কদর্যদের রাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুজনেই ছিলাম কুৎসিত। যদিও মামুলি রকমের কুৎসিত। মেয়েটির গালের হাড় ছিল বসে যাওয়া। আট বছর বয়স থেকে, যখন তার একটা অপারেশন হয়। আমার মুখের পাশে সৃষ্টি হয়েছে বিরক্তিকর একটা দাগ, এটা হয়েছে আমার শৈশবের শুরুতে, ভয়ানক আগুনে পোড়া থেকে।
এটা বলা যায় না যে আমাদের কারোরই অত নরম দৃষ্টি ছিল, সত্যিকার কুৎসিত লোকেরা যা কখনো কখনো দাবি করে, যখন তারা সুদর্শন কারও কাছাকাছি যায়। না, একেবারেই না। তার এবং আমার—দুজনেরই চোখে ভরা ছিল বিরক্তিভাব, যা এসব দুর্ভাগ্যকে কখনোই মেনে নেয় না বা অল্পই মেনে নেয়, আমরা যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। সম্ভবত এ ব্যাপারটাই আমাদের একত্র করেছে। ‘একত্র’ শব্দটা হয়তো খুব সঠিক নয়, যদি নির্দয় ঘৃণাগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়, যা আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মুখের কারণে পেয়ে থাকি।
আমাদের দেখা হয়েছিল সিনেমা হলের সামনে। পর্দায় সবচেয়ে সুন্দর নারী-পুরুষদের দুজনকে দেখার জন্য আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানেই আমরা প্রথম পরস্পরকে দেখলাম, কোনো করুণা ছাড়াই, তবে এক অন্ধকার সংহতি সহযোগে এবং প্রথম দেখাতেই, আমরা লক্ষ করেছিলাম পরস্পরের নিঃসঙ্গতাকে। সারির ভেতর সবাই ছিল দুজন দুজন করে, সেখানে আসল যুগলেরাও ছিল—স্বামী-স্ত্রী, ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, দাদা-দাদি, ছেলে-বুড়ো এবং ঈশ্বরই জানেন আরও কারা ছিল। প্রত্যেকেই ধরে রেখেছিল কারও না কারও হাত। শুধু তার আর আমার হাত ছিল যার যার পাশে, শিথিল আর মুঠোবদ্ধ।
আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরস্পরের কদর্যতা দেখলাম, নির্লজ্জভাবে, তবে কোনো কৌতূহল ছাড়া। আমি তার গালের কাটা জায়গাটা দেখছিলাম এমন নিপাট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যে আমার গণ্ডদেশ কুঞ্চিত হলো। সে তাতে লজ্জা পেল না। আমি বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা বেশ জটিল। আমার তল্লাশির জবাবে তার অতি সতর্ক চকিত দৃষ্টি আমার দাড়িহীন কোমল চকচকে পুরোনো পোড়া জায়গাটা দেখল।
অবশেষে আমরা ভেতরে গেলাম। বসলাম আলাদা জায়গায়, কিন্তু লাগোয়া সারিতে। সে আমাকে দেখতে পারছিল না, কিন্তু আমি এমনকি সেই অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিলাম তার ঘাড়ের ওপর পড়া পিঙ্গল কেশ, তার সুষম গড়নের নহলী কান। এটা ছিল তার স্বাভাবিক দিকের কান।
১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ধরে আমরা নায়কের উগ্র সৌন্দর্য এবং নায়িকার স্নিগ্ধ কোমলতার প্রশংসা করে গেলাম। অন্তত সৌন্দর্যের প্রশংসায় আমি সব সময়ই সমর্থ। আমার বিদ্বেষকে আমি রেখে দিই নিজের মুখের জন্য এবং কখনো কখনো ঈশ্বরের জন্য আর অন্য কাকতাড়ুয়াদের কদর্য মুখের জন্য। আমার হয়তো দুঃখিত হওয়া উচিত, কিন্তু আমি পারি না। সত্যটা হলো, কদর্য মুখগুলোকে মনে হয় আমার দর্পণ। মাঝেমধ্যে ভাবি, নার্সিসাস-পুরাণের কী ঘটত যদি তার থাকত বসে যাওয়া গালের হাড়, কিংবা অ্যাসিডে পুড়ত যদি তার গাল বা যদি না থাকত তার নাকের অর্ধেকটা কিংবা যদি সেলাই থাকত তার কপালের ওপর।
আমি তার জন্য অপেক্ষা করলাম দরজায় এবং তারপর তার দিকে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম। যখন সে থেমে আমার দিকে তাকাল, বুঝলাম সে ইতস্তত করছে। কিছুক্ষণ আলাপ করার জন্য আমি তাকে আমন্ত্রণ জানালাম কোনো একটা ক্যাফে বা কনফেকশনারিতে। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।
কনফেকশনারিটি ছিল লোকজনে ভরা, কিন্তু ঠিক তখনই একটা টেবিল খালি হলো। যখন আমরা সবার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের পেছনে ছিল বিস্ময়সূচক ইঙ্গিত আর অঙ্গভঙ্গি। আমার অ্যান্টেনা বিশেষভাবে উপযোগী করে তোলা এ রকম দুর্বৃত্ত কৌতূহলগুলোকে ধরার জন্য, যা সেসব লোকের এক অবচেতন মর্ষকামিতা, যাদের চেহারাগুলো অদ্ভুতভাবে একই কিসিমের। কিন্তু এবার এমনকি আমার চর্চা করে গড়ে তোলা উপলব্ধি ব্যবহার করার দরকারই পড়ল না, কারণ আমি পরিষ্কারভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম তাদের ফিসফাস, চাপা হাসি আর মিথ্যা গলা খাকারিগুলো। একটি ভয়ংকর মুখ, নিজেই একটা কৌতূহলের বিষয়, কিন্তু একসঙ্গে দুটি কুৎসিত মুখ নিজেরাই একটা বিশদ দৃশ্যের অবতারণা করে, কেবল কিছুটা যা কম সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কিছু বিষয়কে এক সঙ্গেই দেখা উচিত, এ রকম নারী বা পুরুষের সঙ্গে অন্যদের, যারা সুদর্শন ও জগতের মূল্যবান অংশ।
আমরা বসলাম এবং আইসক্রিমের অর্ডার দিলাম। সে সাহস করে (আমি এর প্রশংসাই করি) তার হাত-ব্যাগ থেকে একটা আয়না বের করে তার চুল ঠিক করতে লেগে গেল। তার সুন্দর চুল।
‘তুমি কী ভাবছ?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
সে আয়না নিয়ে ব্যস্ত থাকল আর হাসল। তার গালের গর্তটা আকৃতি পাল্টাল।
‘একটা সাধারণ জায়গা...সব একই রকম’, বলল সে।
আমরা কথা বললাম দীর্ঘ সময় ধরে। দেড় ঘণ্টা চলে গেল, এবং আমাদের দুই দফা কফির অর্ডার দিতে হলো এত সময় ধরে বসে থাকাটা বৈধ করতে। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম সে এবং আমি অকপটভাবে এমন সব দুঃখজনক কথাবার্তা বলছি, যা আন্তরিকতা বিনষ্ট করতে পারে এবং আলাপ এমন অবস্থায় পৌঁছাল, যা ভণ্ডামির সমতুল্য। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়ব।
‘তুমি দুনিয়া থেকে নিজেকে বহিষ্কৃত ভাবো, তাই না?’
‘হ্যাঁ’, সে বলল, আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে।
‘তুমি সুদর্শনদের প্রশংসা করো, যারা স্বাভাবিক। এমন একটা মুখ তুমি চাও, যেটা তোমার ডানদিকে বসা মেয়েটির মতো সুন্দর, অথচ তার হাসিটাকে যদি তুমি বিবেচনায় আনো, সে স্রেফ একটা মূর্খ।’
‘হ্যাঁ।’
প্রথমবারের মতো আমি আমার চাহনি ধরে রাখতে পারলাম না।
‘আমি তা পছন্দ করি। কিন্তু একটা সম্ভাবনা আছে, তুমি জানো, তুমি আর আমি কিছু হওয়াতে পারি।’
‘যেমন?’
‘প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো, চুলায় যাক! বলতে পারো, স্রেফ একসঙ্গে থাকা। ব্যাপারটাকে যেভাবেই দেখো, কিছু একটা সম্ভাবনা আছে।’
সে ভ্রুকুটি করল, ‘আমি কোনো আশা দেখি না।’
‘কবুল করো যে, তুমি আমাকে খামখেয়ালি লোক হিসেবে নিচ্ছ না।’
‘সম্ভাবনা হলো রাতের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া। সারা রাত ধরে—সর্বাত্মক আঁধারে। বুঝতে পারছেন?’
‘না।’
সে লজ্জা পেল, তার গালের ফাটল হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে গেল।
‘আমি একটা বাসায় একা থাকি, কাছেই।’
আমি মাথা তুললাম এবং মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার সম্মতির চিহ্ন খুঁজলাম, বেপরোয়াভাবে চেষ্টা করলাম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে।
‘চলো,’ আমি বললাম।

২.
আমি কেবল যে আলো নেভালাম, তা-ই না, দু-ফর্দ পর্দাও টেনে দিলাম। মেয়েটি আমার সামনে শ্বাস নিচ্ছে; তবে উত্তেজিত ধরনের নিশ্বাস নয়। সে চাইল না যে আমি তার পোশাক খুলতে সাহায্য করি।
আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিছুই না। তবে উপলব্ধি করলাম, সে একদম নিশ্চল, অপেক্ষা করছে। আমি সাবধানে হাত চালালাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না খুঁজে পেলাম তার স্তন। এই স্পর্শ আমার লিঙ্গকে দিল উল্লাসভরা শক্তিময় জাগরণ। অতঃপর আমি দেখলাম তার পেট, তার যৌনতা। তার হাতগুলোও স্পর্শ করল আমাকে।
আমাকে আমার সাহসের সবটা সঞ্চয়ই ব্যবহার করতে হলো, তবে আমি সেটা করলাম—আমার হাত ধীরে ধীরে তার মুখের কাছে উঠে গিয়ে খুঁজে পেল কদাকার ক্ষতটিকে এবং ধীরে ধীরে সেটাকে আদর করতে থাকল—স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে। আসলে আমার আঙুলগুলো (প্রথমে সামান্য কম্পিত ও পরে আস্তে আস্তে প্রশমিত) অনেক বার পার হয়ে গেল তার অশ্রুকে।
তারপর তখন আমি খুব একটা প্রত্যাশা না করলেও, তার হাতও স্পর্শ করল আমার মুখ, এবং সেখানে গিয়ে অনুভব করল মুখের ক্ষত আর মসৃণ ত্বক—দাড়িবিহীন এই দ্বীপ, আমার অশুভ চিহ্নটিকে।
সকাল হওয়া পর্যন্ত আমরা কাঁদলাম; দুজনেই অসুখী ও সুখী। তারপর জানালা থেকে আমি সরিয়ে দিলাম দু-ফর্দ পর্দা।

মারিও বেনেদেত্তি
মারিও বেনেদেত্তি
মারিও বেনেদেত্তি
ইতালীয় বংশোদ্ভূত উরুগুয়ের কথাসাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক মারিও বেনেদেত্তি (১৯২০-২০০৯)। স্প্যানিশভাষী দেশগুলোর বাইরে অচেনা হলেও, তিনি লাতিন আমেরিকায় গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে স্বীকৃত। উরুগুয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্য আন্দোলন ৪৫-এর প্রজন্মের সদস্য ছিলেন। উরুগুয়ে যখন সিভিল মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের শাসনে চলে যায়, তখন তাঁকে নির্বাসনে যেতে হয়, প্রথমে বুয়েনস এইরেসে, তারপর পেরুর লিমায়। কিউবা ও মাদ্রিদে কাটিয়েছেন অনেকগুলো বছর। ১৯৮৩ সালে উরুগুয়েতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর দেশে ফেরেন বেনেদেত্তি। জার্মান ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন কাফকার রচনা। তাঁর ছোটগল্পের বইগুলোর মধ্যে আছে: রক্তসন্ধি ও অন্যান্য গল্প, হয়তো অপূরণীয়, ইউবারলিংগেনে লিখিত, স্বর্গের রাজত্ব, ভালোবাসার একটি চিঠি ও কদর্যদের রাত। ‘কদর্যের রাত’ নামে অনূদিত এই গল্পটি ‘লা নোচে দে লস ফেওস’ গল্পের অনুবাদ।