সৈয়দ হকের মায়াবী দরজা

সৈয়দ শামসুল হক আমাদের সামনে যেকোনো দরজা খুলে দিলে আমরা দেখতে পাই জ্বলজ্বলে ষাটের দশক। পরিচয় ঘটে শিকড় হারিয়ে রেঙ্গুন থেকে ছোট চাচার সঙ্গে কক্সবাজারে আসা জামালের সঙ্গে। বাবা কর্তৃক নিজের মাকে হত্যার কুৎসিত এক স্মৃতি সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। ঠিক কী ঘটেছিল, পরিষ্কার জানে না জামাল। শুধু জানে, এই অভিযোগ তাকেও বহন করে বেড়াতে হবে জীবনভর। ফলে অদ্ভুত এক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে ওর ভেতর। একদিকে আশপাশের মানুষের সহানুভূতি, অন্যদিকে সমবয়সীদের ঘৃণা-টিটকিরি—দুটিই আহত করে তাকে। কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। এ সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচার আশায় জামাল পা রাখে ঢাকায়। কিন্তু সে তো আদতে পালাতে চায় জীবন থেকে, নিজের থেকে। মানুষ কি তা পারে কখনো? জামালও পারে না। এই পালিয়ে বাঁচার গল্পই ডালপালা মেলতে থাকে নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটিতে।

আরেকটু এগোলে দেখতে পাই, একধরনের প্রতিষেধক ভেবে ঢাকা নগরীকে জামালের আঁকড়ে ধরার তীব্র প্রচেষ্টা। এ সময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় সালমা নামের রহস্যময়ী এক যুবতীর। প্রেম, মোহ বা মায়ার বাইরেও অদ্ভুত এক সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়তে থাকে তারা। আর এসবের মধ্যে মাথাচাড়া দেয় জামালের বেঁচে থাকার তাগিদ। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন একটা ‘বিশুদ্ধ চাকুরী’। একটি চাকরি সে পেয়েও যায়। আর তখনই উপন্যাস মোড় নেয়। পাঠককে সে দাঁড় করিয়ে দেয় দীর্ঘ এক প্রশ্নের সম্মুখে।

রাসেল রায়হান

যেকোনো দরজা

সৈয়দ শামসুল হক

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২০

৭২ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে prothoma.com–সহ মানসম্মত বইয়ের দোকানে।

নিঃসঙ্গ ব্যবসায়ী সালাউদ্দিনের সঙ্গে জামাল কিংবা সালমার সঙ্গে খালেদের সম্পর্কগুলো নানা আস্তরণ নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। এই ছোট উপন্যাসেও এত এত চরিত্র, এত বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতা! প্রতিটি চরিত্রই আলাদা গুরুত্ববাহী। একেকটি ছোট ছোট বকুল যেন নিখুঁত একটি মালা হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র পরিসরের একটি উপন্যাসেও প্রেম কত রকম হতে পারে, কত মাত্রায় দেখা যায় জীবনকে, তার যথার্থ উদাহরণ সৈয়দ শামসুল হকের যেকোনো দরজা।

১৯৬১ সালে প্রকাশিত সচিত্র সন্ধানী একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি। শত শত নতুন-পুরোনো বই, পত্রপত্রিকার আবডালে এটি লুকিয়ে ছিল ৫৯ বছর ধরে। সোনার খনিতুল্য এ উপন্যাসের পরতে পরতে পাঠকের জন্য সৈয়দ শামসুল হক বয়ন করে গেছেন এক মায়ার যাত্রা, মায়াবী যাত্রা। সে যাত্রার প্রধান সহযাত্রী কি কেবল জামাল ও সালমা?

না, আজ থেকে ৬০ বছর আগে, মাত্র ২৬ বছর বয়সে লেখা এই উপাখ্যানে সৈয়দ হক টেনেহিঁচড়ে পাতালে নামিয়ে এনেছিলেন মানুষের আত্মগরিমা। প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, কোন মানদণ্ডে নিজেকে পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করছে মানুষ?