মিউ

আসলে কেউ কারও মতো হয় না।যেমন মিউ। একেবারেই অন্য রকম ছিল সে।ছেলেবেলায় মিউকে ছাড়া একদম চলত নাঅপুর। খুব আহ্লাদি বিড়াল। পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত সারাক্ষণ।খাওয়ার সময় সে থাবা উঁচিয়ে বসে থাকত পাতের কাছে। গভীর চোখ করে প্রতিটি নলা লক্ষ করত। কিন্তু খাবার নিয়ে তার কোনো মাতামাতি ছিল না। সামান্য কাঁটাকোটাতেই সাঙ্গ হতো প্রতি বেলার খাবার।পড়ার সময় তাকে কাছে না থাকলে চলে না। দিব্যি লেজ গুটিয়ে বসে থাকত এক কোণে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকাত। সামান্য একটু ডাকত চিকন গলায়। আবার সে নীরব হয়ে ডুবে থাকত নিজের মনে।ওকে রেখে বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। কাজটা সারতে হতো লুকিয়ে-চুরিয়ে। দেখা না পেলে সারা বাড়ি খুঁজত মিউ মিউ করে। স্কুলে যাওয়ার সময় সে গম্ভীর মুখে এগিয়ে দিত খালের সাঁকো পর্যন্ত। স্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানে বসে তাকিয়ে থাকত পথের দিকে।এর ভেতর একটা ঘটনা ঘটল।তখন তাদের মাটির মেঝের একহারা ছাপড়াঘর। টিনের ছাউনি। অতটা চৌকিটৌকির বালাই ছিল না। বাবা শুধু খাট ব্যবহার করতেন। অন্যদের ঢালাও বিছানা পড়ত মেঝেতে।রাতে ঘুমানোর সময় মিউ বসে থাকত মশারির বাইরে। মায়ের ভয়ে সে মশারির ভেতর ঢোকার চেষ্টা করত না। বাইরে বসেই নরম থাবার স্পর্শ বুলাত হাতে। কখনো চিকন গলায় একটু সাড়া দিত মিউ মিউ করে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে অবশ্য কোলে তুলে একটু আদর করতে হতো। ব্যস, আর কিছু চাই না তার। এতেই আনন্দ।সে-রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল বাইরে। টিনের চালায় অপূর্ব বৃষ্টির নৃত্য শুনতে শুনতে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল সবাই।সকালে মায়ের চিত্কারে ঘুম ভাঙল সবার। একটা লাউডগা সাপ মরে পড়ে আছে বিছানার কাছে। মিউ তার দিকে তাকিয়ে রাগে গরগর করছে। কামড়ে ছিবড়ে মিউ দফারফা শেষ করে দিয়েছে সাপটার।এ ঘটনার পর মিউ রীতিমতো হিরো হয়ে গেল। সাপটা মশারির ভেতর ঢুকলে একটা অঘটন হতো নির্ঘাত। মিউয়ের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।মা আগে ওকে তেমন একটা সহ্য করতে পারতেন না। ছেলের পেট আলগা। বেড়ালের লোমটোম পেটে ঢুকলে পেটের ব্যামো ভালো হয় না কখনো। তাই ওর সঙ্গে মাখামাখিটা মা সহ্য করতে পারতেন না।কিন্তু মা এখন নিজেই ভক্ত হয়ে গেছেন মিউয়ের। আলাদা একটু ভালোমন্দ খাবার সব সময় তুলে দেন সামনে। মিউ বিনীত ভঙ্গিতে চেটেপুটে খেয়ে লেজ তুলে ধন্যবাদ জানায়।আনন্দের দিন বোধহয় এক রকম যায় না।দেখতে দেখতে মিউ বুড়ো হয়ে গেল। ঘরভর্তি তার ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনির বিরাট কলেবর।এখন তার শান্তির সময়।সেভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাত্ দেখা গেল, তার গায়ের লোম ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। গভীর পচন ধরেছে কানের কাছে। সারাক্ষণ মাছি বনবন করে সেখানে। ভোঁতকা গন্ধে নাকে রুমাল দিতে হয়।অসুস্থ হওয়ার পর সে একটু দূরে দূরে থাকে বটে, কিন্তু পুরোনো অভ্যাসবশে কাছে চলে আসত প্রায়ই।বাবা কখনোই এসব উটকো ঝামেলা পছন্দ করেন না। ছেলের মুখ চেয়ে এত দিন কিছু বলেননি। এখন এই মড়ক ঘরছাড়া না করলে তার মুখে খাবার রুচবে না।তাহলে কী করা যাবে মিউকে নিয়ে।বাবা আড়চোখে একবার দোনলা বন্দুকের দিকে তাকালেন। কিন্তু এ যে মশা মারতে কামান দাগানোর শামিল!মিউ বোধহয় ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল। সে ইচ্ছে করেই কারও সামনে আসত না। এমনকি খিদে পেলেও ঢি মেরে পড়ে থাকত চালের ওপর।শুধু অপুর সাড়া পেলেই কান সজাগ হয়ে উঠত। একটু গর-র গর-র আওয়াজ তুলত মুখে। কিন্তু সেটা কেমন যেন আর্তনাদের মতোই ছড়িয়ে পড়ত কেবল।মিউয়ের এই দুর্দশা দেখে খুব মনখারাপ হয়ে গেল অপুর। আড়ালে-আবডালে চোখ মুছে তবেই শান্তি।হঠাত্ একটা বুদ্ধি এল মাথায়।বাজারের হরিশ ডাক্তারের কাছে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। ডাক্তার তো হেসেই খুন—‘অ্যাঁ, বেড়ালের জন্যি ওষুধ! বেড়ে বলেছ তো হে ছোকরা। কী ওষুধ দেব তোমাকে, টিনচার আয়োডিন, না কুইনাইন! দেখি, তোমার বাবা আসুক...।’এই সেরেছে! বুড়োর কাছ থেকে তখন পালাতে পারলেই হয়। ভিক্ষার দরকার নেই। জান বাঁচাও।বাবার কানে বোধহয় কথাটা গেছল।সে-রাতেই তিনি রায় দিলেন বাড়ির কিষেন হাকিমকে ডেকে, ‘ওই মড়কটাকে বস্তায় ভরে নদীর ওপার ফেলে দিয়ে আয়।’ নদীতে ফেলে দিতে যে বলেননি, এটা তার বদান্যতা! যথা আজ্ঞা। হাকিম দুর্দান্ত এক কাজ পেয়ে অ্যাকশনে চলে গেল।সে-রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেক কাঁদল অপু। মা অনেক সেধেও খাওয়াতে পারেননি। ছেলের কষ্ট তার ভেতর সঞ্চারিত হয়েছিল কিনা কে জানে। না হলে আঁচলে ওভাবে চোখ মুছবেন কেন!মিউ চলে যাওয়ার পর সব আনন্দ মরে গেল।নির্দয় দিন পার হচ্ছে একের পর এক। সেই একঘেয়ে স্কুল, নিরানন্দ খেলাধুলা, বৃষ্টির শব্দ আর কখনো নৃত্য করে না কানে। এখন ঘরে সাপ এলেও কেউ দেখার নেই।সব আছে শুধু নেই মিউ।সে-রাতেও হয়তো বৃষ্টি নেমেছিল মুষলধারে। চোখ বুজতেই ঘুমে কাদা হয়ে গেল সবাই।ভোর ভোর। হাতের কাছে কী একটা নরম ভেজা ভেজা ঠেকল। সাপ নয়তো!তড়াক করে বিছানায় লাফিয়ে উঠে যা দেখল, তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়।মিউ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে গভীর তন্দ্রায় শুয়ে আছে তার শিয়রে। অপু সবকিছু ভুলে পরম মমতায় কোলে তুলে নিল মিউকে।মিউয়েরা অবলা বলেই ফিরে যায়, ফিরে আসে। কিন্তু মানুষ নয় কখনোই।