যাসটি শেষ করা সম্ভব হবে না?
ডুয়ার: ঠিক বলেছেন, পুরো ১০ বছর সময় লেগেছে। কম করে হলেও পাঁচবার ভেবেছি, উপন্যাসটির ইতি টানা দুরূহ হবে। বারবার মনে হচ্ছিল, আমি খুব জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিলাম। প্রথমত, এতে কোনো আমেরিকান চরিত্র নেই। তা ছাড়া গল্প নির্মাণের প্রাথমিক সব তথ্য-উপাত্ত ছিল ভিন্ন ভাষায় লেখা, যা আমি পড়তে পারি না। তবুও আশা ছাড়িনি। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছি। ধরুন, কোনো সমস্যার কারণে আজকের দিনটি আপনার খুব বাজে কাটতে পারে, কিন্তু আগামীকাল ঘুম থেকে জেগে আপনি অবশ্যই সমস্যা সমাধানের কোনো না কোনো উপায় খুঁজে পাবেন। আমি এভাবেই একটু একটু করে এগিয়েছি।
স্মিথ: উপন্যাসটিতে সেইন্ট-ম্যালোর ভূপ্রকৃতির অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন আপনি। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন? একটি বিশেষ সময় ও স্থানকে একই সমান্তরালে আনতে চেয়েছেন কেন?
ডুয়ার: প্রথম দেখাতেই আমি সেইন্ট-ম্যালো শহরটির প্রেমে পড়ে যাই। রাতের বেলায়, ভাটার সময় শহরের প্রান্তঘেঁষা প্রাচীর ধরে হাঁটছিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি, নতুন জায়গার সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, পরপর তিন গ্লাস ফরাসি মদপান ও সমুদ্রপাড়ের বাতাস—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন আমি কল্পনার কোনো নগরে আছি কিংবা স্বপ্ন দেখছি। আমার কাছে মনে হলো, এ নগরে যতখানি বাস্তবতা, ঠিক ততখানিই আছে কল্পনা। ভাবলাম, আমার উপন্যাসের কল্পনার অংশটুকু বর্ণনার জন্য এমন একটি শহরের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।
স্মিথ: কিন্তু এটি তো সত্যি যে কিছু ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা আপনার উপন্যাসটির মূল জায়গা দখল করেছে। বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে সাযুজ্য স্থাপন করলেন কীভাবে?
ডুয়ার: আমি তিনবার ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। অনেক বই পড়েছি। গবেষণা করেছি বহু স্থিরচিত্র নিয়ে। গবেষণা আপনাকে কোনো কিছু সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানতে সাহায্য করে কিন্তু ওই সব জানা বিষয়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সহায়তা করে কল্পনা। আমার কাছে ঐতিহাসিক ফিকশন লেখা মানে নিজের পড়াশোনা, ভ্রমণ, পর্যবেক্ষণ, কল্পনা এবং স্বপ্নের মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয় সাধন করা।
স্মিথ: আপনার লেখালেখিতে বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়, প্রযুক্তিবান্ধব যেকোনো বিষয় খুব যত্ন নিয়ে ব্যাখ্যা করেন আপনি। যেমন এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রেডিও। রেডিওর ব্যবহার বর্তমান সময়ে আপনাকে কীভাবে আগ্রহী করে তুলল?
ডুয়ার: বিশ শতকের প্রথম ভাগের তিনটি আবিষ্কার—রেডিও, উড়োজাহাজ ও অ্যাটম বোমা আমাকে বিশেষভাবে ভাবায়। রেডিওর মাধ্যমে কীভাবে থার্ড রাইখের সময় নাগরিকদের মধ্যে ভয়ভীতি, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হতো এবং কেমন করে এ যন্ত্রটির মাধ্যমে রাজনীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করল—এ দুই বিষয় আমার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। এ ছাড়া আমি দেখাতে চেয়েছি, যেভাবে বর্তমানে ট্যাবলয়েড কিংবা স্মার্টফোন বাচ্চাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও বাচ্চাদের ওপর ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এককথায়, আমি এমন একটি সময়ের চিত্র আঁকতে চেয়েছি, যখন রেডিওতে একজন আগন্তুকের কণ্ঠস্বর নিজের কানে বেজে ওঠা ছিল অতি আশ্চর্যের বিষয়।
স্মিথ: উপন্যাসের গঠনশৈলী ও অধ্যায়গুলোর সঙ্গে সময়ের একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। গল্প এগোলে সময় এগোয়, আবার গল্প অতীতে বাঁক নিলে সময়ও তৈরি করে অতীত আবহ। ফলে সময় নিয়ে পাঠককে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় না। অল দ্য লাইট উই ক্যাননট সি-তে সময়ের ভূমিকা কী, তা যদি বলেন...
ডুয়ার: সমসাময়িক পাঠকেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন। হিটলারের জীবন-যৌবন, নরম্যান্দিদের আক্রমণ, হলোকাস্ট, জার্মানির পরাজয়, বিপুল মানুষের প্রাণহানি এবং ফ্রান্সের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে জার্মানদের চিরবিদায় প্রভৃতি পাঠকদের জানা। তাই উপন্যাসটি আমি শুরু করেছি একটু পেছন থেকে—১৯৪৪ সালের ঘটনা দিয়ে শুরু। ফিরে গিয়েছি ম্যারি ও ওয়ের্নারের শৈশবকালে। সেইন্ট-ম্যালোর অবরোধকালে ম্যারি ও ওয়ের্নারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে অবধি পাঠককে নিয়ে যেতে কয়েক শ পৃষ্ঠার বিবরণ দিয়েছি। কারণ, এরপর যুদ্ধকালে কী ঘটেছিল, তা সবার কমবেশি জানা।

.
.

স্মিথ: উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র ম্যারি-লরি চোখে দেখতে পায় না। অথচ তার বয়ান আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরে নানা দৃশ্য। মনে হয়, হাত বাড়ালেই সেসব স্পর্শ করা যাবে। ক্ষেত্রবিশেষে ইন্দ্রিয়লব্ধ বস্তুর আবেদন খালি চোখে দেখা কোনো বস্তুর চেয়ে বেশি। ম্যারির ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা বর্ণনায় আপনি কি কৌশল অবলম্বন করেছেন?
ডুয়ার: আমার কাছে ফিকশন লেখা মানে পাঠকদের তাঁদের নিজের জীবনের গণ্ডি থেকে অন্যের জীবনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া। আমার প্রিয় লেখক ফ্লবার্ট, তলস্তয়, উলফ, করম্যাক ম্যাকার্থি—এঁরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়াবলি বর্ণনায় কুশলী ছিলেন; সেই সূত্রে বলি, এর কারণ একটাই—অন্যের অনুভূতিকে নিজের করে নেওয়া। ম্যারির চরিত্র নির্মাণে আমি সরাসরি দৃশ্য বর্ণনার ওপর জোর দিইনি, বরং প্রাধান্য দিয়েছি ঘ্রাণশক্তি, শব্দশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে। এ শক্তিগুলো ব্যবহারের ফলে পাঠকের মধ্যে এমনিতেই একটা দৃশ্যপট তৈরি হয়।
স্মিথ: শেষ প্রশ্ন—যত দূর জানি, এ বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম—‘আপনি কি চান না মৃত্যুর আগে জীবিত থাকতে?’ বিষয়টি নিয়ে পাঠকদের কি কিছু জানাতে চান?
ডুয়ার: আমার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন আমার মা। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি যে স্কুলে পড়াতেন, আমি ছিলাম সেখানকার ছাত্র। টয়লেট পেপার ভাঁজ করা থেকে জীবন চালাতে যাবতীয় সবকিছু আমাকে শিখিয়েছেন তিনি। জীবনে সব ছোটখাটো জিনিসকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা জীবনকে নতুনভাবে চিনতে শিখিয়েছে আমায়। আমি মনে করি, পৃথিবীর বয়স নেহাত কম নয়। মানুষ নামের প্রজাতি ছাড়া বাকি ৯৯ ভাগ প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। মানবজাতি যে বিলুপ্ত হবে না, এমনটি ভাবা বোকামি। আমরা অল্প কিছুদিনের জন্য পৃথিবী নামের গ্রহে আছি। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না। সুযোগ আমাদের একটিই—জীবনকে দেখার, মানুষকে সাহায্য করার ও যতটুকু সম্ভব সবকিছুকে ভালোবাসার এবং এটিই আমার সব কাজের মূল প্রেরণা।