এক ছিল পাখি।
যেমন তেমন পাখি নয়, খুব গুণবতী পাখি।
গান গাইত। কথা কইত। দাঁড়ে বসে নাচত।
পাখিটির বুদ্ধিও ছিল খুব। পাখির মালিক ছিল এক চাষি।
সবাই তাকে ডাকত টুকটুকি। টুকটুকি কিন্তু কথা বলতে পারত একদম মানুষের মতো। চোখে যা দেখত, সে ঘটনার বর্ণনা করতে পারত হুবহু।
একদিন ঘটল কি!
চাষি গেছে তার নিজের জমি দেখতে।
দেখে, এক গরু তার খেতের ধান খাচ্ছে। চাষির মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। গরুটাকে ধরে এনে জবাই করে ফেলল। আর গরুর মাংস এনে লুকিয়ে রাখল চিলেকোঠায়।
ঘটনাটা পুরোপুরি দেখল টুকটুকি।
পরদিন গরুর মালিক এল গরুর খোঁজে।
চাষিটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, আমার গরু হারিয়ে গেছে। তুমি কি দেখেছ?’
চাষি জবাব দিল, ‘না।’
অমনি টুকটুকি ওপাশ থেকে বলে উঠল, ‘না, মিথ্যা কথা। আমার মালিক তোমার গরুটাকে জবাই করে চিলেকোঠায় তার মাংস লুকিয়ে রেখেছে!’
কথা শুনে গরুর মালিক অবাক। গেল সে চিলেকোঠায়। সেখানে মাংস পেল। কিন্তু চাষির সাফ সাফ জবাব, ‘এটা অন্য গরুর মাংস।’
তাই শুনে টুকটুকি আবারও চেঁচিয়ে উঠল, ‘মিথ্যে! মিথ্যে! এটা সেই গরুরই মাংস।’
পড়শির কাছে ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে ঠেকল। কূলকিনারা না পেয়ে সে গেল বিচারকের কাছে।
বিচারক বললেন, পরদিন তিনি এর বিচার করবেন।
চাষি পড়ল মহাভাবনায়। বিচারের সময়ও তো সব সত্যি বলে দেবে পাখি। তখন সে ফেঁসে যাবে। ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করল চাষি।
রাতের বেলা, আকাশে তখন ঘোরলাগা পূর্ণিমার আলো। এক পিতলের কলসিতে পাখিটিকে নিয়ে বন্দী করল চাষি। মুখটা এঁটে দিল শক্ত করে। কলসির ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। চাষি তখন ধীরে ধীরে কলসির গায়ে আঘাত করতে লাগল। তারপর পানির ছিটা দিতে লাগল। এতে পাখিটি ভাবল, বাইরে বুঝি ঘন অন্ধকার। ঝড় হচ্ছে। মেঘ ডাকছে। আর বৃষ্টি পড়ছে বেদম। সারা রাত এভাবে কাটাল চাষি। তারপর ভোরবেলায় পাখিটিকে এনে রাখল খাঁচায়।
সকালবেলা পাখিটিকে নিয়ে রওনা দিল বিচারকের দরবারে।
প্রথমে পড়শি বিচারককে জানাল পুরো ঘটনা। বিচারক তখন টুকটুকিকে বললেন, ‘পাখি, তুমি যা বলেছ তা কি সত্যি?’
পাখি বলল, ‘সত্যি, সত্যি। যা দেখেছি তা-ই বলেছি।’
চাষি এবার মুখ খুলল, ‘হে মহান বিচারক, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। আপনি কেন একটা পাখির কথা বিশ্বাস করবেন?’
বিচারক বললেন, ‘কিন্তু এই পাখি তো যে সে পাখি নয়, এই পাখি তো খুব গুণবতী।’
চাষি বলল, ‘তা আমি জানি। কিন্তু তাই বলে এই পাখি যে সব সত্যি কথা বলে, এর তো কোনো মানে নেই! দু-একটা সত্যি কথা বললেও অধিকাংশ কথাই আবোলতাবোল। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করতে পারেন।’
‘কী করে পরীক্ষা করব?’
‘আপনি পাখিকে জিজ্ঞেস করুন গত রাতের কথা। রাতটা তার কেমন কেটেছে।’
পাখি বলল, ‘সে এক ভয়ংকর রাত। গত রাতে ছিল গাঢ় অন্ধকার। রাতভর ঝড় আর বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে শোনা গেছে মেঘের ডাক।’
চাষি তখন হাত জোড় করে বিচারকের সামনে বলল, ‘দেখুন, পাখি কি সব সত্যি বলে? গত রাতের আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। জোছনার আলোয় ঝলমল করছিল পৃথিবী।’
অনেকেই বিচার দেখতে এসেছিল। পাখির কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল সবাই। বিচারের রায় গেল চাষির পক্ষে। লোকেরা বলল, ‘এই টুকটুকি পাখিকে ছেড়ে দাও বনের মধ্যে। ও উড়ে চলে যাক। ওকে আর দরকার নেই।’
বাড়িতে ফিরে গেল চাষি।
টুকটুকি আর কী করবে? সে উড়তে উড়তে গেল গহিন বনে। তারপর একটা ঝাকড়মাকড়া বুড়ো বটগাছের ডালে বাসা বাঁধল। একদিন দেখল, সেখানে এসেছে এক নতুন পাখি। মসৃণ ঠোঁট। লাল-সবুজ পালকে ঢাকা শরীর।
টুকটুকি জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, তোমার নাম কী?’
নতুন পাখি বলল, ‘আমার নাম কাকাতুয়া। আমি এসেছি নদীনালা খালবিলের দেশ থেকে।’
টুকটুকি বলল, ‘তুমি দেখতে খুব সুন্দর!’
নতুন পাখি লজ্জা পেল। বলল, ‘আমি কিন্তু মানুষের মতো কথা বলতে পারি।’
শুনে চমকে উঠল টুকটুকি।
‘তাই নাকি? তাই নাকি?’
‘আমিও মানুষের মতো কথা বলতে পারি। আমার গুণের প্রশংসা করত সবাই। মানুষেরা আমাকে খুব ভালোবাসত। তারপর ওরাই একদিন আমাকে বনে তাড়িয়ে দিল।’
‘আহা রে। কেন? কেন?’ জানতে চাইল সেই পাখি।
‘মানুষেরা বড় স্বার্থপর। তারা সব সময় সত্যি কথা পছন্দ করে না। তারা চায় কেবল নিজেদের নিয়ে মেতে থাকতে। তারাই সবাইকে জ্ঞান দিতে চায়, বুদ্ধি দিতে চায়। ভাই, তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ...’
কাকাতুয়া বলল, ‘বলো।’
‘মানুষের সামনে নিজের বুদ্ধিমতো কোনো দিন কথা বলতে যাবে না। মানুষেরা তোমাকে যা শেখাবে, তুমি তা-ও বলবে।’
কাকাতুয়া সেই উপদেশ আজও ভোলেনি। মানুষ তাকে যা শেখায় সে শুধু সেটুকু কথাই বলে।
(সূত্র: বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত আমীরুল ইসলাম সম্পাদিত জাপানের রূপকথা বই থেকে)