স্টেপ সান

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

তাঁকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে মানুষ। বিশেষ করে তাঁর স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার পর। ড. রাফিয়া কি জানেন তা? তাঁকে দেখলে বোঝা যায় না কিছু। তাঁকে অবশ্য আমি খুব ভালো করে দেখেনি কখনো। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে বহু কথা শুনেছি। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুধু তাঁকে দেখতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসত আমার বন্ধুরা। সেই তিনি হঠাৎ করে বিয়ে করেছিলেন তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক ব্যবসায়ীকে। কলেজে পড়া ছেলে আছে এমন একজন বুড়ো বিপত্নীককে কেন তিনি বিয়ে করলেন? এই দুঃখ বুকে নিয়ে পারলে সমাবেশ ডাকে তখন ছাত্ররা।
সেই ড. রাফিয়ার সঙ্গে আমি যাব বিদেশে! আমি সমুদ্রের অল্প পানিতে দাপাদাপি করা মানুষ। হঠাৎ এক আকাশছোঁয়া ঢেউ যেন ধেয়ে আসছে এখন এটা জানার পর। কিন্তু আমার এত উত্তেজনার আসলে কোনো কারণ নেই। তিনি আমাকে চেনেন না। চেনার কথাও না। আমি পড়াশোনা শেষ করে মাত্র যোগ দিয়েছি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। শরণার্থী নিয়ে কাজ করার জন্য সুনাম আছে এদের। ড. রাফিয়া সেখানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। আমাদের অফিসে আসেন কালেভদ্রে। আমাকে তাই তাঁর দেখার কথা নয়। তা ছাড়া চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরপরই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে। সেখানে আমার খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হয়েছে। মশার কামড়ে হাত-পায়ের মাংস খুবলে গেছে। আমার ধারণা, সেখানকার মশাদের দাঁত আছে। তারা হুল ফোটায় না, কামড়ে ধরে। না হয় এই অবস্থা হয় আমার!
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার পর রিপার সঙ্গে একদিন দেখা করতে গেছি। আমাকে দেখে সে বলে, ‘তোমার প্রোফাইলের এই দশা কেন!’ সে আজকাল কথা বলে যোগাযোগপ্রযুক্তির ভাষায়। আমাকে কেটি পেরি বা কটকটি—কী একটা নামের গানের ডিভিডি কিনে আনতে বলেছিল একদিন। ভুলে গিয়েছিলাম বলে সে মহা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘তোমার র‍্যাম এত কম কেন? আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। সে তখন ঠোঁট উল্টে বলে, ‘প্রসেসরও তো স্লো তোমার!’

আমি মনে মনে বলি, আর তুমি কী! তোমার তো মাথায় গোবর। এমন গোবর যে সেখানে এক দিনে পাঁচ শ কাঁঠাল ধরবে। তাকে সেদিন মুখে কিছু বলার সাহস হয়নি। শরণার্থী নিয়ে আমার মাঠপর্যায়ে গবেষণাটা খুব প্রশংসা পেয়েছে, সেটাই শুধু তাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। সে ভালো-মন্দ কিছু বলেনি। নাক দিয়ে অঃ জাতীয় একটা শব্দ করে ক্লাস আছে বলে চলে গিয়েছিল।

ঢাকা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন শেষ করে আমি মাত্র ভেতরে ঢুকেছি। তখনই আমার হঠাৎ এসব কথা মনে পড়ে। তখনই কেন যেন আমার মনে হলো, অঃ জাতীয় শব্দটার মানে ছিল অবজ্ঞা। পুরোপুরি অবজ্ঞা!

তার অবজ্ঞায় অবশ্য কিছু আসে-যায় না! মিয়ানমারে শরণার্থী নিয়ে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে একটা। সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছি আমি। তা–ও আবার ড. রাফিয়ার মতো বিখ্যাত একজনের সঙ্গে। প্লেন ভাড়া, ফাইভ স্টার হোটেল—সব ফ্রি। সে যদি জানত তা!—‘শালা!’—কাকে যে আমি গালি দেই মনে মনে। শালা বলেছি যখন, তখন নিশ্চয়ই রিপা না। কিন্তু গালিটা তাকেই আসলে দেওয়া উচিত ছিল, হয়তো তাকেই দিয়েছি। তবে তাকে এত ভয় পাই যে এত দূরে থেকেও আমার গালির জেন্ডার পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমি বরং ভয়ে ভয়ে তাকে ফোন করি। তার ফোন এনগেজড!

তাকে আবার ফোন করব, সেই সময় দেখি ড. রাফিয়াকে। ঝলমলে পোশাক, স্টাইলিস্ট সানগ্লাসে তাঁকে একদম অন্য রকম লাগে। একটু থতমত খেয়ে তাঁকে সালাম দিই। মুচকি হেসে উত্তর দেন তিনি। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, ‘আপনি এসডিসিতে আছেন, না?’

 ‘জি।’

 ‘ইয়াঙ্গুন যাচ্ছেন?’

 ‘জি।’ তারপর খামোখাই বলি, ‘আপনি?’

 ‘আমিও যাচ্ছি, আপনার সঙ্গেই।’

এরপর একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি আমাকে বিমানবন্দরে একটা খুব সুন্দর রেস্টুরেন্ট টাইপের জায়গায় নিয়ে যান। পার্স থেকে কার্ড বের করে কাউন্টারের লোককে কী যেন বলেন। তারপর আমার হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে বলেন, ‘নিন।’

আমি অবাক হয়ে তাঁর কাণ্ডকীর্তি দেখি। কত রকম চেহারা থাকে মানুষের! তাঁর স্বামীর আগের ঘরের ছেলে ছিল প্রতিবন্ধী। তাকে নাকি একদম সহ্য করতে পারতেন না ড. রাফিয়া। তাঁর বুড়ো স্বামীর সঙ্গে এ নিয়ে নাকি ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। ঝগড়ার চোটে বেচারা মরেই যায় হঠাৎ!

 মা ছিল না প্রতিবন্ধী ছেলেটার। ড. রাফিয়ার কারণেই হয়তো বাবাকেও হারিয়েছে সে। অথচ এখন ড. রাফিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে স্নেহের সাগর একটা! আমি হাসি মনে মনে।

তিনি আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করেন খাবার নেওয়ার জন্য। আমি বড়শিতে গাঁথা অনিচ্ছুক মাছের মতো তাঁকে অনুসরণ করতে থাকি। এত খাবারের বিল দেবে কে? দেখি তিনি খাবার শেষে বিল না দিয়েই আমাকে নিয়ে বের হয়ে যান। কার্ড দেখালে তাহলে বিল লাগে না! কী কার্ড এটা? রিপাকে কি জিজ্ঞেস করব একদিন?

লিফট দিয়ে নিচে নেমে মোটা এক নারীকে দেখে সোল্লাসে জড়িয়ে ধরেন তিনি। এই ফাঁকে পকেট থেকে ফোন বের করে চেক করি আমি। রিপা আমাকে একটা কলও দেয়নি এতক্ষণে। তার ফোনে মিসড কল অ্যালার্ট আছে, তবু ফোন করেনি।

ইয়াঙ্গুন গিয়ে রিপাকে তাই সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। পিগি নোজ, চ্যাপ্টা চেহারা আর ঢুলুঢুলু চোখের একটা বার্মিজ মেয়ের সঙ্গে খাতির হয়ে যায় আমার। যতটা মুগ্ধ হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়ে তার কাছে নতুন মিয়ানমারের গল্প শুনি। যেমন সে বলে, ‘ইয়াঙ্গুনে বহু নতুন নতুন রাস্তা, উড়ালসড়ক আর বিমানবন্দর হচ্ছে।’

আমি বলি, ‘এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই দেখলাম সব।’

সে বলে, ‘সিঙ্গাপুরের সঙ্গে চুক্তি, যা-ই বানাই, এক বছরে নির্মাণকাজ শেষ।’

আমি বলি, ‘বলো কী! আমাদের দেশে তো বিশ বছরেও শেষ হয় না!’

সে বলে, ‘অং সান সু চি থাকলে মিয়ানমার দশ বছরের মধ্যে ছাড়িয়ে যাবে সিঙ্গাপুরকে।’

আমি বলি, ‘আমার ধারণা, তারও আগে হবে।’

মোটামুটি সে যা-ই বলে, আমি তাতে সাড়া দিই। এমনকি এতই স্বার্থপর হয়ে যাই যে, তার কাছে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গও তুলি না। যদি বিব্রত হয় তাতে।

তবু আমার মুগ্ধতার জালে আটকায় না সে। কনফারেন্সের শেষ দিনে বরং উধাও হয়ে যায়। সারা দিনে কোথাও দেখা যায় না তাকে। আমি অন্য বার্মিজদের জিজ্ঞেস করতে পারতাম। সমস্যা হচ্ছে আমি পিগি নোজের নামই ভুলে গেছি। একবার মনে হয়, তার নাম ছিল মি লাই। কিন্তু বিলাইয়ের সঙ্গে এত মিল কারও নাম হতে পারে কি! মনে হয় না।

লাঞ্চের সময় আমি আঁতিপাঁতি করে খুঁজি তাকে। সে নেই। আমার মনের ক্যানভাসে এত রং ছড়িয়ে সেই ক্যানভাস নিয়ে কোথায় চলে গেল সে হঠাৎ! কনফারেন্স শেষ হলে আমি ক্ষুণ্ন মনে হোটেলের লাউঞ্জে বসে থাকি। হঠাৎ দেখি ড. রাফিয়াকে। তিনি কনফারেন্স নিয়ে মহা ব্যস্ত ছিলেন এই কয়েক দিন। তার মধ্যেও দু-একবার যে আমার খোঁজখবর নেননি তা নয়।

লাউঞ্জে আরও অনেক খালি জায়গা আছে। তিনি এসে তবু আমার সামনের সোফায় বসেন। আরামের দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বলেন, ‘কেমন লাগল আপনার?’

 ‘জি, ভালো।’

 ‘মিয়ানমার কী বদলে গেছে দেখেছেন।’

আমি মাথা নাড়াই।

তিনি সোফার পেছনে মাথা এলিয়ে দেন। স্বগতোক্তির মতো বলেন, ‘কত দিন পর এলাম বিদেশে!’

তাঁর যেন হঠাৎ মনে পড়ে, আমি আছি এখানে। তিনি সোজা হয়ে বসেন। বলেন, ‘তিন মাস পরে বের হলাম।

ছুটিতেও কোথাও যেতে পারতাম না। লকড্, বুঝেছেন, বন্দী হয়ে ছিলাম।’

ড. রাফিয়াকে খুব খুশি খুশি লাগছে। যেন তিনি সত্যি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আমি নিরীহ গলায় বলি, ‘কোনো প্রবলেম হয়েছিল?’

তিনি হাসেন। ফোন করেন কাউকে। কান পেতে শুনে বুঝতে পারি, রমেশ নামে কেউ একজন আসবেন তাঁকে নিতে। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটু আলাপ করছেন আমার সঙ্গে। মূল কনসার্টের আগে বাদ্যযন্ত্র পরীক্ষা করা আরকি!

ড. রাফিয়ার ডেস্কটপে মোটা ঠোঁটের, উদ্‌ভ্রান্ত চেহারার এক তরুণের ছবি। তিনি একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থাকেন। তারপর ধীর গলায় বলেন, ‘আমি রায়ানকে যেতে দিতে চাইনি।’

আমি উদাস চোখে চারপাশে দেখি। মি লাই বা বি লাইয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তাকে না পেয়ে একটু আগে রিপাকে ভাইবারে মেসেজ পাঠিয়েছি, কনফারেন্সে বসা একটা সেলফিও পাঠিয়েছি। সেই সেলফিতে আমার সঙ্গে সাদা চামড়ার দুজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। এত কিছু দেখে তার কি একবারও ফোন করা উচিত না!

ড. রাফিয়া আমার প্রশ্নটা মনে রেখেছেন। ডাকছেন তিনি। আমি অবাক হয়ে তাঁর পাশে গিয়ে বসি। তিনি টাইপ টপস আর ইয়া ঢোলা পাজামা জাতীয় কী যেন পরে আছেন। আমার আরও কাছে সরে এসে তিনি তাঁর ল্যাপটপ গুঁতিয়ে একটা কুকুরের ছবি বের করেন। খুনি টাইপের লোমশ একটা কুকুর। সেই কুকুরের নাম জর্জ বুশ। জর্জ বুশের সঙ্গে তাঁর নানা রকম জড়াজড়ি করা ছবি। ড. রাফিয়া আমাকে জানান, জর্জ বুশ সাহেবের কারণেই তিনি তিন মাস ঘরে বন্দী ছিলেন।

জর্জ বুশ কি কামড়ের ভয় দেখিয়ে তাঁকে এত দিন বন্দী করে রেখেছিল! বুশকে কি তিনি সুযোগ পেয়ে হত্যা করেছেন? আমি মুখ ফসকে বলে ফেলি, ‘বুশ ব্যাটা কি মরে গেছে?’

ড. রাফিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘আরে না না! ও তো লন্ডন চলে গেছে, রায়ানের কাছে। ও তো রায়ানের পেট।’

কিছুই বুঝতে পারি না আমি। আমার বুদ্ধুর মতো চেহারা দেখে তাঁর হয়তো মায়া লাগে। তিনি বুঝিয়ে বলেন যে জর্জ বুশ খুবই আদুরে টাইপের। তাকে স্পেশাল খাবার দিতে হয়, গা আঁচড়ে দিতে হয়, ঘুমানোর সময় মাথায় বিলি কেটে দিতে হয়। তিনি বাসায় লোক রেখে সব ব্যবস্থাই করতে পারতেন। রায়ান তবু চায়নি, বুশকে একা ফেলে বিদেশে যান তিনি। রায়ান মনে দুঃখ পাবে বলে তিনি যাননি কোথাও এত দিন।

কী যে গোলমেলে গল্প! আমার ফোন বাজছে। আমি ফিরেও তাকাই না। কেন যে এত রাগ লাগে আমার। আমি বলি, ‘তো, রায়ান লন্ডনে নিয়ে গেল না কেন বুশ ব্যাটাকে!’

ড. রাফিয়া চুপ করে থাকেন। ল্যাপটপ গুঁতিয়ে কী কী যেন দেখেন। আমি অস্থির হয়ে আছি উত্তরের জন্য। তিনি কি সেটা বুঝতে পারেন? শান্ত গলায় বলেন, ‘রায়ানের বাবা মারা যাওয়ার পর তার খালা তাকে লন্ডনে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি কিছুতেই কুকুর রাখতে দেবেন না বাসায়। রায়ান এখন হোস্টেলে সিট পেয়েছে। সেখানে কুকুর রাখার অনুমতি পেয়েছে। বুশকে তাই নিয়ে গেছে সেখানে।’

এতক্ষণে আমি লক্ষ করি ড. রাফিয়ার ডেস্কটপে মোটা ঠোঁটের, উদ্‌ভ্রান্ত চেহারার এক তরুণের ছবি। তিনি একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থাকেন। তারপর ধীর গলায় বলেন, ‘আমি রায়ানকে যেতে দিতে চাইনি। কিন্তু তাকে রাখার কোনো অধিকার তো আমার নেই।’

 আমার কোনো হিসাব মিলছে না। নির্দয়ের মতো আমি বলি, ‘রায়ান কে?’

 ‘রায়ান আমার ছেলে!’ ড. রাফিয়া তীব্র গলায় বলেন, ‘ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড!’

ড. রাফিয়া চোখ মোছেন। উঠে দাঁড়িয়ে ফোন করেন। রমেশকেই হয়তো। আমারও ফোন বাজছে আবার। বোধ হয় রিপা। হোটেলের প্রবেশপথে খলখলে একটা হাসির শব্দ শুনি। হয়তো মি লাই।

সবকিছু অবজ্ঞা করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। আর ভাবি, নিজেকে এমন অপরাধী লাগছে কেন আমার!