১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা যখন আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তরুণ রফিকুল ইসলামের তখন মনে হয়, এই ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি তুলে রাখা দরকার। তাঁর সঙ্গে ছিল ফোকল্যান্ডা ক্যামেরা, যার একটি রোলে মাত্র আটটি ছবি তোলা যেত! সৌভাগ্যক্রমে পকেটে ছিল আরেকটি রোল। এই সম্বল হাতে করে তিনি চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলাভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ছাদে। সেখান থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যামেরায় ধারণ করেন মহান ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ মুহূর্তগুলো।
রফিকুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে, তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন আন্দোলনে। শুধু তাই নয়; ১৯৫৩, ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের শহীদ দিবসের পুষ্পস্তবক অর্পণ, কালো পতাকা উত্তোলন, বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের তৈরি শহীদ মিনারের ছবিও তিনি তুলেছেন, যা বাংলা একাডেমির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
রফিকুল ইসলাম কেবল ভাষাসংগ্রামীই নন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে নির্যাতিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর রফিকুল ইসলাম সেই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি কবির সঙ্গে দেখাও করেন কলকাতায়। কবি অবশ্য তখন অসুস্থ ছিলেন, কথা বলতে পারতেন না। তিনি কবির স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন। কবির গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। রফিকুল ইসলামই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। কবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে তিনি নজরুল নির্দেশিকা, নজরুল জীবনী, কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছেন।
গবেষণা, সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০১ সালে তাঁকে একুশে পদক ও ২০১২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান পান ২০১৮ সালে। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন।
রফিকুল ইসলাম বর্ণাঢ্য জীবনের স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁর লেখা ও সম্পাদিত প্রায় ৩০টি বইয়ে। নতুন প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে, বাংলা ভাষা কত সংগ্রামের পর আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠল, তা জানতে পারে, সেদিকে তাঁর বিশেষ নজর ছিল। তাই তো ছাত্রদের শুরু করা ভাষা আন্দোলন কীভাবে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গণ–আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, সেই ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন বাংলাভাষা আন্দোলন বইটি। একুশের শহীদেরা বাংলাভাষার শহীদেরা বইয়ে লিখেছেন কীভাবে তাঁর সতীর্থরা ভাষার জন্য প্রাণ দেন। আর বাংলা ভাষা কীভাবে কালক্রমে আমাদের মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা হয়ে উঠল, তা নিয়ে কথা বলেছেন আমার ভাষা বইয়ে। ময়ূরপঙ্খি থেকে প্রকাশিত এই বইগুলো তিনি লিখেছেন তোমাদের জন্যই। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা ছিল, তার চিহ্ন খুঁজে পাবে এসব বইয়ের পাতায় পাতায়।
গত ৩০ নভেম্বর আমরা রফিকুল ইসলামকে হারালাম। তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।