১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে যেমন গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, একই সঙ্গে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানচর্চাকেও পঙ্গু করতে সচেষ্ট ছিল তারা। দুভাবে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে জাতির মেধাবী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বাঙালির জ্ঞানচর্চাকে ধ্বংস করার মানসে শিক্ষাক্ষেত্রে চালানো হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের গ্রন্থাগারগুলো ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও একাত্তর–পরবর্তী পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন ও নানান গ্রন্থ ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ শহরেই গ্রন্থাগারগুলো আক্রান্ত হয়েছে।

২৫ মার্চ কালরাত থেকে গণহত্যার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রন্থাগার ধ্বংসের উৎসবে মেতে ওঠে পাকিস্তানিরা। সূচনাটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল গ্রন্থগারের বইপত্র সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। ওই রাতে আক্রমণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কয়েকটি হলের গ্রন্থাগারও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হলের রুমে শিক্ষার্থীদের অসংখ্য বই হানাদাররা বিনষ্ট করে।

২৫ মার্চ রাতে ইকবাল হলে গণহত্যা ও আগুনে গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন বইপত্রে, স্মৃতিচারণায়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক আজাদ–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। ‘...আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিসহিস করে ছড়িয়ে পড়ছে। অ্যাসেম্বলি হল ও পাঠাগার আগুনে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। পাশের রেলসড়কের বস্তিও জ্বলছে।’ [বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, পৃ. ৭০]। পরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় অবাঙালি সন্ত্রাসীদের লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। ছাত্রদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে অনেক বই ও নোটও লুটের শিকার হয়।

সময় গড়ালে একসময় মুক্তিকামী বাঙালিরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মে-জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধযুদ্ধ তীব্রতর হতে থাকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক—সামরিক গোষ্ঠী বিশ্বকে এমনটা বোঝানোর জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করে। এর অংশ হিসেবে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর কোনো পরিবেশই তখন ছিল না। হলঘগুলোতে ছাত্র বসবাসের পরিবেশ তৈরি করার জন্য ১৬ জুন উপাচার্যের কক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উঠে আসে যে সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের পরিবেশ কোনোভাবেই ছাত্র বসবাসযোগ্য নয়। এ জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে অনুরোধ করা হয়। [সূত্র: ড. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৭-১৯৭১), ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৪৬] এ বিষয়ে জুলাই মাসে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চিঠিটি ছদ্মনামে পাকিস্তানপন্থী কোনো ছাত্র অথবা সেনা কর্তৃপক্ষেরই লিখে পাঠানো; তারপরও চিঠিতে শিক্ষার্থীদের বই ও নোট ধ্বংসের কিছু সত্য বেরিয়ে আসে। সেখানে ‘মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সংঘটিত ঘটনায় সব শিক্ষার্থীর বই ও নোট সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

শুধু কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েছিল পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ঐতিহ্যবাহী রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাগার। ১৮৬৯ সালে (কোথাও কোথাও লেখা আছে ১৮৭১ সাল) প্রতিষ্ঠিত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, জীবনান্দ দাশ ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্মৃতিধন্য লাইব্রেরিটির সংগ্রহ ২৫ মার্চ রাতে একমুহুর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। ওই রাতে গণহত্যার পর পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর লুটপাট করা হয় মূল্যবান বই, পত্রিকা ও অন্য সংগ্রহশালা। এমনকি পাঠাগারটির দরজা–জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় লুটেরারা।

১৯৭২ সালের ১০ মে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেক দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহসহ এখানে ২০ হাজারের বেশি বই ছিল। আড়াই শ বছর আগে খ্রিষ্টান মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলা অক্ষরে যে বই ছাপানোর উদ্যোগ নেয়, তার কয়েকটি কপিও ছিল এখানে। আরও ছিল রাজা রামমোহন রায়ের মুদ্রিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ, বেদান্ত দর্শন, পারসি ভাষায় লেখা তোফায়াতুল মোহাম্মাদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁদের সমকালীন অন্য লেখকদের রচনাবলির প্রথম সংস্করণ, গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরআন শরিফ–এর প্রথম বাংলা অনুবাদ। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা, ঢাকা নিউজ, বেঙ্গল টাইমস, তত্ত্ববোধিনী, তত্ত্বকোমুদি, শান্তিনিকেতন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, হিতবাদী, বসুমতি, বিচিত্রা ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বঙ্গদর্শন-এর মূলকপি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত কপিও ছিল এ গ্রন্থাগারে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ৫০ বছরের সরকারি সব গেজেট। সমৃদ্ধ ও দুর্লভ সংগ্রহশালা থাকায় এখানে শিকাগো ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে এসেছিলেন।

১৯৭১ সালের হামলায় রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাগারের কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি। মূল্যবান বই ফুটপাতে ও গুদামে কেজি দরে বিক্রি হয়। এমনকি এখানকার বই ও পত্রিকার পাতা দোকানের ঠোঙা বানানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে লুট হওয়া বই কেউ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে থাকলে তা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত গবেষক বদরুদ্দীন উমরের হাতে পৌঁছানো একটি বই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে তিনি ফেরত দেন। কিন্তু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বইটি ফেরত না নিয়ে শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে তাঁকেই আবার উপহার দেন। এ নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্য, সুবর্ণ প্রকাশের প্রয়াত আহমেদ মাহফুজুল হক জাহাঙ্গীর বইটি সদরঘাট থেকে সংগ্রহ করে তাঁকে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বইটি সংরক্ষণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সৈন্য, তাদের এদেশীয় দোসর এবং অবাঙালি লুটেরাদের দ্বারা ঢাকার আরও অন্যান্য পাঠাগার এবং অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ধ্বংস ও লুটপাটের শিকার হয়। হানাদার বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার’। ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে ৩৫ বছর কর্মরত ছিলেন বর্তমানে চাঁদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্থিরানন্দ। লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘একাত্তরের রামকৃষ্ণ মিশনে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। ওই সময় গ্রন্থাগারটি লুট হয়। স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগারের কোনো বই কারও কাছে থেকে থাকলে ফেরত দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ সময় অনেকে বই ফেরত দিয়ে যান। বিভিন্নভাবে পাওয়া বইগুলো মিশনের ভক্তদের কেউ কেউ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। পরে আরও বই কিনে গ্রন্থাগারটিকে সাজানো হয়।’

ঢাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হানাদার বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও বই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, মধ্য এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে। শহীদ মিনার ও গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ফলে এর মূল্যবান বই ও সংগ্রহশালা চুরি ও ধ্বংস হয়। গ্রন্থাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে গ্রন্থাগারে ৩০ হাজারের বেশি বই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা এখানকার হাজার হাজার বই রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণগ্রন্থাগারও লুটপাটের শিকার হয়। সমৃদ্ধ গণগ্রন্থগারের দ্বিতীয় তলায় ছিল পাকিস্তানি মেজর আব্দুল্লাহর মার্শাল কোর্ট। আটক অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে এনে অকথ্য নির্যাতন করা হতো। ব্রাহ্মণাড়িয়ার কবি ও গবেষক জয়দুল হোসেন জানান, লুট হওয়া গ্রন্থাগারের মূল্যবান অনেক বই স্বাধীনতার পর জেলা শহরের ফুটপাতে বিক্রি হয়েছে।

শুধু গ্রন্থাগার ও বই-ই নয়, বাঙালির শিক্ষাব্যবস্থাকেও ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠেছিল হানাদার বাহিনী। ‘বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থপ্রীতি ও ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা’ শিরোনামের লেখায় এ–বিষয়ক একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। সেখানে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধকালীন ৯ মাসে সারা দেশে ৭১৯টি জুনিয়র স্কুল, ১৯৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ৩৭টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ১৪৮টি বেসরকারি কলেজ, ৮টি শিক্ষাবিষয়ক সরকারি অফিস, ৭টি পিটি ইনস্টিটিউট, ২৬টি সরকারি কলেজ, ২১টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১৬টি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ও ৩৫টি বৃত্তিমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা যেভাবে বই ও গ্রন্থাগার ধ্বংস করেছিল, তা থেকে বোঝা যায় যে তারা কেবল বাঙালিকে হত্যা নয়, তার জ্ঞানচর্চার প্রধান ক্ষেত্রের ওপরও সুচিন্তিতভাবেই আঘাত করেছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি।

হারিয়ে যাওয়া বই ফেরত পেয়ে হারুনুর রশিদকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, ১৯৭২
ছবি: দৈনিক বাংলার সৌজন্যে

বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগারও

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩২ নম্বর বাড়িতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি ধ্বংস ও লুটপাটের শিকার হয়। গ্রন্থাগারের মূল্যবান বইগুলোর প্রতি অকৃত্রিম দরদ ছিল শেখ মুজিবের; এর তীব্রতা অনুভব করা যায় তাঁর বয়ানেই। স্বাধীনতার পর সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘...বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে।...আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।’

এ নিয়ে দুঃখবোধ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরও। গ্রন্থাগার আক্রমণের শিকার এবং মূল্যবান বই লুট হওয়া প্রসঙ্গ বেগম মুজিব ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...জেলের সিল দেওয়া অসংখ্য বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে পাঁচটা-ছটা আলমারিবোঝাই বই ছিল। তার মধ্যে ছিল বিশ্বকবির অনেক অমূল্য বই। বঙ্গবন্ধু নিজেই ওগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। গত বছর হানাদার বাহিনী আলমারিসুদ্ধ বইগুলো লুট করেছে। বাইরের ঘরে রবীন্দ্রনাথের যে বিশাল প্রতিকৃতি ছিল, হানাদার বাহিনীর বুলেটের কবল থেকে সেটাও রক্ষা পায়নি। কবিগুরু, দেশবন্ধু ও নজরুলের যে মূর্তিগুলো ছিল, হানাদার বাহিনী সেগুলোও নিয়ে গেছে।’ (দৈনিক বাংলা, ৮ মে ১৯৭২)

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগারের কিছু বই ফেরত পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের ২৯ মে দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, হারুনুর রশিদ নামের একজন হকার অনেকগুলো বই বঙ্গবন্ধুকে ফেরত দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু আবেগে হারুনকে জড়িয়ে ধরেন। ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের গ্রন্থাগার লুট হওয়ার পর হারুন বইগুলো কিনে যত্নে রেখে দেন। সহজেই অনুমেয় যে বঙ্গবন্ধুর লুট হওয়া বই ঢাকার ফুটপাতে কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।