পরাবাস্তবতার জাল দিয়ে ঘেরা

নাসরীন জাহানের ১৫টি ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে এ টেম্পোরারি সোজার্ন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ নামে এই গল্প সংকলনটি প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। বইটি সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক নিয়াজ জামান। সংকলনে যে অনূদিত গল্প স্থান পেয়েছে, তার কিছু কিছু আগেই অনূদিত হয়েছিল, তবে সিংহভাগই নতুন অনূদিত।

এ টেম্পোরারি সোজার্ন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ
এ টেম্পোরারি সোজার্ন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ
এ টেম্পোরারি সোজার্ন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ
নাসরীন জাহান
অনুবাদ: নিয়াজ জামান
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান
প্রকাশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
নভেম্বর ২০১৫
১৩০ পৃষ্ঠা
দাম: ৪০০ টাকা।

মূলত উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য খ্যাত হলেও নাসরীন জাহান প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন, সেই ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিক থেকেই তিনি সাহিত্যের এই শাখায় বিচরণ করছেন। শক্তিশালী নারীবাদী লেখক হলেও নাসরীন শুধু নারীর জীবনের মধ্যেই তাঁর ছোটগল্পকে সীমাবদ্ধ করেননি, যে পুরুষেরা বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার, তারাও তাঁর ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছেন নানা রঙে। ফলে তাঁকে শুধু নারীবাদী লেখক বলা যাবে না।
বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার এক জাল তৈরি হয় তাঁর ছোটগল্পে—এ সংকলনেও পাঠক সেই স্বাদ পাবেন নিঃসন্দেহে। জীবনের নানা রূপকে দেখার এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা আছে নাসরীন জাহানের; কোনো গণ্ডিতে নিজেকে সীমিত রাখেননি তিনি। ফলে দেখা যায়, তিনি যেমন খোঁড়া তরুণের (‘ম্যানহুড’, বাংলায় ‘পুরুষ’) প্রাণপণে নিজেকে পুরুষ প্রমাণের চেষ্টার গল্প বলেছেন, তেমনি শহরের সংগ্রামমুখর নারীর (‘হাউ ডু আই লুক, রিয়েলি?’—‘আমাকে আসলে কেমন দেখায়’) গল্পও বলেছেন। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো যেন প্রতিনিয়ত মানবীয় সীমাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করছে। গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা আছে তাঁর, সে কারণে সমাজের এসব অবাঞ্ছিত মানুষের গল্প সংবেদনশীল মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে, তার মধ্যে জীবনের কদর্য দিকগুলোই যেন বেশি বেশি করে উঠে এসেছে, ওই মানুষগুলোর জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি, যেন পঙ্কের মধ্যেই নিমজ্জিত তাদের জীবন। এই বইয়ের গল্পগুলোতে ওই মানুষের জীবনের সার্থক চিত্রায়ণ হয়েছে, সেটাই বড় কথা—সাহিত্যের মাহাত্ম্য তো ঠিক সেখানেই।
লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। সেই জাদুর ছোঁয়া দেখা যায় ‘ভালচার’ গল্পে, যার মূল বাংলা নাম ‘প্রতিপক্ষ শকুনেরা’। এ গল্পের দরিদ্র গরুচোর কুতুবউদ্দিন রাতের বেলা গ্রামের তালুকদারের পুকুরের মাছ চুরি করতে গেলে সে হঠাৎ করে তালুকদারের গলা খাঁকারির শব্দ শোনে, মধ্যরাতে সেই শব্দ শুনে নিঃস্ব কুতুব জাল ফেলে প্রাণপণ দৌড়ায়। এ শব্দ বাস্তব নয়, জাদুর শব্দ, তবে সেটা তাঁর বিবেকের শব্দ, বাধ্য হয়ে চুরি করতে গিয়েও বিবেকের তাড়নায় সে ঠিকমতো চুরিও করে উঠতে পারে না—এ যেন তার নিজের সঙ্গে লড়াই। বিবেক এখানে জাদুর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছে।
এটি তাঁর গল্পের ইংরেজি অনুবাদের সংকলন। ফলে এটা পাঠ করলে বাঙালি পাঠক মূলের স্বাদ পাবেন না, সেটা পেতে হলে মূল বাংলা গল্পই পড়তে হবে। সু-অনুবাদক নিয়াজ জামানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের একদল অনুবাদক এই গল্পগুলো অনুবাদ করেছেন। তবে নিয়াজ জামানের সম্পাদিত এই বইয়ে ইংরেজি ভাষার পাঠকেরা নাসরীন জাহানের গল্পের পরিসরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন, তাঁর গল্পের ঢংয়ের স্বাদ পাবেন, সেটা বলা যায়।