বদ্ধ সময়ের কলতান

২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যে ‘আরব বসন্ত’-এর উন্মেষ, তা ঝাঁকুনি দেয় গোটা বিশ্বকেই। তবে বসন্ত-পরবর্তী আরব দুনিয়ায় দেখা গেল নতুন আরেক বাস্তবতা—রক্তপাত শুরু হলো নতুনভাবে। এখানে সংকলিত কবিতাগুলোর রচনাকাল আরব বসন্তের অব্যবহিত আগে-পরে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সমকালীন কবিদের লেখা এই কবিতাগুলোতে পাওয়া যাবে দিনবদলের আগে-পরের ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধতাও। সব মিলিয়ে এ যেন অবরুদ্ধ সময়ের কলতান
আরব বসন্তের পর অজ্ঞাতনামা শিল্পীর অাঁকা মিসরের এই দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছে আন্দোলনের দিনগুলো
আরব বসন্তের পর অজ্ঞাতনামা শিল্পীর অাঁকা মিসরের এই দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছে আন্দোলনের দিনগুলো

সিরিয়া

ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ

আলেপ্পোর দিনলিপি

পাঠচক্রের সহযোদ্ধারা ঘুমিয়ে পড়েছে অচেতন।

বইয়ের তাকগুলোয় একা একা ঘুরে আপনি বেশ ধন্ধে পড়তে পারেন

মুক্তির কোনো নিশানাই নাই।

ডানের ওই তৃতীয় তাকটার কাছে গেলেই পাবেন একটা গোঙানি—

উপন্যাসের ভেতর থেকে একটা পুরো অধ্যায় হাপিস।

একটা দর্শনশাস্ত্রের গ্রন্থ

দুঃখজাগানিয়া শিরোনামটাও কেমন হাস্যরসাত্মক।

এক তাক থেকে আরেক তাকে ধীর লয়ে বয়ে বেড়ায় রাজনীতি।

মহাকাব্যের জন্য অবশ্য তেমন কোনো সময় নেই

ওই যে দ্য বুক অব ডিলাইট অ্যান্ড ইনটিমেসি

আলতো করে বইয়ের মলাট ওলটালেন মাচাদো

যেন বইটির ভেতরকার অলংকরণগুলো বিরক্ত না হয়, এভাবে।

আমরা হলাম বইয়ের সাবুদস্বরূপ

পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনে বেঁধে রাখা অনুচ্ছেদ।

ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ
ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ

ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ
সিরিয়ার কবি ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ পেশায় চিকিৎসক। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে ১৯৬১ সালে জন্ম নেওয়া এই কবির লেখালেখির শুরু গত শতকের আশির দশকে। প্রথম কবিতার বই তাগুথ আল-কালাম বা দ্য আইডল স্পিচ (১৯৯০)। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ লেফট এসাইড (১৯৯৮), বায়বাবা সেইড (২০০৪) ও দ্য পার্টস অব দ্য অ্যানিমেল (২০১০)। আরব দেশগুলোর মধ্যে ফওয়াদের কবিতা বেশ পরিচিত। আলেপ্পো শহরের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে তিনি লেবাননে বসবাস করছেন। তাঁর কবিতাটি নেওয়া হয়েছে পোয়েট্রি ট্রান্সলেশন সেন্টারের ওয়েবসাইট থেকে। আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন স্যামুয়েল ওয়াইল্ডার।

মিসর

মোহামেদ মেতওয়াল্লি

একটি পালকের পাখি

আমি একজন চমৎকার মানুষ

কিন্তু আমি পাখি বিষয়ে বেশ মোহগ্রস্ত

ওদের সবাইকে ভালোবাসি,

হোক সে অভিজাত টিয়া, রংবেরঙের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের পাখি আর ময়ূর,

মধ্যবিত্ত যেমন: পায়রা বা ঘুঘু

কিংবা ধরুন, বর্ণবাদী বা বৈষম্যের শিকার কাক-চড়ুই।

ওদের দিকে ছোলা, চেরি, ব্ল্যাকবেরি ছুড়ে দিই

ডাকি পোষা নামে বা আদরের ছলাকলায়

অন্যরা যেমন নারীদের ডাকার বেলায় করে, তেমন আরকি।

আর ঠিক সে জন্যই আমার একটা

যাকে বলে ‘সুখী গৃহকোণ’ পাওয়া হলো না।

ফলে আমি পরিবার ছাড়লাম

আর পাখির খোঁজে চষে বেড়ালাম দেশজুড়ে।

এবং আমি নিজেকে গোঁয়ার বা এ রকম কিছুও মনে করি না

এই সেদিন মওকা পেয়েই জুত হয়ে বসলাম

রাস্তার লাগোয়া রেস্তোরাঁটায়। দেখতে পেলাম, কোয়েল পাখির

গ্রিল করা একটা মুচমুচে ডিশ। সসেজ আর লেটুসে সাজানো, পাশে রাখা কাঁটাচামচ-ছুরি

আর মানানসই নৃশংসতা।

মোহামেদ মেতওয়াল্লি
মোহামেদ মেতওয়াল্লি

মোহামেদ মেতওয়াল্লি
১৯৭০ সালে মিসরের কায়রোতে জন্ম নিয়েছেন মোহামেদ মেতওয়াল্লি। ১৯৯২-এ পেয়েছেন ‘ইউসেফ এল-খাল পুরস্কার’। তিনি ইউনিভার্সিটি অব আরাকানসাস থেকে প্রকাশিত আধুনিক মিসরের কাব্যসংকলন অ্যাংরি ভয়েস-এর সংকলক ও সহসম্পাদক। www.jacketmagazine.com থেকে নেওয়া এই কবিতাটি মূল আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন কবি নিজেই।

​লেবানন

ইয়েহিয়া জাবের

শিরোনামহীন

যুদ্ধ এবং শব্দের মধ্যে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান

আছে প্রেম এবং শব্দের মধ্যে এমন একটি অন্তরঙ্গতা,

আমি আমার যুদ্ধ চয়ন করেছি শব্দে

আমি আগুন জ্বালাই শব্দে শব্দে

শব্দের ভেতর দিয়ে কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে তুলব; কাউকে পরিণত করব শিকারে

এ-ই আমার খেলার মাঠ। আমি যুদ্ধে মাতি শব্দ নিয়ে

সমস্ত উদগ্র সহিংসতা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে কথার ছলে

ফলে সেখানে আর কোনো রক্ত থাকবে না।

ইয়েহিয়া জাবের
ইয়েহিয়া জাবের

ইয়েহিয়া জাবের
লেবাননের কবি ইয়েহিয়া জাবের। জন্ম কট্টরপন্থী শিয়া পরিবারে। দেশটির জনপ্রিয় এই কবি লেবাননের গৃহযুদ্ধ (১৯৭৫-১৯৯০) চলাকালে যুক্ত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধারার সঙ্গে। ‘আল-হার্ব আল-আহলিয়া আল-লিবনানিয়া’ নামে খ্যাত এই গৃহযুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়, দেশছাড়া হয় লক্ষাধিক। সে সময় মঞ্চে-ময়দানে, চায়ের আড্ডায়, মিছিলে মুখে মুখে কবিতা বানাতেন জাবের। সেসবের বেশ কিছুতে সুরও দেওয়া হয় তখন। ইয়েহিয়া জাবেরের ‘শিরোনামহীন’ নামের এই কবিতাটি নেওয়া হয়েছে www.movingpoems.com থেকে।

ইরাক

মানাল আল-শেখ

যুদ্ধ

যুদ্ধের পরিকল্পনা করাটা পুরুষালি কাজ

আর নারীরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর টিকে থাকার উপায় খোঁজেন।

একদিন, যখন কোনো পুরুষ বেঁচেবর্তে থাকবেন না

তখন শেষ পুরুষের ঘ্রাণ খুঁজে পাওয়ার লোভে

এক নারী ধাওয়া করবেন অন্য নারীকে

যে পুরুষ শেষবার ঠোঁট ছুঁইয়েছিলেন

নারীটির গ্রীবায়।

মানাল আল-শেখ
মানাল আল-শেখ

মানাল আল-শেখ
ইরাকি কবি-লেখক মানাল আল-শেখের জন্ম উত্তর ইরাকের নিনেভাহতে, ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন এক যুগ ধরে। তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনা ইংরেজি, নরওয়েজীয়, ফরাসি, কাতালান ও ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ইম্পসিবল লেটারস (২০১০) এবং উইথ এ রেড ডট আন্ডার হিজ লেফট আই (২০১০)। কবিতাটি নেওয়া হয়েছে www.wordswithoutborders.org থেকে। মূল আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন আঙ্ঘাম আবদুল্লাহ।