আবদুর রাজ্জাকের দুটি অভিভাষণ
২৮ নভেম্বর জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা
প্রথম ভাষণ
ড. আল-মুতী শরফুদ্দীন এবং উপস্থিত বন্ধুগণ,
শুধু শারীরিক অসামর্থ্যই নয়, দর্শনচিন্তা, বাংলাদেশের কিংবা অন্য যেকোনো জায়গার দর্শনচিন্তা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নিতান্ত সীমাবদ্ধ। সুতরাং আমরার কথা সামান্য দুয়েকটি হবে, তা-ও সাধারণ জ্ঞান থেকে। যত দূর জানি, শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই উপমহাদেশে আবহমান কাল থেকে, মধ্যযুগে তো বটেই, ধর্মচিন্তার এবং দর্শনচিন্তার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য করা হয়নি। এই উপমহাদেশের বাইরেও মধ্যযুগে অন্তত ধর্মচিন্তাই দর্শনচিন্তার নামান্তরমাত্রই ছিল। মধ্যযুগে যে দু-তিন শ বছর ইসলাম চিন্তার ক্ষেত্রে নায়কত্ব গ্রহণ করেছিল, তখন ধর্ম এবং দর্শনচিন্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল। আধুনিক যুগেও ধর্মচিন্তা এবং দর্শনচিন্তা মোটের ওপর আলাদা খাতে বইছে। আমি মনে করি, এই সেমিনারে মধ্যযুগের হিন্দু দর্শন, বাঙালির দর্শন চিন্তায় বৌদ্ধ প্রভাব ইত্যাদি শুধু ওই কথারই স্বীকৃতি। আজকাল বাংলাদেশে অন্তত আমরা সেক্যুলার সমাজ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য প্রাণপাত করছি। এই সময় মধ্যযুগের দর্শনচিন্তার বৈশিষ্ট্য ভালো করে প্রকাশ করে, ধর্মের প্রভাব কতটা ছিল এবং আজকাল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সেই চিন্তার সামঞ্জস্য কতটা, আশা করি, এই সেমিনারে আপনারা তা ভালো করে প্রকাশ করবেন। ইসলামের দু-তিন শ বছর পরেই যে সময় পতন শুরু হলো, সুফিবাদ ইত্যাদি ইসলামের দর্শনচিন্তায় একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিণত হলো। যাঁরা রিসার্চ করেন, তাঁরা হয়তো বের করতে পারবেন যে ইসলামের একেবারে প্রাথমিক যুগেও সুফিচিন্তার বীজ ছিল। কিন্তু সুস্পষ্ট প্রকাশ ইসলামের পতনের যুগেই। ভারতবর্ষে ইসলাম ইসলামের পতন শুরু হবার পরেই আসে। সুতরাং ভারতবর্ষের ইসলামি চিন্তায় সুফিবাদ একটা মস্ত বড় অংশ। আজকের দিনে বাংলাদেশে যেকোনো ‘প্লুরাল’ সমাজে ধর্মচিন্তা এক করে দেখলে কী ফল হতে পারে, আশা করি, এই সেমিনারে আপনারা ভালো করে প্রমাণ করবেন। ধর্মচিন্তা কিংবা দর্শনচিন্তার কোনটা বড়, এটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য, যে ধর্মচিন্তায় আমরা মনে করব যে এই জীবনের পরেও আমাকে আরও জীবন গ্রহণ করতে হতে পারে এবং যে ধর্মচিন্তায় আমি মনে করব যে এই জীবনই একমাত্র জীবন—সেই সমাজে এই দুই ধর্মচিন্তার ওপর যদি দর্শনচিন্তা নির্ভর করে, তাহলে এক-আধটু গোলমাল হবার সম্ভাবনা। অন্তত সেক্যুলার সমাজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমি আশা করি, আপনাদের সেমিনারে এই কথাটি ভালো করে প্রমাণ করবেন। ধন্যবাদ।
দ্বিতীয় ভাষণ
সম্মানিত সভাপতি ও সমাগত সুধীবৃন্দ,
১৯৬৭ সালে ইতিহাস পরিষদ ও ইতিহাস পত্রিকার আবির্ভাব। তখন আমরা পাকিস্তানের বাসিন্দা। ১৯৭৩ সালে, বাংলাদেশে, পরিষদের নতুন নামকরণ হলো ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’। আজকে পঁচিশ বছর পরে ১৯৯৩ সালে একটু হিসাব-নিকাশ করা যেতে পারে। ‘ইতিহাস পরিষদ’, ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’ এবং ইতিহাস পত্রিকা না থাকলে, কারোর কি কোনো ক্ষতি হতো, অথবা এগুলো থাকায় কারোর কি কোনো বৃদ্ধি হয়েছে? আমরা কি সত্যি কিছু করতে পেরেছি এবং সেই করাটা কী ধরনের? আমাদের ইতিহাসচর্চায় ইতিহাসজ্ঞান পৃথিবীতে বা বাংলাদেশে কতটা বাড়ল?
প্রথমেই দেখতে হয়, আমরা শুরু করলাম কী নিয়ে? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলা ভাষা বা বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস সম্বন্ধে ধ্যানধারণা নিতান্তই সীমিত, অকিঞ্চিৎকর। আঠারো শতকেও মহারাষ্ট্র পুরাণের ওপর আমরা যেতে পারিনি। এগারো শতকে আবু রায়হান আলবিরুনির সময় থেকে আরবি-ফারসি ভাষায়, আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে ইংরেজি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় পুরো উপমহাদেশের ওপর প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এর ভেতর বেশ কিছু লেখা যথেষ্ট উচ্চ মানের। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকে, বিশেষ করে, দেশি-বিদেশি অনেকেই বেশ মূল্যবান লেখা ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন। দেশভাগ এবং স্বাধীন হওয়ার পরেও ইতিহাসচর্চা ভারত এবং পাকিস্তানে, মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই চলতে থাকল। সদয় বিলিতি পার্লামেন্ট আইন করে আমাদের দুটি দেশকেই স্বাধীন করে দিলেন। কিন্তু দেশ দুটিতে স্বাধীন মন দিতে ভুলে গেলেন। দেশের ভাষায় দেশের লোকের ইতিহাসচর্চা করার বা লেখার কথা উঠলই না। ইতিহাস পরিষদ ও ইতিহাস পত্রিকার মূল্যায়নে এই কথাগুলো মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
১৯৬৮ সালে প্রথম ইতিহাস সম্মেলন উপলক্ষে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক কথাটা বেশ পরিষ্কার করেই বললেন, ‘ঐতিহাসিক ও ইতিহাসসচেতন ব্যক্তির সমবেত চেষ্টায় বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইতিহাসচর্চার জন্য ইতিহাস পরিষদ নামে একটা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ঢাকায় গঠিত হয়েছে জেনে আনন্দিত হলাম।...এতে জনসাধারণের দ্বারদেশ পর্যন্ত বাংলা ভাষার মধ্যস্থতায় দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে...ইতিহাস পরিষদের এই ভূমিকা আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ শুধু আনোয়ারুল হক নন, আরও অনেকে কথাটা বলেন। আজ পঁচিশ বছর পরে কথাগুলো স্মরণ করার প্রয়োজন বোধ করছি। শুনতে পাই, কেউ কেউ নাকি দেশে ইংরেজি ভাষার যথেষ্ট কদর এবং চর্চার ব্যবস্থা হচ্ছে না মনে করে অত্যন্ত মর্মাহত। কেউ কেউ লক্ষ করেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতা বুঝতেও পারে না, নিজেরা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়া তো দূরের কথা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, আরও অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা অন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিতে বক্তৃতা বোধগম্য হবে না। অবশ্যই তার একটা প্রধান কারণ, তাদের নিজেদের ভাষায় যথেষ্ট উচ্চ মানের যথেষ্ট বই আজকাল পাওয়া যায়। দু-চার শ বছর আগেও তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভর করতে হতো। সেই দু-চার শ বছর আগের সেই দেশি বিদ্বান ব্যক্তিরা যদি আমাদের দেশের আজকালকার বিদ্বান ব্যক্তিদের মতো বিদেশি ভাষার অহংকারী থাকতে চাইতেন, তাহলে তাদের নিজের দেশের ভাষার বর্তমান অবস্থায় ওঠার আর অবকাশ হতো না।
শুধু ভাষার উন্নতিই ব্যাহত হতো তা নয়। আমাদের দেশে, অনুন্নত সব দেশেই উন্নতির প্রথম এবং প্রাথমিক শর্ত সমাজে একটা সর্বজনীন একাত্মবোধ উজ্জীবিত করা। ভাষা এই একাত্মবোধ সৃষ্টির প্রথম এবং প্রধান মাধ্যম। লাতিন ত্যাগ করে ইউরোপ যখন সাধারণ মানুষের ভাষাগুলোকে মর্যাদা দেওয়া শুরু করল, তখনই ইউরোপের মানুষের ইতিহাসের শুরু। ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’ বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইতিহাসচর্চার ব্যবস্থা করে সেই মহা পুণ্য কাজের ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং পরিষদ ধন্যবাদার্হ।
ইতিহাস পরিষদ এবং ইতিহাস পত্রিকাটি কারোর একক চেষ্টায় গড়ে ওঠেনি। তবু বলা চলে ফাস্ট এমঙ্ক ইকুয়াল মরহুম আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। আজকের দিনটিতে তাঁকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আর যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এবং করছেন, আশা করি আরও বহুদিন তাঁরা এই কাজ করে যাবেন।
ভূমিকা: ইফতেখারুল ইসলাম
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে কয়েকজন বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে প্রত্যক্ষভাবে অপরিমেয় প্রভাব বিস্তার করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের (১৯১২—৯৯) স্থান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর চিন্তা এখনো কেন একাডেমি দৃষ্টিতে বিচার করা যায়নি, এর প্রধান দুটি কারণ হতে পারে প্রথমত, রাজ্জাক ভাষণ কিংবা ঘরোয়া আলাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ না করে কেবল মন্তব্য ছুড়ে দেন, যা প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একাডেমিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এ ধরনের মন্তব্যের মোকাবিলা করা যেমন কষ্টসাধ্য, তার চেয়ে বেশি কঠিন হলো সমাজের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাচর্চার বিপক্ষে গিয়ে নতুন তত্ত্ব হাজির করা, যা গবেষক সমাজের জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, তাঁর পিএইচডি প্রকাশ না পাওয়াটাই তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে বিচার করার সুযোগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি খোঁজে পাওয়া অধ্যাপক রাজ্জাকের ভাষণ দুটিতেও তাঁর ক্ষুরধার মন্তব্য গবেষক সমাজকে নতুন চিন্তার দিকে ধাবিত করে। প্রথম ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটিতে, ১৯৯২ সালে। এখানে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। আর দ্বিতীয় ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। এখানেও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। এই দুই অভিভাষণের প্রথমটি ইতিহাস পরিষদের রজতজয়ন্তী সংকলন এবং দ্বিতীয়টি বাঙালীর দর্শনচিন্তা শিরোনামে এশিয়াটিক সোসাইটির সংকলনে অনেকের সঙ্গে প্রকাশিত হলেও এগুলোকে এর আগে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। তাঁর স্মারকগ্রন্থেও এগুলো নেই। সেই হিসেবে এই ভাষণগুলো নতুনই। সঙ্গে এটিও বলা দরকার, ভাষণ দুটি সমাজের চর্চিত চিন্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ২৮ নভেম্বর জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা।